‘শিক্ষা হইল প্রতিটি জাতির মেরুদণ্ড। জাতি যদি সকল দিক দিয়া আগাইয়া যাইতে চাহে, তাহা হইলে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হইবে শিক্ষাব্যবস্থার উপর। কারণ, যেই সকল দেশ উন্নয়নের উচ্চশিখরে উন্নীত হইয়াছে, বরাবরই শিক্ষা ছিল তাহাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের তালিকায়; কিন্তু দুঃখজনকভাবে শিক্ষাব্যবস্থায় কিছু ক্ষেত্রে আমরা কাঙ্ক্ষিত উন্নতি ঘটাইতে পারিতেছি না। দেশে উচ্চশিক্ষায় একধরনের টানাপড়েন সৃষ্টি হইয়াছে। বিশেষ করিয়া, কলেজ পর্যায়ে চলিতেছে চরম অচলাবস্থা। দেশের ৮৮০টি কলেজে শুধু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চলমান অনার্স বা স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষার্থী রহিয়াছেন প্রায় ৩০ লক্ষ। এই বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষা পড়িয়াছে শঙ্কার মুখে। নিয়মিত পাঠদান না হওয়া, শিক্ষার্থীপ্রতি মাথাপিছু বরাদ্দের অতি স্বল্প হার, শিক্ষকসংকট, শ্রেণিকক্ষের অপ্রতুলতা, গবেষণার অভাব, বিজ্ঞান বিষয়কে উপেক্ষা—প্রভৃতি কারণে কলেজসমূহ যেন ধুঁকিতেছে। সঠিক ব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতা যে এই সকল সমস্যার প্রধান কারণ, তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই। ইহার সহিত ব্যাবসায়িক মন-মানসিকতা হইতে বিভিন্ন কলেজে স্নাতক কোর্স শুরু করিবার কারণেও এই সকল সমস্যার সৃষ্টি হইতেছে বলিয়া জানা যায়। ’
‘একটি হিসাব অনুযায়ী, কলেজে স্নাতক পর্যায়ে একজন শিক্ষার্থীর পিছনে বাৎসরিক ব্যয় করা হয় ১ হাজার টাকারও নিচে। শিক্ষার্থীপ্রতি এই পরিমাণ বরাদ্দের কারণে ঐ শিক্ষার্থীর নিকট হইতে আমরা কী ‘প্রোডাক্টিভিটি’ আশা করিতে পারি? তাহা ছাড়া এই ক্ষেত্রে বৈষম্যের বিষয়টিও দৃশ্যমান। ইউজিসির তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজসমূহে শিক্ষার্থীপিছু ব্যয় ছিল মাত্র ৭৪৩ টাকা। অথচ অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে শিক্ষার্থীপিছু ব্যয় অধিক। যেমন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীপ্রতি বার্ষিক ব্যয় ১ লক্ষ ৮৫ হাজার ১২৪ টাকা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে তাহা আরো অধিক—২ লক্ষ ৯৮ হাজার ৬৬০ টাকা। এমনকি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও তাহা ছিল ৪৪ হাজার টাকা। সুতরাং, কলেজপড়ুয়াদের প্রতি এইরূপ ব্যয়ের চিত্র কি পক্ষপাতমূলক নহে?’
‘দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর গড় অনুপাত ১ :১৯। অর্থাৎ প্রতি ১৯ জন শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক রহিয়াছেন এক জন। পক্ষান্তরে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৯ জন শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক রহিয়াছেন গড়ে এক জন। তাহা ছাড়া অধিকাংশ কলেজে নাই পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ, গবেষণাগার ও গ্রন্থাগার। এই সকল কারণে শিক্ষার্থীরা মানসম্মত শিক্ষার সুযোগ হইতে বঞ্চিত হইতেছেন। আবার কলেজ পর্যায়ে মূল্যায়নব্যবস্থাও অতি দুর্বল। উত্তরপত্র মূল্যায়ন একক পরীক্ষকনির্ভর। উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে উত্তরপত্র মূল্যায়নে একাধিক পরীক্ষক থাকিবার কথা, যাহা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণও বটে। একটি গবেষণায় দেখা গিয়াছে, বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী কলেজ হইতে উচ্চশিক্ষায় ডিগ্রি লইয়াও বেকার থাকিতেছেন। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের একটি জরিপের তথ্য অনুযায়ী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজসমূহ হইতে পাশ করা শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশই বেকার থাকিতেছেন। এই সকল পরীক্ষার্থীর খাতা সঠিকভাবে মূল্যায়ন না করিবার কারণে তথা শিক্ষার্থীর গুণমানের বিচার-ব্যর্থতার কারণেই যে এইরকম ঘটিতেছে না, তাহা কে জানে?’
‘এখন প্রশ্ন হইল, ইহা হইতে উত্তরণের উপায় কী? কলেজে স্নাতক ডিগ্রি কোর্সকে পুনর্গঠন, উচ্চশিক্ষায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিশিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ, বাজারমুখী স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কোর্স এবং সময়ের সহিত তাল মিলাইয়া ইন্টার্নশিপ চালুকরণসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে হইবে। পরীক্ষা ও মূল্যায়নব্যবস্থা সংশোধনের পরিকল্পনাও বাস্তবায়ন করিতে হইবে। তাহা ছাড়া আমরা মনে করি, সার্বিকভাবে কলেজসমূহের অবস্থা যেই হেতু শোচনীয়, সেই হেতু যথেষ্টসংখ্যক শিক্ষক, শ্রেণিকক্ষ ও ল্যাবরেটরি ব্যতীত কলেজসমূহে ঢালাওভাবে অনার্স-মাস্টার্স কোর্স থাকা উচিত নহে। ইহাতে উচ্চশিক্ষার মারাত্মক ক্ষতি হইতেছে। ইহার বদলে সেখানে বিভিন্ন টেকনিক্যাল বিষয়ে ডিপ্লোমা কোর্সের ব্যবস্থা করা যাইতে পারে, যাহাতে চরম বেকারত্ব দূর হয়। মনে রাখিতে হইবে, দেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের মহাসময় অতিক্রম করিতেছে। এমন একটি সময়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উচ্চশিক্ষা হওয়া উচিত যৌক্তিক ও যুগোপযোগী। সরকারি কলেজ শিক্ষাব্যবস্থায় উদ্ভূত অচলাবস্থা নিরসনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনতিবিলম্বে নজর দিতে হইবে।’
একুশে সংবাদ/ই/এসএপি
আপনার মতামত লিখুন :