সরকার নির্ধারিত ভোজ্যতেলের যে দাম ঠিক করে দিয়েছে তার সঙ্গে বিশ্ববাজারের তেলের দামের কোনো সামঞ্জস্য নেই উল্লেখ করে তেল ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বাজারে টিকে থাকতে তারা সরকার নির্ধারিত রেটের চেয়ে কম দামে তেল বিক্রি করছেন।
সোমবার (১৮ ডিসেম্বর) আসন্ন পবিত্র রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ স্বাভাবিক ও মূল্য স্থিতিশীল রাখার বিষয়ে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় এ কথা বলেন ব্যবসায়ীরা।
ভোজ্যতেল মিল মালিকদের সংগঠনের সভাপতি ও সিটি গ্রুপের পরামর্শক অমিতাভ চক্রবর্তী বলেন, সরকারের রেট অনুযায়ী প্রতি মণ সয়াবিন তেলের দাম ৬ হাজার ২০০ টাকা। কিন্তু বর্তমানে বিশ্ববাজারে তেলের দাম মণপ্রতি ৫ হাজার ৫০০ টাকা।
আমরা সরকারি রেটে তেল বিক্রি না করে উল্টো বিশ্ব বাজারের রেটের সঙ্গে মিলিয়ে বিক্রি করছি। এখন যদি কেউ প্রশ্ন করে এখানে সরকারি রেট কেন মানা হচ্ছে না, সেটি যুক্তিযুক্ত কোনো আলোচনা হতে পারে না
সরকারের মনিটরিংয়ের ব্যাপারে অমিতাভ বলেন, একটি বিষয়ে সরকারের ১০টি প্রতিষ্ঠান মনিটরিং করে। তাদের ফরম্যাট মেনে তথ্য সরবরাহ করতে হয়। একটির সঙ্গে আরেকটির কোনো সমন্বয় নেই। মাঝ দিয়ে ঝামেলা পোহায় ব্যবসায়ীরা।
এটি যদি একটি প্রতিষ্ঠানের আওতাভুক্ত করা হয়, তাহলে একদিকে যেমন মনিটরিং সহজ হবে, অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের তথ্য সরবরাহ করাও সহজ হবে। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআই অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করতে পারে।
বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মাওলা বলেন, বড় বড় প্রতিষ্ঠানের মতো তারাও সয়াবিন ও পাম তেল কম রেটে বিক্রি করছেন। খোলা তেল থাকায় মানুষ কম দামে তেল কিনতে পারে বলে দাবি করেন তিনি।
খোলা তেল বাজারজাত বন্ধে সরকারি নির্দেশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, খাদ্য নিরাপত্তার অজুহাতে বাজার থেকে খোলা তেল তুলে নেয়ার পদক্ষেপ হবে বাজার ব্যবস্থার জন্য আত্মঘাতী পদক্ষেপ। এতে করে ভোজ্যতেল ব্যবসা মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে চলে যাবে। একদিকে তেলের দাম বাড়বে, অন্যদিকে পাইকারি তেল ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
খোলা তেল বিক্রি বন্ধ প্রসঙ্গে অমিতাভ বলেন, সরকারি নির্দেশমতে, ডিসেম্বরের মধ্যে খোলা তেল বিক্রি বন্ধের কথা বলা হয়েছে। এটা সম্ভব না। একটি আইন করলে সেটি প্রয়োগে যথেষ্ট সময় দেয়ার দরকার।
খোলা তেলের ব্যাপারে যে অভিযোগ সবচেয়ে বেশি তা হলো- এই তেলে ভিটামিন ‘এ’ থাকে কি না। আমাদের কাছে মনে হয় খোলা তেলেও ভিটামিন ‘এ’ নিশ্চিত করা সম্ভব। তবে এ ব্যাপারে সরকার আমাদের যেভাবে নির্দেশনা দেবে আমরা সেভাবে চলব।
বর্তমানে তেল আমদানিতে এলসি (ঋণপত্র) জটিলতা নিয়ে ব্যবসায়ীরা বলেন, দেশের ভোজ্যতেলের ৯৫ শতাংশ চাহিদা আমদানিনির্ভর। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের দ্রুত এলসি খোলা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। কিন্তু ব্যবসায়ীরা এলসি খুলতে নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছেন। যেসব নিত্যপণ্য দ্রুত আমদানির প্রয়োজন সেসব ক্ষেত্রে এলসি খোলার গতিবৃদ্ধির ওপর জোর দেন তারা।
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কথা উল্লেখ করে অমিতাভ বলেন, আমাদের পণ্যের দামের সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। আমাদের উচিত একটি ডাটাব্যাংক তৈরি করে পণ্যের দামের সঠিক তথ্য রাখা এবং সে অনুযায়ী দাম ঠিক রাখা। এতে করে ভোক্তা যেমন উপকৃত হবেন, তেমনি যারা নতুন আমদানি-রফতানির ব্যবসা করছেন তারাও সুবিধাভোগীর আওতাভুক্ত হবেন।
নির্দিষ্ট কোনো ডাটাব্যাংক না থাকার প্রতিকূল দিক উল্লেখ করে গোলাম মাওলা বলেন, কেউ বলতে পারবে না আমাদের প্রতিবছর কী পরিমাণে ভোজ্যতেল লাগে। এর কোনো সঠিক পরিসংখ্যান না থাকায় চাহিদার সঙ্গে সরবারহের একটি বড় অসামঞ্জস্য সৃষ্টি হয়। এর কারণে বাজারে অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়, সংকট দেখা দেয়। অনেকে এটাকে সুযোগ হিসাবে নিয়ে তেলের দাম বাড়িয়ে অতিরিক্ত মুনাফা লাভের চেষ্টা করে।
বাজার সম্পর্কে গোলাম মাওলা বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ী সংগঠনের দৌড়াদৌড়ি শুরু হয় দাম বাড়ার পরে। কিন্তু দাম বাড়ার আগেই যদি কারণগুলো শনাক্ত করা যায়, তাহলে বাজারে অরজকতা সৃষ্টি হয় না। এমনভাবে কাজ করতে হবে যাতে করে দাম একদমই না বাড়ে। মনিটরিং ব্যবস্থা যাতে দাম বাড়ার আগেই সোচ্চার থাকে; সেদিকে নজরদারি জোর দেয়ার দাবি জানান এক ব্যবসায়িক নেতা।
বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সিন্ডিকেট বলে কিছু নেই, সাপ্লাই চেইনের কারণে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে। এটাকে কোনোভাবে সিন্ডিকেট বলা যায় না।
পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির জন্য কৃত্রিম সংকট দায়ী উল্লেখ করে মাহবুবুল আলম বলেন, এক রাতের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম কেজিতে ১০০ টাকা বেড়ে গেছে। এটা মেনে নেয়া যায় না। এর জন্য দায়ী কৃত্রিম সংকট। সরবরাহ চেইনে কৃত্রিম সংকটের জন্য বাজার অস্থির হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, দেশে অসাধু ব্যবসায়ীর সংখ্যা ১ শতাংশের কম। যারা সংকট সৃষ্টি করছে এফবিসিসিআই তাদের সঙ্গে নেই। অনেকে মনে করে গোডাউনে পণ্য রাখা অপরাধ। ব্যবসায়ীরা গোডাউনে থেকেই বাজারে পণ্য সরবরাহ করে থাকে। গোডাউনে মাল রাখা কোনো অপরাধ নয়।
এ সময় ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, ব্যবসায়ীরা মুনাফা করবে। কিন্তু অসাধু উপায়ে মুনাফা করা যাবে না। সামনে ক্রিসমাসে পশ্চিমারা ওদের পণ্যে ছাড় দিচ্ছে। আর দেশে রোজা এলেই পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়। এটি করা যাবে না।
মতবিনিময় সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন এফবিসিসিআইর সিনিয়র সহসভাপতি মো. আমিন হেলালী, বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন, বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহসভাপতি ইশতিয়াক আহমেদ প্রমুখ।
একুশে সংবাদ/এএইচবি/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :