বহু ভাষাভাষীর মানুষে সমৃদ্ধ চা-শিল্পাঞ্চলে বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী রয়েছেন, যারা নিজেদের ভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় বলতে, লিখতে বা পড়তে পারেন না। এরমধ্যে অন্যতম একটি ভাষা হচ্ছে ‘খাড়িয়া’ ভাষা। ঐতিহ্যগতভাবে তাদের ভাষার নাম খাড়িয়া।
চা শিল্পাঞ্চলে কর্মরত অসংখ্য খাড়িয়া জনগোষ্ঠীর প্রাণের ভাষা ছিল খাড়িয়া। একসময় এই ভাষায় কথা বলতেন বহু খাড়িয়া শ্রমিক। কিন্তু কালের বিবর্তনে ভাষাটি হারিয়ে যেতে বসেছে। বাংলাদেশে খাড়িয়া ভাষাটিকে এখনো টিকিয়ে রেখেছেন শ্রীমঙ্গল উপজেলার বর্মাছড়া চা বাগানের দুই নারী। তারা হলেন ভেরোনিকা কেরকেটা (৮০) ও খ্রিস্টিনা কেরকেটা (৭৫)।
গেলো ২০২৪ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর জরিপ মতে দেশে এখন ৯৮.২৭ শতাংশ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে চাকমা, মারমা, তংচঙ্গ্যা, হাজং, মুরংসহ বেশকিছু নৃগোষ্ঠীর মানুষ তাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলেন। মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলা এবং হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার চা বাগানগুলোর ৪১টি শ্রমিক কলোনিতে খাড়িয়া জাতিগোষ্ঠীর বাস।
সরকারিভাবে ২০১৯ সালে তৈরি করা আদিবাসী গোষ্ঠীর তালিকায় খাড়িয়াকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর ২০২০ সালে দেশের চা বাগানগুলোর ৪১টি শ্রমিকপাড়া ঘুরে খাড়িয়া জনগোষ্ঠীর হাজারের মতো মানুষের সন্ধান পাওয়া যায়। তবে অনুসন্ধানে ভেরোনিকা ও খ্রিস্ট্রিনা ছাড়া আর কোথাও খাড়িয়া ভাষায় কথা বলার মতো কাউকে পাওয়া যায়নি।
খাড়িয়া সম্প্রদায়ের লোকজন জানান, বর্মাছড়া খ্রিস্ট্রান পল্লিতে খাড়িয়া সম্প্রদায়ের প্রায় ২৪টি পরিবারে শতাধিক লোকের বসবাস। এ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বর্তমান প্রজন্ম বাংলা শিক্ষায় ঝোঁক থাকলেও মাতৃভাষার প্রতি নেই কোনো আগ্রহ। তবে তাদের সেই সুযোগও নেই মাতৃভাষা শেখা বা জানার। এতে করে এ অঞ্চলে একরকম হারিয়ে যেতে বসেছে খাড়িয়া ভাষা।
খাড়িয়া সম্প্রদায়ের লিজা ইন্দোয়ার ও সীমা ইন্দোয়ার জানান, আমাদের মাতৃভাষা যে খাড়িয়া তা বাপ দাদার কাছে শুনেছি, কিন্তু শিখতে পারি নাই। বাংলায় লেখাপড়া করি আর বাবা-কাকারাও বাংলা, দেশোয়ালী ও ভাষার সংমিশ্রণে এক ধরণের ভাষায় কথা বলে। যার কারণে আমরা আমাদের মাতৃভাষা এখন বলতে পারি না। এমনকি বুঝিও না। তবে মাতৃভাষা সংরক্ষণে যথাযথ কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন তারা।
বৈচিত্র্যপূর্ণ বাংলাদেশে আদি খাড়িয়া ভাষার শেষ প্রতিনিধিত্ব করছেন ভেরোনিকা কেরকেটা ও খ্রিস্ট্রিনা কেরকেটা নামের দুই নারী। সম্পর্কে তারা
দুই বোন। দুই বোনের মধ্যে বড় বোনের নাম ভেরোনিকা কেরকেটা, আর ছোট বোন ক্রিস্টিনা কেরকেটা। বয়সে সাত বছরের ছোট-বড়।
শ্রীমঙ্গলের বর্মাছড়া চা বাগান খ্রিস্টান পল্লিতে দীর্ঘদিন থেকে তারা বসবাস করছেন। ভেরোনিকা কেরকেটা অনেক আগেই অবসরে চলে এসেছেন। আর ক্রিস্টিনা কেরকেটা এখনো চা-বাগানের নিয়মিত শ্রমিক। দুজনেরই স্বামী নেই। তবে দুই বোন এক পল্লিতে বসবাস করায় সবসময় দেখা সাক্ষাৎ হয়। এতে কাজের শেষে তারা দুই বোন একত্রিত হয়ে মাতৃভাষা খাড়িয়াতে কথা বলেন। তবে পাশাপাশি বাংলায়ও অনর্গল কথা বলতে পারেন তারা।
ভেরোনিকা কেরকেটা জানান, তার ছেলে-মেয়ে ও নাতি-পুতি কেউ এ ভাষায় কথা বলতে আগ্রহী নয়। তারা বাংলাকেই বেশি পছন্দ করে। তিনি অনেক চেষ্টা করেছেন ঘরের লোকদের মাতৃভাষা খাড়িয়া শেখাতে; কিন্তু সম্ভব হয়নি।
ক্রিস্টিনা কেরকেটা এক রকম হতাশা নিয়ে জানান, তাদের দুবোনের মৃত্যুর পর আর খাড়িয়া ভাষায় কথা বলার কেউ থাকবে না। তার দাবি সরকার এ বিষয়ে যেন উদ্যোগ নেয়।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ ইসলাম উদ্দিন জানান, এ অঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষা ও জীবনমান উন্নয়নে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে ‘খাড়িয়া’ ভাষাটি সংরক্ষণ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হবে।
একুশে সংবাদ//এ.জে
আপনার মতামত লিখুন :