২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণা করা হবে আজ। অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বাজেট উপস্থাপন করবেন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে এটি হবে তাঁর প্রথম বাজেট। এটি দেশের ৫৩ তম, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের ২৫তম বাজেট। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে প্রথম জাতীয় বাজেট উপস্থাপিত হয় ১৯৭২ সালের ৩০ জুন। দেশের প্রথম বাজেটের পরিমাণ ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেট পেশ করেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে এসে আজকের বাজেটের সম্ভাব্য আকার এবং পরিমান দাঁড়িয়েছে প্রায় আট লাখ কোটি টাকা।
স্বাধীনতার পর গত ৫৩ বছরে সর্বোচ্চ সংখ্যক বাজেট প্রণয়ন করেন বর্তমান আওয়মী লীগ সরকার। আজকের বাজেটসহ ২৫টি, বিএনপি ১৬,জাতীয় পার্টি ৯টি ও তত্বাবধায়ক সরকার ৩টি। বাংলাদেশের বাজেটের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বাজেট পেশ করেছেন এম সাইফুর রহমান ও আবুল মাল আব্দুল মুহিত। তারা দুজনেই ১২টি করে বাজেট পেশ করেছেন।
একটি নির্দিষ্ট অর্থবছরে দেশের কোন খাতে কোথায় কত ব্যয় হবে সরকারের এই আর্থিক পরিকল্পনার চিত্র প্রতিফলিত হয় বাজেটের মাধ্যমে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেট থেকে শুরু করে গত বছর পর্যন্ত যেসব বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে তাতে দেখা যায় সময়ের সাথে প্রত্যেকটা বাজেটের আকার বেড়েছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, বাজেটে টাকার পরিমাণ বাড়লেও অর্থনীতির অনুপাত হিসেবে বাজেট বাড়েনি। তাদের মতে, সময়ের পরিবর্তনে বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে `গুণগত` যে পরিবর্তন হওয়া উচিত ছিল তা হয়নি। গত পাঁচ দশকের বাজেট প্রণয়নের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে এক ধরনের পরিবর্তন এসেছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যেখানে রাষ্ট্রায়ত্ব খাতের ওপর নির্ভর করে শিল্পায়নের কথা চিন্তা করা হতো, সরকার বদলের সাথে সাথে সেখানে রাষ্ট্রের জায়গায় ব্যক্তিখাতের ভূমিকাকে বড় করা হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী- দেশের প্রথম বাজেটের পরিমাণ ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরিয়ে এসে এই বাজেটের আকার দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকা। স্বাধীনতার পরে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের তৈরি ওই বাজেটটি বাংলাদেশের একটি `ঐতিহাসিক বাজেট` হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন অর্থনীতিবিদেরা।“মাত্র ছয় মাস হয়েছে দেশ মুক্ত হয়েছে, এরকম একটা সময়ে ওই বাজেট হয়। যেখানে সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ছিল না, রাজস্ব আদায় সেভাবে ছিল না। সরকারের বৈদেশিক সাহায্যের ব্যাপারটিও অনিশ্চিত ছিল," ।
"সম্পদের অনিশ্চিত পরিস্থিতির ভেতরে একদিকে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের বিষয় ছিল, এর পাশাপাশি যেসব অবকাঠামো ভগ্ন অবস্থায় ছিল - হাজার হাজার সেতু, একইসাথে কৃষি শিল্প ইত্যাদি ক্ষেত্রে পুনর্বাসন বা পুনর্গঠনের বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। দেশের প্রথম সেই বাজেট আকারে ছোট হলেও `গুণমানসম্পন্ন` একটি বাজেট সেসময় তৈরি হয়েছিল বলে মন্তব্য করেন অর্থনীতিবিদরা।
“তখন পুনর্বাসনের বিষয় ছিল। মিশ্র অর্থনীতির মধ্যে রাষ্ট্রীয় খাতের প্রাধান্য রেখে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের বাজেটগুলো হয়েছে। যাতে বৈষম্য কমানোর তাগিদ ছিল, কর্মসংস্থান সৃষ্টির তাগিদ ছিল। বৈদেশিক প্রভুত্ব কমানোর তাগিদ ছিল। স্বনির্ভর হওয়ার তাগিদ ছিল বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞগণ। তখন বৈদেশিক সাহায্য নেয়ার ব্যাপারে সরকার অনেক সতর্ক ছিল এবং বাজার প্রয়োগ না করে রেশন ও ন্যায্যমূল্যের উপরে সরকার গুরুত্ব দিয়েছে।
তাজউদ্দীন আহমদ অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন মোট তিনটি বাজেট পেশ করেন। সেসব বাজেটে বরাদ্দ ছিল যথাক্রমে ৭৮৬ কোটি টাকা, ৯৯৫ কোটি টাকা এবং ১ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। স্বাধীনতার ৫২ বছরের ব্যবধানে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের যে বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছিল সেটির আকার হয়েছিল ছয় লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এবারে বাজেট রাখা হয় প্রায় ৮ কোটি টাকা।
২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার পর এক বছরে ৩০ হাজার কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো হয়। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে এম সাইফুর রহমান ৬৯ হাজার ৭৪০ কোটি টাকার বাজেট দেওয়ার পর ২০০৭-০৮ অর্থ বছরে মির্জা আজিজুল ইসলাম ৯৯ হাজার ৯৬২ কোটি টাকার বাজেট দেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দুই বছরের বাজেটে সবচেয়ে বেশি ব্যবধান ছিল সেবারই প্রথম। এরপর প্রতি বছরেই বাজেট ব্যবধান বাড়তে দেখা গেছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে পর প্রথম লক্ষ কোটি টাকার বাজেট পেশ করেন। এরপর প্রতি বছরই গড়ে অন্তত ২৫ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ বেড়েছে। স্বাধীনতার পর অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের হাতেই বাজেট হাজার কোটির কোটায় আসে এবং পরে তা লক্ষ কোটির কোটায় নিয়ে যান আওয়ামী লীগের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। মি. মুহিতের পেশ করা ২০০৯-২০১০ অর্থবছরের বাজেটকে ‘প্রথম উচ্চাভিলাষীর বাজেট’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়ে থাকে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, বাজেটের ক্ষেত্রে প্রথম বড় `পলিসি শিফট` বা `নীতির পরিবর্তন` হয়েছে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। রাষ্ট্রায়ত্ব খাতের ভূমিকাকে সীমিত করা হয়েছে ও ব্যক্তিখাতের ভূমিকাকে বড় করা হয়েছে। “রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নাগরিকদের জন্য যে দায়িত্বের জায়গা আছে সেটা ক্রমান্বয়ে ব্যক্তিখাতের কাছে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। প্রথমে এটা ছিল মালিকানার ক্ষেত্রে এবং পরে এটা বাজার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও পরিলক্ষিত হয়েছে। এবং তারপরে বৈদেশিক সম্পর্কের মাধ্যমে।”
১৯৭২-১৯৭৩ অর্থবছরের বাজেট মূলত পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনধর্মী ছিল যেখানে আয়-ব্যয়ের হিসাব ছিল ভিন্ন। জিয়াউর রহমানের আমলে বাজেটে মিশ্র অর্থনীতির অংশ রাখার চেষ্টা হয়েছিল বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। সেখানে ব্যক্তিখাত এবং রাষ্ট্রায়াত্ব খাতকে সমান গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। “রাষ্ট্রায়ত্ত্ব কলকারাখানাগুলো ব্যক্তিখাতে ফেরত দেয়া প্রসঙ্গে বাজেটে জিয়াউর রহমান বলেছিলেন ‘আমি যদি কোনও কারখানা লাভজনক পাই ও রাষ্ট্রায়ত্ত্ব হবার পরও যদি লাভজনক পাই কেন আমি ব্যক্তিখাতে দিয়ে দেব? তখন তো লাভটা দিয়ে শিক্ষা সামাজিক খাতে ব্যবহার করতে পারবো”।
বিরাষ্ট্রীয়করণ এবং বাজার অর্থনীতির ধারা জোরালো রূপ পায় জেনারেল এইচএম এরশাদ সরকারের সময়। যার প্রতিফলন দেখা যায় বাজেটে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন “সত্তরের দশকের সমাজতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা থেকে যে বিভিন্ন সরকার সরে আসতে থাকে তা বাজেটে প্রতিফলিত হয়েছে। এবং আস্তে আস্তে মুক্তবাজার অর্থনীতির দিকে গেছে।
বাংলাদেশের প্রথম দিকের বাজেটে বৈশ্বিক চিন্তাভাবনার বিষয়টি প্রতিফলিত না হলেও আশির দশকের শেষ দিক থেকে বাজেটে কাঠামোগত পরিবর্তন দেখা যায়। আশির দশকে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বিনিয়োগ তুলে দিয়ে সেটা ব্যক্তি খাতে যাবার যে প্রক্রিয়াটা শুরু হয় নব্বইয়ের দশকে এসে সেটা আরও ত্বরান্বিত হয়।“আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে তৈরি পোশাক শিল্পের রপ্তানি শুরু হলো তখন বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে যে সুযোগ-সুবিধা ছিল তাতে যুক্ত হতে থাকলাম আমরা। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা যে কোটামুক্ত প্রবেশাধিকারের সুযোগ তৈরি করে দিল তাতে কিন্তু আমরা জড়িত হলাম। ওপেন মার্কেট ইকোনমিতে যুক্ত হলাম আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে নব্বইয়ের দশকে সেটা আরও প্রসারিত হলো”।
অর্থনীতিবিদগণ মনে করেন, তারপরে যে সরকারই এসেছে মোটামুটি একই ধরনের নীতিমালা অর্থাৎ মুক্ত বাজার অর্থনীতি বজায় রেখেছে। এরশাদ সরকারের শাসনামলের বাজেটকে ‘ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও আইএমএফ`র` কাঠামোগত সংস্কার কর্মসূচি প্রতিপালনের বাজেট’ বলে মনে করেন তারা।
এক অর্থনীতিবিদ বলেন,“সব ভর্তুকি প্রত্যাহার, সমস্ত কলকারখানা ব্যক্তিখাতে প্রত্যার্পন, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থা, বাংলাদেশের শিল্প ব্যাংকগুলো থেকে টাকা দিয়ে ব্যক্তিখাতগুলোকে কৃত্রিমভাবে দাঁড় করানো এবং মুহূর্তের মধ্যে কিছু লোক বেশ বড় টাকার মালিক হয়ে গেল। বাজেট বাড়লো। কিন্তু বাজেটের টাকা যোগাড় হয় না দেখে তখন বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরতা বেড়ে গেল”। তার মতে সেই সময়ে বিদেশ নির্ভর বাজেট ব্যবস্থা ছিল।সেই দাতা নির্ভর বাজেট থেকে বের হয়ে স্বাধীন বাজেট প্রণয়ন তখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কয়েক দশকের বাজেট পর্যালোচনা করলে বুঝতে পারা যায় যে বাংলাদেশে অবকাঠামো ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে মনোযোগ বেড়েছে। পাশাপাশি বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পও হাতে নিচ্ছে । “ ক্রমান্বয়ে একটা ঐক্যমত দেশের ভিতরে গড়ে উঠেছে – মানবসম্পদের দিকে নজর দিতে হবে। শিক্ষা স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে হবে।
“বর্তমান সরকারের সময়ে ভৌত অবকাঠামোর প্রতি প্রচুর জোর দেয়া হয়েছে। রাস্তাঘাট, সেতু ইত্যাদি এর সাথে বিদ্যুতের ওপরেও জোর দেয়া হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে যেটা হয়েছে কতগুলো বিষয়ে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক পরিকল্পনার ব্যাপারে ঐক্যমত বিরাজ করে”। বাংলাদেশ যে মানবসম্পদ উন্নয়নে জোর দিচ্ছে, খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি, কৃষির বহুবিধিকরণ, যান্ত্রিকীকরণ এসব বিষয়ে ঐক্যমত পোষণ করছে সরকারগুলো এটা একটা ইতিবাচক দিক বলে মনে করেন বিশিষ্ট একজন অর্থনীতিবিদ। তার মতে সাম্প্রতিককালে বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে একটা ধারাবাহিকতা বা গতানুগতিকতা লক্ষ্য করা যায়।
“দশ শতাংশ করে রাজস্ব বাড়বে, দশ শতাংশ করে খরচ বাড়বে। প্রত্যেক খাতে এটাকে দেয়া হবে। বড় বড় প্রকল্প কিছু থাকবে সেটাতে ৭০ শতাংশ চলে যাবে বাকি শতাংশ অন্যান্য প্রকল্পকে ভাগ করে দেব- এভাবে কাজগুলো হচ্ছে” বলে মন্তব্য করেন তিনি। র্অথনীতিবিদদের মতে বাজেট এখন অনেক বেশি নীতিভিত্তিক কাঠামোর মধ্য দিয়ে হচ্ছে। যেমন, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, এসডিজি অথবা সরকারের বিভিন্ন খাতভিত্তিক পরিকল্পনাকেও প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে৷ “বাজেট বড় হয়েছে, সক্ষমতার জায়গা অবশ্যই তৈরি হয়েছে - চাহিদার জায়গা সৃষ্টি হয়েছে অনেক জায়গায় কার্যক্রম চলছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রসারিত হয়েছে”। কিন্তু পঞ্চাশ বছর পর এসে বাজেট নিয়ে যে ‘এক্সপেক্টেশন’ তৈরি হয়েছে তা কতটা বাস্তবায়ন হচ্ছে তা নিয়েই প্রশ্ন বিশেষজ্ঞদের।“রাজস্বের ক্ষেত্রে বর্ধিত রাজস্ব কোথা থেকে আসবে? এটা কি প্রত্যক্ষ কর থেকে আসবে নাকি পরোক্ষ কর থেকে আসবে? যার দেওয়ার সামর্থ্য আছে সে দিবে নাকি যারা সামর্থ্য সীমিত তারা সকলেই ভ্যাট দিতে থাকবে?
একুশে সংবাদ/হ.ক.প্র/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :