বাটিতে সিরায় ভেজা গরম রসগোল্লা। টাটকা ছানার ননির ঘ্রাণ উঠছে সেখান থেকে। চামচে তুলে মুখে দিতেই চোখ বন্ধ হয়ে আসে। তুলতুলে নরম আর ঘন দুধের স্বাদ। একটা, দুটো খেলে কি মন ভরে? নিজের অজান্তেই হয়তো আট–দশটি খেয়ে ফেলবেন।
ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার অরুনের দোকানের রসগোল্লার স্বাদটাই এমন। লোকে বলে, নেশা ধরানো রসগোল্লা। এক বসায় অনেকে আধা কেজিও খেয়ে ফেলেন। যখন কোন নতুন জায়গায় যাইবেন, দুইটা বিষয় পয়লা জানার চেষ্টা করবেন। ওই জায়গার মানুষ কী খায়। আর পড়ালেখা কী করে। কাঁচাবাজারে যাইবেন, কী খায় এইডা দেখনের লাইগ্যা। আর বইয়ের দোকানে যাইবেন পড়াশোনা কী করে হেইডা জাননের লাইগ্যা,’ আহমদ ছফাকে দেওয়া অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের বিখ্যাত উপদেশ।
নতুন কোনো অঞ্চলে গেলে সে জায়গার মানুষকে জানতে অধ্যাপক সাহেবের এই উপদেশ আমিও অনুসরণ করার চেষ্টা করি সবসময়। এক্ষেত্রে মানুষের খাদ্যাভ্যাস জানতে কাঁচাবাজারের পাশাপাশি বহু বছরের পুরানো খাবারের দোকানও বেশ আকর্ষণীয় জায়গা আমার কাছে। আর ভাগ্যক্রমে যদি দেখা মেলে দুই পুরুষ পুরানো কোনো মিষ্টির দোকানের, তবে তো আর কথাই নেই! সব বয়সী, আর সব শ্রেণির ক্রেতার আনাগোনার দেখা মেলে এলাকার প্রাচীন মিষ্টির দোকানগুলোতে।
বেশিরভাগ দোকানেই মিষ্টির পাশাপাশি অল্পবিস্তর চা-নাস্তারও আয়োজন থাকে। দোকানের ভেতরে চায়ের টেবিলের প্রাণোচ্ছল আড্ডায় জানা যায় সে অঞ্চলের মানুষের দৈনন্দিন অভ্যাস আর এলাকার চলতি সব খবরাখবর। ঠিক সেরকমই এক অন্যরকম এক মিষ্টনের কথা লিখবে আমার কলম, রাজাপুর উপজেলার পুরাতন বাজারে গেলেই এই দোকানের দেখা মেলে দোকানটিকে বাইরে থেকে দেখে চোখে পড়ে না কোনো বিশেষত্ব। আর দশটি সাধারণ মিষ্টির দোকানের মতোই সামনের কাচের বাক্সে সাজানো রসগোল্লা, চমচম, কালোজাম, জিলাপি আর বাতাসা।
আগের দিনের লম্বা এক কাঁচের আলমারিতে রাখা সন্দেশ, কাঁচাগোল্লাসহ নানা ধরনের মিষ্টি। ৪ যুগ ধরে কাঁচাগোল্লা, রসগোল্লা আর স্বাদে শহরবাসীর মন জয় করে সগৌরবে টিকে থাকা শহরের সবচেয়ে প্রাচীন মিষ্টির দোকান এই অরুন মিষ্টান ভান্ডার। পুরোনো বেড়ার ও টিনশেডের দোকান। সামনে এক কক্ষে আটটি নড়বড়ে টেবিল আর কিছু চেয়ার ও বেঞ্চ সাজানো। পেছনেই কারখানা। তবে দর্শনে যতই জীর্ণ হোক না কেন মোহনীয় রসগোল্লার ঘ্রাণ সব ছাপিয়ে মন কেড়ে নেয়। অরুনের মিষ্টির দোকানের সামনে তাই সব সময় ভিড় লেগেই থাকে। গত শুক্রবার সরেজমিনে অরুন মিষ্টান ভান্ডার এ গিয়ে দেখা গেল, কয়েকজন ক্রেতা বসে মিষ্টি খাচ্ছেন। তাদের মধ্যে বলেন, গরুর খাঁটি দুধের ছানা থেকেই এই দোকানের রসগোল্লা তৈরি হয়। আমরা পরিবার মিলে প্রায় দিনই রসগোল্লা খেতে এখানে চলে আসি। স্বাদ অতুলনীয়। তুলতুলে মিষ্টি একটা-দুইটা নয়, কয়েক হালি না খেলে তৃপ্তি মেটে না। এক কামড়ে মুখে পুরো রসগোল্লা গলে যায়।
এ খানের ছানার স্বাদও আলাদা। রোজ সকাল ৬টা থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত কেনাবেচা চলে অরুন মিষ্টান ভান্ডারে। মিষ্টির পাশাপাশি নাস্তা হিসেবে সকাল ১০টা পর্যন্ত পাওয়া যায় পরোটা-ভাজি। দুপুরে বিকেলে পাওয়া যাবে সিঙ্গারা, পুরি চটপটি খাঁটি গরুর দুধের চা ইত্যাদি। নিরঞ্জন রায়ের হাত ধরে এই দোকানের রসগোল্লার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে ব্যবসা চালাচ্ছেন তার বড় ও মেজ ছেলে অরুন রায় ও তপন রায়। চার ভাইয়ের মধ্যে অরুণ বড়। সেজ ভাই মারা গেছেন চার বছর আগে। দোকানের ক্যাশে বসে অরুন শোনালেন তাঁদের গল্প। তিনি বলেন, এক সময় তাঁর বাবা অর্থাৎ নিরঞ্জন রায় এই দোকানের যাএা শুরু করেন।
ছোট থেকেই দোকানে বাবাকে সহযোগিতা করতাম। ১৯৯৯ তে তার বাবা অর্থাৎ নিরঞ্জন রায় মারা যাওয়ার পর আমি ব্যবসার হাল ধরি। দোকানের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশজুড়ে। বর্তমানে অরুনের দোকানে কারিগরসহ ৭ জন কর্মচারী কাজ করেন। এই দোকান তার আলাদা একটা ভালবাসার জায়গা। বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে থেকে ২৫০-৩০০ কেজি করে দুধ লাগে। তবে পয়লা বৈশাখ, ঈদ, দুর্গা পূজাসহ বিভিন্ন উৎসবে প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ কেজির বেশি দুধের প্রয়োজন হয় বলে জানান । অরুনের মিষ্টি এখন এলাকার ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে।এলাকার বাইরে থেকেও লোকজন রসগোল্লা কিনতে আসেন।
রাজাপুর ছাড়াও ঝালকাঠি কিংবা পাশ্ববর্তী পিরোজপুর জেলা থেকেও অর্ডার আসে। অনেক সময় অগ্রিম অর্ডার দিয়েও পেতে কষ্ট হয় বলে জানান ক্রেতারা। আরিফ নামের একজন সাত কেজি রসগোল্লা কিনছিলেন কয়েক কিলো দূর থেকে এসে। অনেক মিষ্টির দোকান থাকতেও কেন মিষ্টি নিতে এসেছেন এখানে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এদের রসগোল্লা খুবই সুস্বাদু , বোনের বাড়িতে যাচ্ছি, বোন অরুন দাদার দোকানের মিষ্টি খুব পছন্দ করেন।
স্থানীয় এক যুবক এর সাথে কথা বললে তিনি জানান, সকালের নাস্তায় অরুন মিষ্টান ভান্ডারের মুচমুচে পরোটা বেশ প্রিয় খায়রুল এর। প্রায়ই ভোরে হাঁটাহাঁটি শেষ করে বন্ধুদের নিয়ে এখানে নাস্তা করতে আসেন তিনি। তার ভাষ্যে, রাজাপুরের সবচেয়ে ভালো মিষ্টি পাওয়া যায় এখানে। ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে মিষ্টি কিনতে আসতেন তিনি। তার ছোট ছেলে পড়াশোনার জন্য ঢাকায় থাকে। বাড়িতে এসেই তার প্রথম আবদার থাকে অরুন মিষ্টান ভান্ডারের রসগোল্লার। গিন্নির পছন্দ ছানা । এখানে নাস্তা করতে আসলে সবসময় তার জন্য পরোটা আর ছানা নিয়ে যাই বাসায়।
কারখানায় ঢুকে দেখা যায়, গৌতম নামের এক কারিগর ৪০ বছর থেকে কাজ করছেন এখানে তাকে, দুধ থেকে ছানা কেটে সেই ছানা ও চিনি দিয়ে মিষ্টি তৈরি করেন। দুধের ঘনত্ব যত বেশি, মিষ্টিও তত সুস্বাদু। ৭ কেজি দুধ থেকে এক কেজি ছানা। কোনো ধরনের রং, রাসায়নিক বা ক্ষতিকারক কিছু ব্যবহার করা হয় না। প্রতি পিস রসগোল্লা ১০ টাকা, রসমালাই প্রতি পিস ২০ টাকা, টক দই ২০০ টাকা, মিষ্টি দই ২৫০ টাকায় বিক্রি হয়।
প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫ থেকে ৬শ কেজির বেশি রসগোল্লা বিক্রি হয়। তবে প্রতি বৃহস্পতিবার, শুক্রবার ও শনিবারে দোকানটিতে ভিড় বাড়ে। বর্তমানে দুধ, চিনিসহ নানা উপকরণে দাম বৃদ্ধি পাওয়াতে দোকানের ঐতিহ্য ধরে রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে জানান অরুন। অরুন রায় আরও জানান, দুই পুরুষের এই অরুন মিষ্টান ভান্ডারের সুনাম বংশানুক্রমে আরো শতবছর টিকিয়ে রাখার স্বপ্ন দেখে যাই। বাকিটা ভগবানের ইচ্ছা।
একুশে সংবাদ/বিএইচ
আপনার মতামত লিখুন :