মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার আজিমনগর ইউনিয়নের বসন্তপুর এলাকা। সেখানে একসঙ্গে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৭৫টি ঘর। রয়েছে নিরাপদ সুপেয় পানি, বিদ্যুৎসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও। অথচ, ৭৫টি ঘরের মধ্যে ৫৮টি ঘরই তালাবদ্ধ পড়ে আছে। ঘর বরাদ্দের দেড় বছর পার হলেও ঘরগুলোতে উঠেননি বরাদ্দপ্রাপ্ত পরিবারগুলো। বসন্তপুরের এই আশ্রয়ণ প্রকল্পের মতো হরিরামপুর উপজেলায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের মোট ৯৬টি ঘর তালাবদ্ধ পড়ে আছে। গত বুধ, বৃহস্পতি ও শুক্রবার সরেজমিনে উপজেলার আশ্রয়ণ প্রকল্পগুলো ঘুরে দেখা যায় এই চিত্র। অধিকাংশ ঘরে কেউ না থাকায় ফাঁকা অনেক ঘরেই এখন খড়কুটো ও ছাগল রাখা হয়।
সরজমিনে দেখা গেছে, আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় বসন্তপুর এলাকায় ৭৫টি পরিবারকে ঘর হস্তান্তর করা হয় ২০২৩ সালের ৯ আগস্ট। এর মধ্যে ১৭টি ঘরে বাসিন্দা থাকলেও তালাবদ্ধ পড়ে আছে ৫৮টি ঘর। একই সময়ে হারুকান্দি ইউনিয়নের দক্ষিণ চাঁদপুর এলাকায় ১৪টি পরিবারকে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেখানেও তালাবদ্ধ পড়ে রয়েছে ৭টি ঘর। ধুলশুড়া ইউনিয়নের আইলকুন্ডি এলাকায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৭৭টি ঘরের মধ্যে ৩০টি ঘর তালাবদ্ধ। গালা ইউনিয়নের গোপালপুর এলাকার ৭টি ঘরের মধ্যে তালাবদ্ধ ১টি ঘর। এছাড়া, বলড়া ইউনিয়নের পিপুলিয়া এলাকায় বরাদ্দ দেওয়া ১০ ঘরে বরাদ্দপ্রাপ্ত কেউই ওঠেনি। ১০টি ঘরে অন্য গৃহহীন পরিবারদের থাকতে দিয়েছেন বরাদ্দপ্রাপ্ত পরিবারগুলো।
আশ্রয়ণের বাসিন্দারা বলছেন, তালাবদ্ধ ঘরগুলো বরাদ্দপ্রাপ্তদের অন্যত্র নিজস্ব জায়গা, ঘরবাড়ি বা থাকার জায়গা রয়েছে। রয়েছে জীবন-জীবিকার ব্যবস্থাও। তাই এসব ঘরে ওঠেননি বরাদ্দপ্রাপ্ত পরিবারগুলো। তবে, অনেকেই মাঝে মাঝে এসে ঘরের দেখাশোনা করে যান। এছাড়া, যেসব ঘরে বাসিন্দা আছেন, তারা সবাই ঘর বরাদ্দপ্রাপ্ত নন। ঘর বরাদ্দপ্রাপ্তরা তাদেরকে থাকতে দিয়েছেন।
স্থানীয়রা বলছেন, অবৈধভাবে আর্থিক সুবিধা নিয়ে প্রকৃত ভূমিহীন ও গৃহহীনদের বাদ দিয়ে যাদের অন্যত্র বাড়িঘর ও জায়গা আছে তাদেরকে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর ফলে তালাবদ্ধভাবে পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে এসব ঘর। তাই, তালাবদ্ধ এসব ঘরের বরাদ্দ বাতিল করে প্রকৃত ভূমি ও গৃহহীনদের ঘরগুলো বরাদ্দ দেওয়ার দাবি জানান তারা।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় হরিরামপুরে ১ম পর্যায়ে ১২টি, ২য় পর্যায়ে ২৫টি, তৃতীয় পর্যায়ে ৮৭টি এবং চতুর্থ পর্যায়ে ৮৯টিসহ মোট ২১৩টি পরিবারকে জমি ও ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়।
বসন্তপুর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৪৮ নম্বর ঘর বরাদ্দ হয়েছে হালিমের নামে। অথচ, সেই ঘরে থাকেন কালাচাঁন ঘোষ। কালাচাঁন বলেন, ‘এখানে অনেক ঘর খালি আছে। আমি হালিমের ঘরে থাকি। তিনি আমার কাছে ভাড়া চেয়েছেন, তবে আমি কোনো টাকা তাকে দেইনি। বলেছি, ভাড়া দিয়ে থাকতে হলে আপনার ঘরে থাকবো না।’
আইলকুন্ডি আশ্রয়ণ প্রকল্পের সর্দার আনোয়ারের স্ত্রী সোনিয়া বেগম বলেন, ‘এখানে ৪০-৪৫টি পরিবার নিয়মিত থাকে। বাকি ঘরগুলো তালাবদ্ধ পড়ে থাকে। অনেকে মাঝে মাঝে আসে। কারেন্ট বিল দিয়ে যায়। একদিনও থাকে না।’
আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ঘরে থাকেন সুফিয়া বেগম। তিনি বলেন, ‘নদীতে আমার বাড়িঘর ভেঙে গেছে। তিনটি সন্তান নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। একজন তার ঘরে আমাকে থাকতে দিয়েছে। সাত মাস ধরে এখানে আছি। অনেকের ঘরবাড়ি আছে তারা ঘর পেয়েছে। সে ঘরগুলো তালাবদ্ধ পড়ে আছে। এর মধ্যে একটি ঘর যদি আমার নামে বরাদ্দ দেওয়া হয় তাহলে খুব উপকার হতো। কারণ, যার ঘর সে যদি কাল আমাকে চলে যেতে বলে তাহলে আমার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।’
হরিরামপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘তালাবদ্ধ ঘরগুলোর বরাদ্দ বাতিল করে নতুন করে প্রকৃত ভূমিহীন ও গৃহহীনদের মাঝে হস্তান্তরের জন্য সুপারিশ করবো।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কোহিনুর আক্তার বলেন, ‘বরাদ্দপ্রাপ্ত পরিবারগুলো যদি ঘরে না থাকে সেক্ষেত্রে তাদের দলিল বাতিল করে নতুন করে যারা পাওয়ার যোগ্য তাদেরকে বরাদ্দ দেওয়া হবে।’
মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক ড. মানোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, ‘ঘর বরাদ্দপ্রাপ্ত পরিবারগুলো যদি ঘরে না থাকে তাহলে তাদের বরাদ্দ বাতিল করে নতুন করে ঘর পাওয়ার যোগ্যদের বরাদ্দ দেওয়া হবে।’
একুশে সংবাদ/বিএইচ
আপনার মতামত লিখুন :