চাল, তরমুজ, গরুর মাংসের দাম বৃদ্ধির পর এবার এই তালিকায় সবশেষ যুক্ত হয়েছে দেশের মানুষের অন্যতম প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য আলু। ঈদের ছুটির পরপরই বাজারে হাফ সেঞ্চুরি করেছে আলু। কোথাও কোথাও বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৫৫ টাকাতেও। আলুর বাজার সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী মহল দাম বৃদ্ধির পেছনে অসাধু মজুতদারদের শক্তিশালী সিন্ডিকেটের পাশাপাশি, সার-বীজের দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষকদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া, বিরূপ আবহাওয়ার কারণে পর্যাপ্ত ফলন না হওয়া এবং প্রতিবেশী দেশেও আলুর উচ্চ দামকে দায়ী করছে।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের আলুপট্টিতে ঘুরে পাওয়া গেল আলুর বাজারের অস্থিরতার আঁচ। আলুপট্টির ব্যবসায়ীরা জানান, বছরের এই সময়ে আলুর এত দাম অতীতে কখনোই দেখেননি তারা। এই পরিস্থিতি বজায় থাকলে আলুর মৌসুম শেষ হলে মাসখানেক পর মানুষকে প্রতি কেজি আলু ৮০ টাকায় কিনে খেতে হবে।
দাম বৃদ্ধির পেছনে অসাধু মজুতদারদের শক্তিশালী সিন্ডিকেটের পাশাপাশি, সার-বীজের দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষকদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া, বিরূপ আবহাওয়ার কারণে পর্যাপ্ত ফলন না হওয়া এবং প্রতিবেশী দেশেও আলুর উচ্চ দামকে দায়ী করছে আলুর বাজার সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী মহল।
তারা জানান, সরকারের তরফে উৎপাদন খরচ ১৩ টাকা ৯০ পয়সা নির্ধারণ করা হলেও, সার বীজ ও শ্রমিকের মজুরি বেড়ে যাওয়ায় এবার উৎপাদন খরচ পড়েছে এর চেয়ে অনেক বেশি। এছাড়া কৃষক পর্যায়ে আলু বিক্রির দাম ১৮ টাকা ৫০ পয়সা ধরা হলেও কৃষকরাই আলু বিক্রি করেছেন ২৫ থেকে ৩০ টাকা কেজিতে। সবশেষ কোল্ড স্টোরেজগুলো পর্যন্ত পৌঁছাতে আলুর দাম পড়েছে কেজি প্রতি ৩৫ টাকায়।
অন্যান্য বছরের চেয়ে বেশি দামে আলু কিনে মজুতদাররা এখনই বাজারে তা ছাড়তে চাচ্ছেন না। ব্যবসায়ীরা অপেক্ষা করে আছেন আরও দাম বৃদ্ধির। এর ওপর যুক্ত হয়েছে প্রতিবেশী দেশ ভারতে আলুর দাম বৃদ্ধির বিষয়টি। যে কারণে সরকার আমদানির অনুমতি দিয়ে রাখলেও, ভারতের বাজারের সঙ্গে বাংলাদেশের বাজারের খুব একটা তারতম্য না থাকায় আলু আমদানিতে খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। সরকার অবশ্য আলুর সংকট নিরসনে আমদানির অনুমতি দিয়ে রেখেছে।
কারওয়ান বাজারের পাইকারি আলুর আড়ত বিক্রমপুর বাণিজ্যালয়ে মো. হানিফ নামের এক ব্যবসায়ী জানান, বর্তমানে বস্তা হিসেবে আলু বিক্রি হচ্ছে ৪৩ টাকা কেজি দরে। এই আলু ক্ষুদ্র পাইকারি ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে বিক্রি করছেন ৪৫ থেকে ৪৬ টাকা দরে। কারওয়ান বাজারের খুচরা বাজারে এই আলু বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা কেজিতে।
কারওয়ান বাজারের আলুপট্টির খুচরা ব্যবসায়ী মকবুল হোসেন বলেন, মোকাম থেকে আলু কিনে অন্যান্য খরচ যোগ করে আলুর প্রতি কেজিতে খরচ পড়ছে ৪৬ থেকে ৪৭ টাকা। প্রতি কেজি বিক্রি করা হচ্ছে ৫০ টাকায়। এই আলু যখন রাজধানীর বিভিন্ন মুদি দোকান ও পাড়া মহল্লার বাজারে চলে যাবে সেখানে বিক্রি হবে প্রতি কেজি ৫৫ টাকায়।
আলুর দামের এই বৃদ্ধির জন্য তিনি বড় মজুতদারদের দায়ী করে বলেন, তারা কৃষকদের থেকে আলু কিনে জমা করছেন কোল্ড স্টোরেজে। এ কারণে বাজারে আলুর সরবরাহ কম, তাই দাম বেশি।
আলুর দামের হঠাৎ এই বৃদ্ধি তাদেরও অবাক করেছে বলে জানালেন কারওয়ান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা। কারওয়ান বাজার কাঁচামাল আড়ত ব্যবসায়ী মালিক বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের কোষাধ্যক্ষ দেলোয়ার হোসেন জানান, পাইকারি বাজারে আলু ৪২ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। আলুর দাম এত বেশি কেন তার উত্তর জানা নেই। যদি খুচরা বাজারে কেউ ৫৫ টাকা বিক্রি করে, তবে সেটির দায় পাইকারি ব্যবসায়ীরা নেবেন না।
বর্তমানে বাজারে কৃষকদের হাতে থাকা আলুর সরবরাহই বেশি বলে জানান কারওয়ান বাজার কাঁচামাল আড়ৎ ব্যবসায়ী মালিক বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের যুগ্ম সম্পাদক ইয়াসিন ভান্ডারি ময়না।
আলুর বাজারে সিন্ডিকেটের থাবা পড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোল্ড স্টোরেজগুলোতে এই কারসাজি হচ্ছে। সেখানে বড় মজুতদাররা আলু কিনে মজুত করে রাখছেন। আলুর বাজার যখন আরও চড়া হবে তখন তারা আলু বাজারে ছাড়বেন।
এদিকে আলুর দাম ক্রেতাদের নাগালের মধ্যে রাখার জন্য এখন থেকেই আলু আমদানির উদ্যোগ নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন কারওয়ান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীরা।
আলুর এই সংকটের সমাধান এখন কোল্ড স্টোরেজের হাতে উল্লেখ করে কারওয়ান বাজার কাঁচামাল আড়ত ব্যবসায়ী মালিক বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক মো. সাইফুর রহমান চৌধুরী সুজন বলেন, সেখান থেকে সাপ্লাই ঠিক থাকলে বাজার ঠিক হয়ে যাবে। কারণ মজুত তো ওখানেই হয়। কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী সমিতির পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোল্ড স্টোরেজগুলোতে চাপ দেয়া হলে উল্টো কোল্ড স্টোরেজগুলোর তরফে কারওয়ান বাজারে আলুর সরবরাহ কমিয়ে দেয়া হয়।
তবে দাম বৃদ্ধির দায় নিতে নারাজ কোল্ড স্টোরেজ মালিকরা। বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, আলুর এই দাম বৃদ্ধিতে কোল্ড স্টোরেজের কোন দায় নেই। কারণ এবার কৃষকরাই আলু বিক্রি করেছে বেশি দামে। কৃষকরা আলু বিক্রি করেছে ২৫ থেকে ৩০ টাকা কেজি দরে। এই আলু কৃষকের হাত থেকে যখন স্থানীয় বাজারে যাবে তখন এর সঙ্গে আরও ১০ টাকা যুক্ত হবে, আর রাজধানীর বাজারে গেলে এর সঙ্গে আরও ২০ টাকা যুক্ত হবে অন্যান্য খরচ বাবদ। সেক্ষেত্রে যদি আলু প্রতি কেজি ৩০ টাকা ধরে কিনে ব্যবসায়ীরা কোল্ড স্টোরেজে ঢোকায়, তাহলে তো অন্যান্য খরচসহ এমনিতেই আলুর দাম অনেক বেশি পড়ে যাবে।
এছাড়া কোল্ড স্টোরেজ থেকে এখনও বাজারে আলু ছাড়ার সময় শুরু হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোল্ড স্টোরেজ থেকে আলু ছাড়া শুরু হবে আগামী জুন মাসে।
এদিকে কৃষি বিপণনের তরফে আলুর উৎপাদন মূল্য ও যৌক্তিক মূল্য যে হারে নির্ধারণ করা হয়েছে তার সঙ্গে বাজার বাস্তবতার কোনো সামঞ্জস্য নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, মার্চ মাসে কৃষক পর্যায়ে দাম যখন ১৮ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল, তখনই তো বাজারে আলু কৃষকরা ২৫ থেকে ৩০ টাকা কেজিতে বিক্রি করেছিল। এ ব্যাপারে আমাদের তরফে কৃষি বিপণনসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানিয়েছিলাম। আমরা তখনই বলেছিলাম, আপনারা যে দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছেন তার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। এ কারণে সামনে জটিলতা তৈরি হতে পারে।
বাজারে আলুর যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২৮ টাকা ৫৫ পয়সা, যদিও এই দরের সঙ্গে বাজারের মূল্যের কোনো সামঞ্জস্য নেই। বিষয়টি স্বীকার করে কৃষি বিপণন অধিদফতরের মহাপরিচালক মাসুদ করিম বলেন, বাজার পরিস্থিতি বিবেচনা করে খুব শিগগিরই আলুর যৌক্তিক মূল্য পুনর্নির্ধারণ করা হবে। এবার বাজারে চাহিদা ও যোগানের মধ্যে একটা ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে।
এদিকে আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণে এর আগে আলুর মোকামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত কোল্ড স্টোরেজগুলোতে অভিযান চালায় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। সে সময় বেশ কিছু কোল্ড স্টোরেজকে জরিমানা করার পাশাপাশি অবৈধ মজুতকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল।
একুশে সংবাদ/ন.প্র/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :