শীতের শুরুতেই বিশ্বের বিভিন্ন শীতলতম দেশ থেকে অতি শীত থেকে বাঁচতে এবং খাদ্য সংকটের কারণে হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে আশ্রয় নেয় আমাদের দেশে। এর মধ্যে সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলা অন্যতম।মৌলভীবাজার জেলায় কুলাউড়া উপজেলায় রয়েছে এশিয়ার বৃহত্তম হাওর হাকালুকি , শ্রীমঙ্গলের বাইক্কাবিল ,হাইল-হাওরসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে এই শীতকাল এলেই নতুন নতুন পরিযায়ী পাখি আমাদের হাওর অঞ্চলগুলোতে ঝাঁকে ঝাঁকে দেখা যায়। এরা বরফজমা হিমালয় এবং হিমালয়ের ওপাশ থেকে অত্যন্ত শীত থেকে বাঁচার জন্য আমাদের দেশে চলে আসে।
পাখি বিজ্ঞানীদের মতে, উপমহাদেশে প্রায় ২ হাজার ১০০ প্রজাতির পাখি আছে। এরমধ্যে প্রায় ৩শ প্রজাতির পাখি হিমালয় পেরিয়ে হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের দেশে চলে আসে। এসব পাখি হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত তিব্বতের লাদাখ থেকে সেন্ট্রাল এশিয়ান ইন্ডিয়ান ফ্লাইওয়ে দিয়ে প্রবেশ করে। শুধু ইউরোপ এবং এশিয়ায় ৬শ প্রজাতির অতিথি পাখি রয়েছে, যারা প্রচণ্ড শীতে চলে আসে।
ইংল্যান্ডের নর্থ হ্যামশেয়ার, সাইবেরিয়া, এন্টার্কটিকার তীব্র শীত থেকে বাঁচার জন্য অপেক্ষাকৃত উষ্ণ অঞ্চল আমাদের দেশে চলে আসে। শীতের পাখিদের মধ্যে বালিহাঁস, গিরিয়া হাঁস, সাদা মানিকজোড়, রাঙ্গামুরি, বড়গুলিন্দা, হট্টি টি, ডাহুক, কোড়া, বাটাং, পানকৌড়ি, বড় বক অতি পরিচিত নাম।ঋতুচক্রের পরিক্রমায় হেমন্তের পরেই আসে শীত। আর শীতের আগমনে দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ হাওর হাকালুকিসহ জেলার বিভিন্ন হাওর অঞ্চলগুলোতে আসতে শুরু করে নাম না জানা অসংখ্য অতিথি অর্থাৎ পরিযায়ী পাখি। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষাসহ প্রকৃতির সৌন্দর্য ও পরিবেশ রক্ষায় অত্যান্ত উপকারী বন্ধু এই পরিযায়ী পাখি। কিন্তু সেই নিরীহ পাখি হাওরাঞ্চলের পথে প্রান্তরে কিছু লোভী চোরা শিকারির শিকারে পরিণত হয়।শীতের সময় এলে চোরা-গুপ্তা পাখি শিকারীদের মধ্যে সাজ সাজ রব পড়ে যায়। শীত এলেই শিকারিরা ফাঁদ, জাল তৈরি করে প্রস্তুত থাকে শিকারের জন্য। বিভিন্ন উপায়ে তারা শিকার করে অতিথি পাখি। গ্রাম অঞ্চলে ধান ক্ষেতের পাশে ছোট খাল বা চড়ায় ছোট ডিঙি নৌকায় হ্যাচাক জাতীয় আলো জ্বালিয়ে আলোর ফাঁদে কোচ দিয়ে পাখি শিকার করতে দেখা যায়। কেউ কেউ মাছের ঘেরে ফাঁকা জায়গায় দেশি হাঁস পানির উপর জড়ো করে রাখে, পাখি হাঁসের ডাক শুনে পানিতে নামতে শুরু করে তখন পেতে রাখা ফাঁদে আটকে যায়। তবে অনেকে এখন পাখি শিকারের জন্য বিভিন্ন হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার করছে। মুক্ত ফাঁকা জলাশয়ে ফাঁদ পেতে তারা হর্ন বা বাঁশি বাজালে পাখি জলাশয়ে নামতে শুরু করে আর ঠিক তখনই শিকারির পাতা ফাঁদে আটকে যায়। এ ছাড়াও বড় বড় বাঁশ বাগান, গোলবাগান এবং হাইল-হাওর অঞ্চলগুলোতে রাতে পাখি বসে থাকলে এয়ার গান অথবা সুচালো শিক দিয়ে চোরা শিকারিরা পাখি শিকার করে থাকে।আবাসিক ও পরিযায়ী মিলে আমাদের দেশে পাখি প্রায় ৬৫০ প্রজাতির। এর মধ্যে ৩৬০ প্রজাতি আবাসিক। বাকি ৩০০ প্রজাতি পরিযায়ী। সব পরিযায়ী পাখি শীতের সময় আসে না। ৩০০ প্রজাতির মধ্যে ২৯০টি শীত মৌসুমে আসে ও ১০ টি প্রজাতি থেকে যায়। আন্তর্জাতিকভাবে জলচর পাখির জন্য স্বীকৃত ২৮টি জায়গা বাংলাদেশের সীমানায় রয়েছে।
এগুলো হলো—সিলেট অঞ্চলের বেশ কিছু হাওর, মৌলভীবাজারের হাইল-হাওর হাকালুকি হাওর,সম্প্রতি মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার হাকালুকি হাওরের জুড়ীর অংশে নাগুয়া ও চাতলার বিলে বিষটোপসহ শিকারিদের ফাঁদ তাদের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠেছে। সামান্য আয়ের লোভে মৌলভীবাজার জেলার হাকালুকি বাইক্কাবিলসহ বিভিন্ন স্থানে অতিথি পাখি শিকার করছেন অনেকেই। যার ফলে প্রতিবছরের মতো এবারও পরিযায়ী পাখিদের বিচরণ কমে গেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন শীতপ্রধান দেশ থেকে হাকালুকি হাওরে নানা প্রজাতির পাখি আসে। এসব পাখির মধ্যে রয়েছে বালিহাঁস, ভুতিহাঁস, গিরিয়াহাঁস, ল্যাঞ্জাহাঁস, গুটি ইগল, কাস্তেচরা, কুড়া ইগল, সরালি, পানভুলানি, কালিম, সাদা বক, কানি বক, পানকৌড়ি। এর মধ্যে দেশীয় প্রজাতির নানা জাতের পাখি রয়েছে। হাওরপাড়ে বসবাসকারী স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, হাকালুকি হাওরে অসাধু শিকারিরা বিষটোপ আর ফাঁদ পেতে পাখি শিকার করায় দিন দিন অতিথি পাখির আগমন কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে শীতে হাওরে অতিথি পাখি আসার সঙ্গে সঙ্গে পাখি শিকারিরা তৎপর হয়ে ওঠেন। সরেজমিন গত এক সপ্তাহ ধরে হাকালুকি বাইক্কাবিল,হাইল-হাওরসহ বিভিন্ন অঞ্চলগুলো ঘুরে হাকালুকির নাগুয়া বিলে ৪০ টি বাইক্কাবিল হাওরে ৩২ টি ,হাইল-হাওরে ২৬ টি পরিযায়ী পাখির মৃতদেহ দেখতে পাওয়া যায়।পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে স্থানীয়দের সাথে নিয়ে এ সময় মৃত পাখিগুলো মাটিচাপা দেন জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ফাউন্ডেশন-BCB র সদস্যরা। স্থানীয়রা জানান, শিকারিরা দলবেঁধে বিষটোপ ও জাল দিয়ে পরিযায়ী পাখি শিকার করে। তারা সেসব পাখি গোপনে চড়া দামে বিক্রি করে। হাকালুকি হাওরে অন্য বছরের তুলনায় এবার পাখির সংখ্যা তুলনামূলক কম বলে জানান স্থানীয়রা।
এদিকে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাকালুকি বাইক্কাবিল হাইল-হাওর থেকে শিকার করা এসব পরিযায়ী পাখি প্রতিজোড়া ১ হাজার থেকে ১৫শ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। অনেকে অগ্রিম অর্ডার দিয়েও রাখেন। এ কাজটা শিকারিরা খুবই সতর্কতার সঙ্গে করে থাকেন।নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাইল-হাওর অঞ্চলের এক বাসিন্দা জানান, বিষটোপ ব্যবহার করে প্রতিদিন কমপক্ষে কয়েক হাজার পাখি শুধু শ্রীমঙ্গলের হাইল-হাওরেই শিকার হয় । শিকার করা এসব পাখি সন্ধ্যায় গ্রাহকের বাড়িতে কৌশলে পৌঁছে দেয় শিকারিরা ।
পাখি শিকারিদের এমন তৎপরতা অত্যান্ত দুঃখজনক অমানবিক মন্তব্য করে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ফাউন্ডেশনের সভাপতি পাখি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত সাংবাদিক হৃদয় দেবনাথ বলেন, বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ অনুযায়ী পাখি নিধনের সর্বোচ্চ শাস্তি এক বছর জেল, ১ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডও হতে পারে। একই অপরাধ ফের করলে শাস্তি ও জরিমানা দ্বিগুণের বিধানও রয়েছে।
কোনো ব্যক্তি পরিযায়ী পাখির মাংস ও দেহের অংশ সংগ্রহ বা দখলে রাখলে অথবা বেচাকেনা করলে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড ও সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে । কিন্তু তবুও থামছেনা পাখি শিকারিদের এই অপ অপতৎপরতা ।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপার জাতীয় পরিষদ সদস্য আ স ম সালেহ সোহেল বলেন, এশিয়ার সর্ববৃহৎ হাকালুকি হাওর,বাইক্কাবিল ,হাইল-হাওর অঞ্চলে কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাবে অবাধে চলছে পাখি শিকার। পাখি শিকারিরা সবসময় তৎপর থাকলেও যথাযথ কর্তৃপক্ষ রয়েছে অন্ধকারে। পাখি শিকার বন্ধে বন বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় কোনোভাবেই থামছে না পাখি শিকার।
এ বিষয়ে বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ মৌলভীবাজারের রেঞ্জ কর্মকর্তা গোলাম ছারওয়ার জানান, এ এলাকায় যারা শিকারের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ ছাড়াও পাখি শিকার রোধে মানুষকে সচেতন করতে লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে।এশিয়ার বৃহত্তম হাওর মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলায় অবস্থিত। হাকালুকি হাওর দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মৌলভীবাজার ও সিলেটের পাঁচটি উপজেলার ১৮১ দশমিক ১৫ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত। এখানে ছোট-বড় ২৭৩টি বিল, ১০টি নদী ও অসংখ্য খাল রয়েছে। এই জলাভূমিতে পরিযায়ী পাখি শিকার সরকারের নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি একে ১৯৯৯ সালে পরিবেশগতভাবে সংকটপূর্ণ এলাকা (ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা করে সরকার।
লেখক : বৃক্ষ গবেষণা ও সংরক্ষণে জাতীয় পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক
রিপোর্টার :গাজী টেলিভিশন
একুশে সংবাদ/বিএইচ
আপনার মতামত লিখুন :