টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীতে (মার্শাল আর্ট) কারাতে শিখে আত্মরক্ষায় বলীয়ান হচ্ছেন ধনবাড়ী উপজেলার অনেক তরুণী। তারা এখন সাহসিকতার সঙ্গে নিজের নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলেছেন। স্কুল-কলেজে মেয়ের একা আসা-যাওয়া নিয়ে অনেক বাবা-মা আর বাড়তি দুশ্চিন্তা করছেন না।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, ধনবাড়ী উপজেলায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছেলে শিক্ষার্থীর চেয়ে মেয়ে শিক্ষার্থী বেশি। এ হার যথাক্রমে ৪৭ ভাগ বনাম ৫৩ ভাগ। ধনবাড়ী উপজেলার পাইস্কা বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তোফাজ্জল হোসেন জানান, সামাজিক অস্থিরতার কারণে অজপাড়াগাঁ পর্যন্ত ইভটিজিং, নারী নির্যাতন ও হেনস্তা এবং যৌন হয়রানি বাড়ছে। মেয়ে শিক্ষার্থীদের একা স্কুল-কলেজে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে। কর্মস্থলে আসা-যাওয়ার সময়ও নারীরা নিরাপদ নন।
শিক্ষার্থী ছাড়াও জরুরি প্রয়োজনে পরিবারের কোনো তরুণী মেয়ে একা বাড়ির বাইরে গেলে অভিভাবকরা খুবই দুশ্চিন্তায় থাকেন। এমতাবস্থায় কিছু সাহসী মেয়ে কারাতে শিখে নিজের নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলার যে প্রচেষ্টা দেখাচ্ছেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। আত্মরক্ষার কৌশল ছাড়াও এ প্রশিক্ষণ তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়াচ্ছে। বিশেষ ধরনের শৃঙ্খলা রপ্ত করায় তাদের মধ্যে ব্যক্তিত্ববোধও গড়ে উঠছে।
ধনবাড়ী উপজেলার পাতলাচড়ার বাসিন্দা ইকবাল হোসেন জুপিটার জানান, তার স্কুল পড়ুয়া দুই মেয়ে আরিশা ইকবাল পুষন এবং আনিহা ইকবাল পদ্ম কারাতে শিখছেন। সামাজিক পরিবর্তনের দরুন মেয়েরা ঘরে-বাইরে প্রতিদিন নতুন চ্যালেঞ্জ বা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন। এসব বাধা জয় করে যেন তারা শিক্ষাদীক্ষা, চাকরিবাকরি এবং ঘর-গৃহস্থালি সামাল দিতে পারেন, সেজন্যই তাদের কারাতে শেখানো হচ্ছে। কারাতে শেখা মেয়েরা আর দশটা সাধারণ মেয়ের চেয়ে শারীরিক সক্ষমতা
এবং মানসিক দৃঢ়তায় ভিন্ন।
ধনবাড়ী উপজেলায় মার্শাল আর্ট কারাতে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন ব্ল্যাককেল্ট প্রাপ্ত সিনিয়র ওস্তাদ শাহজাহান আলী বাবু। তিনি প্রায় তিন দশক ধরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। ধনবাড়ীতে বেসরকারি সংস্থা নিজেরা করির অফিস প্রাঙ্গণ এবং ধনবাড়ী নওয়াব ইন্সস্টিটিউট মাঠে কারাতে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। ছেলেমেয়ে সবাই বিনা বেতনে প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকেন। বিগত তিন বছরে প্রায় দুইশ মেয়েকে কারাতে শেখানো হয়েছে। এদের প্রায় সবাই এখন আত্মরক্ষার কৌশল জানেন। নিজের নিরাপত্তা রক্ষায় তারা আর পরমুখাপেক্ষী নন।
এ কারাতে প্রশিক্ষক ওস্তাদ শাহজাহান আলী বাবু জানান, দিন দিন নারী শিক্ষা সম্প্রসারিত হচ্ছে। কাজের তাগিদে মেয়েরা ঘরের বাইরে বেরুচ্ছেন। নানা মাত্রার নিপীড়ন, নির্যাতন ও হেনস্তার সম্মুখিন হচ্ছেন তারা। নারী শুধু কোমলপ্রাণ নন, তাদের মধ্যে যে দ্রোহ এবং অপরিসীম শক্তিমত্তা রয়েছে সেটির প্রকাশ ঘটানো সম্ভব কারাতে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। বেসরকারি সংস্থা `নিজেরা করি`র ঢাকা বিভাগীয় সমন্বয়ক মো, ফজলুল হক জানান, সমাজে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হন দরিদ্র ও নিম্নআয়ের পরিবারের মেয়েরা। এজন্য তার সংস্থা অফিস ক্যাম্পাসের নিরাপদ পরিবেশে এমন পরিবারের মেয়ে শিক্ষার্থীদের বিনা বেতনে মার্শাল আর্ট কারাতে শেখানোর ব্যবস্থা করেছেন। তার সংস্থার বদৌলতে কারাতে শেখা মেয়েরা রাস্তাঘাটে হেনস্তা করা বখাটে ও সন্ত্রাসীদের মোকাবিলা করে সমাজে প্রশংসা কুড়িয়েছেন।
নিজেরা করির ক্যাম্পাসে সপ্তাহে তিন দিন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আসা-যাওয়ার কিছু খরচ বহন করা হয়। এক বেলা পুষ্টিসমৃদ্ধ নাস্তা দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের তালিকা ভুক্ত ফুটবল কুচ ও রেফারি মোঃ জহিরুল ইসলাম মিলন কে প্রধান করে কারাতে শেখা মেয়েদের নিয়ে একটি বালিকা ফুটবল টিম গঠন করা হয়েছে। এ টিম টাঙ্গাইল জেলায় বেশ কয়েক বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। ফুটবল ছাড়াও এসব মেয়ে শিক্ষার্থীরা স্কুল-কলেজের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় সব সময় আকর্ষণীয় পুরস্কার পেয়ে থাকেন। তুলনামূলকভাবে পরীক্ষায় তারা ভালো রেজাল্ট করছেন। বাল্যবিবাহ, যৌতুক নিরোধ, নারী নির্যাতন বন্ধে প্রচারণাসহ নানা সামাজিক কাজকর্মে সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন তারা।
একুশে সংবাদ/বিএইচ
আপনার মতামত লিখুন :