শহর কিংবা নগরায়নের নতুন মহামারি- শব্দ দূষণ।স্বাভাবিক বা সহনীয় শব্দের মাত্রা ৫৫ থেকে ৬০ ডেসিবেল।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ৬০ ডেসিবেলের অধিক শব্দ যদি দীর্ঘসময় ধরে থাকে তাহলে সাময়িক বধিরতা আর ১০০ ডেসিবেলের বেশি হলে স্থায়ী বধিরতা (Permament Deafness) হতে পারে। সারা বিশ্বে ৫ ভাগ মানুষ শব্দ দূষণের শিকার। ‘শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬’ হল একমাত্র আইনি হাতিয়ার, যা অনেক পুরনো এবং এতে অনেক আইনের ফাঁকফোকরও আছে। তবুও এটাই একমাত্র লিগ্যাল ইন্সট্রুমেন্ট।
এই বিধিমালা অনুযায়ী নীরব এলাকা, আবাসিক এলাকা, মিশ্র এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা, শিল্প এলাকা এরকম জায়গার ক্যাটাগরি অনুযায়ী দিন ও রাতের জন্য আলাদা আলাদাভাবে শব্দের ‘মানমাত্রা’ বা স্ট্যান্ডার্ড লেভেল নির্ধারণ করা আছে। তাতে দিনের উচ্চ শব্দ পরিবেশকে মারাত্মকভাবে দূষিত করে। এজন্য উচ্চ শব্দকে আমরা শব্দ দূষণ হিসেবে আখ্যায়িত করি।অসচেতনতার কারণে দিন দিন এ দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে। পরিবেশবাদীরা বাংলাদেশের শব্দদূষণকে ‘শব্দসন্ত্রাস’ নামে অভিহিত করেছেন। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলা এমনকি প্রান্তিক পর্যায়ে শব্দদূষণ যে পর্যায়ে অবস্থান করছে তা খুবই আশঙ্কাজনক।সাধারণ মানুষের মধ্যে শব্দ দূষণ সম্পর্কে সচেতন বৃদ্ধি করতে পারলেই এই শব্দসন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। প্রতিনিয়ত বাড়িতে, অফিসে, রাস্তাঘাটে আমরা শব্দদূষণের শিকার হচ্ছি।শব্দদূষণ এক ধরনের মারাত্মক পরিবেশ দূষণ। সমস্ত পৃথিবীর মানুষ আজ পরিবেশ দূষণ রোধে সোচ্চার। বর্তমান সময়ে বায়ুদূষণ-পানি দূষণ রোধ এবং বনায়নের বিষয়গুলো বিস্তরভাবে আলোচিত হলেও শব্দদূষণ এবং এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে আলোচনার গণ্ডি একেবারেই সীমিত। শব্দদূষণের ফলে মারাত্মক রকমের স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে, সে সম্পর্কে জনসাধারণের মাঝে সুস্পষ্ট ধারণা নেই। বেশ কয়েকটি বেসরকারি সংগঠন এ নিয়ে কাজ করলেও তা সমস্যার তুলনায় খুবই অপ্রতুল। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে আমাদের দেশে তেমন কোনো আইন নেই। ট্রাফিক আইনও যথাযথভাবে পালন হচ্ছে না। শব্দদূষণকে বলা হয় নীরব ঘাতক। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে জেলা উপজেলা পর্যায়ের শহরগুলোতে শব্দদূষণের বহু উৎস রয়েছে যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। গাড়ির হর্ন, নির্মাণকাজ, মাইকের ব্যবহার, শিল্প-কারখানা সর্ব ক্ষেত্রেই শব্দদূষণ বিষয়ে যেসব নিয়ম রয়েছে তা মানা হচ্ছে না।কিন্তু বাংলাদেশে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে যে বিধিমালা রয়েছে সেখানে বিস্তারিত বলা আছে কোন এলাকায়, দিনের কোন সময়ে, কোন ধরনের শব্দের মাত্রা কেমন হবে। এসব বিধিনিষেধ অমান্য করলে কঠোর শাস্তির বিধানও রয়েছে।
বিধিমালা অনুযায়ী আবাসিক এলাকায় রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত শব্দের মাত্রা ৪৫ ডেসিবেল এবং দিনের অন্য সময়ে ৫৫ ডেসিবেল অতিক্রম করতে পারবে না। বাণিজ্যিক এলাকায় তা যথাক্রমে ৬০ ও ৭০ ডেসিবেল। হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতের আশপাশে ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা রয়েছে। সেখানে রাতে ৪০ ও দিনে ৫০ ডেসিবেল শব্দমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া আছে। অথচ বেশিরভাগ শহরেই ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে দেখা যায় দিন নেই, রাত নেই পাইলিংয়ের কাজ, ইট ভাঙার যন্ত্র, সিমেন্ট মিক্সারের যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে। সময় সম্পর্কে কোনো বালাই নেই। বাংলাদেশে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের অধীনে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা রয়েছে। তাতে বলা আছে সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত নির্মাণকাজের এসব যন্ত্র চালানো যাবে না। আবাসিক এলাকার শেষ সীমানা থেকে ৫০০ মিটারের মধ্যে নির্মাণকাজের জন্য ইট বা পাথর ভাঙার মেশিন ব্যবহার করা যাবে না। বড় শহরগুলোয় মধ্যরাত এমনকি সারা রাত নির্মাণকাজ চলে। কারো ঘুমের ব্যাঘাত ঘটছে কিনা, শিশুদের পড়াশোনার ক্ষতি, অসুস্থ ও বয়স্ক ব্যক্তিদের কষ্ট কোনো কিছুই অসময়ে নির্মাণ কাজ এবং মাইকের অপব্যাবহার থামাতে পারে না। আবদ্ধ কোনো স্থানে শব্দ করলে শব্দ যাতে বাইরে না যায় তা নিশ্চিত করতে হবে। যদিও ভবনে নতুন কাজ, ড্রিল মেশিন, অফিসের ডেকোরেশনে নিয়মিতই ভঙ্গ হচ্ছে এসব নিয়ম।
মাইক ও লাউড স্পিকারের ব্যবহার: বাংলাদেশে মাইকের ব্যবহার খুবই অনিয়ন্ত্রিত।বেশ কয়েক বছর ধরে লাউড স্পিকারও ব্যবহার হচ্ছে। রাজনৈতিক সভা থেকে শুরু করে বিয়ে, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, পিকনিক সব ক্ষেত্রেই মাইকের কান ফাটানো শব্দ চলে। তবে আইনে শর্তসাপেক্ষে এর অনুমতিও রয়েছে। খোলা জায়গায় বিয়ে, খেলাধুলা, কনসার্ট ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রাজনৈতিক বা অন্য কোনো ধরনের সভা, মেলা, যাত্রাগান ইত্যাদির ক্ষেত্রে শব্দের মাত্রা অতিক্রম করে—এমন যন্ত্র ব্যবহার করা যাবে। তবে তার জন্য কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে, ৫ ঘণ্টার বেশি সময় এ শব্দ করা যাবে না এবং রাত ১০টার মধ্যে এসব অনুষ্ঠান অবশ্যই শেষ করে ফেলতে হবে। যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা করা হয় না। পিকনিকের ক্ষেত্রেও কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত স্থানে মাইক ও লাউড স্পিকার ব্যবহার করা যাবে। তবে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত। এছাড়া ফেরার পথে এগুলো বাজানো যাবে না। পিকনিক আয়োজন করতে হবে আবাসিক এলাকা থেকে অন্তত এক কিলোমিটার দূরে।
হর্ন বাজানো: অহেতুক হর্ন বাজানো একটি বাজে অভ্যাস এবং তা মারাত্মক শব্দ দূষণ তৈরী করে। একটি গাড়ির সামনে আরেকটি গাড়ি ধীরগতিতে চললে, মাত্রারিক্তভাবে হর্ন বাজানো হয়। যদিও বিধিমালায় বলা আছে, কোনো ধরনের মোটরযানে শব্দের মান অতিক্রমকারী হর্ন ব্যবহার করা যাবে না।কিন্তু কে শুনে কার কথা ।
নীরব এলাকায় হর্ন বাজানো নিষিদ্ধ। কিন্তু গাড়ির হর্নের অপব্যবহারে রীতিমতো ঢাকাসহ জেলা উপজেলা শহরের মানুষদের মধ্যে বধিরতার হার বাড়িয়ে দিয়েছে। কয়েক বছর আগে পরিবেশ অধিদপ্তরের এক জরিপে দেখা যায়, দেশের বিভাগীয় শহরগুলোয় শব্দের মাত্রা ১৩০ ডেসিবেল ছাড়িয়ে গেছে, যা স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে আড়াই থেকে তিন গুণ বেশি। আর শব্দের মাত্রা এখন তার থেকে একটুও কমেছে সেটা বলার কোনো উপায় নেই।
শাস্তির বিধান: আইন ভঙ্গ করলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা শব্দের উৎস যন্ত্রপাতি জব্দ করতে পারবেন। বিধিমালায় যেসব উল্লেখ করা রয়েছে তা পালনে ব্যর্থতাকে অপরাধ হিসেবে ধরা হবে। শব্দদূষণে দোষী হিসেবে প্রমাণিত হলে প্রথম অপরাধের জন্য এক মাসের কারাদণ্ড বা ৫ হাজার টাকা জরিমানা অথবা দুই ধরনের দণ্ডই প্রদান করার বিধান রয়েছে। দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড দেয়ার কথা বলা রয়েছে।আপনি শব্দদূষণের শিকার—এমন মনে হলে টেলিফোনে, লিখিত অথবা মৌখিকভাবে কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে প্রতিকার চাইতে পারেন।
শব্দদূষণ শরীরের যেসব ক্ষতি করে: লম্বা সময় অতিরিক্ত শব্দের মধ্যে থাকার কারণে হাইপার টেনশন, আলসার, হৃদরোগ, মাথাব্যথা, স্মরণশক্তি হ্রাস, স্নায়ুর সমস্যা ও মানসিক চাপ তৈরি হতে পারে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কান। অতিরিক্ত শব্দের মধ্যে দীর্ঘদিন কাটালে শ্রবণশক্তি ধীরে ধীরে কমে যাওয়া এমনকি বধির হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর অতিরিক্ত শব্দের কারণে কানের নার্ভ ও রিসেপ্টর সেলগুলো নষ্ট হয়ে যায়। ফলে মানুষ শ্রবণশক্তি হারাতে থাকে। কত ডেসিবেল শব্দে আপনি কতটুকু সময় কাটাচ্ছেন তার ওপর বিষয়টি নির্ভর করে। ১২০ ডেসিবেল শব্দ সঙ্গে সঙ্গেই কান নষ্ট করে দিতে পারে। প্রতিদিন ২ ঘণ্টা করে ৮৫ ডেসিবেল শব্দ যদি কোনো ব্যক্তির কানে প্রবেশ করে তাহলে ধীরে ধীরে শ্রবণশক্তি নষ্ট হবে। মানুষ সাধারণত ৩০-৪০ ডেসিবেল শব্দে কথা বলে। ৭০ ডেসিবেল পর্যন্ত মানুষের কান গ্রহণ করতে পারে। ৮০-এর ওপরে গেলেই ক্ষতি শুরু হয়। বছর কয়েক আগে পরিবেশ অধিদপ্তরের এক জরিপে উঠে এসেছে যে মাত্রাতিরিক্ত শব্দের কারণে এরই মধ্যে দেশের প্রায় ১২ শতাংশ মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস পেয়েছে। সম্প্রতি ‘ফ্রন্টিয়ারস ২০২২: নয়েজ, ব্লেজেস অ্যান্ড মিসম্যাচেস’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে ইউএনইপি। তাতে বিশ্বের ৬১ শহরের শব্দদূষণের মাত্রা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ঢাকায় শব্দের সর্বোচ্চ তীব্রতা ১১৯ ডেসিবেল এবং রাজশাহীতে এর মাত্রা ১০৩ ডেসিবেল পাওয়া গেছে। বিপরীতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ১৯৯৯ সালের গাইডলাইন বলছে, আবাসিক এলাকার জন্য শব্দের গ্রহণযোগ্য সর্বোচ্চ মাত্রা ৫৫ ডেসিবেল, বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডেসিবেল। ২০১৮ সালের সর্বশেষ হালনাগাদ গাইডলাইনে আবাসিক এলাকায় এ মাত্রা সর্বোচ্চ ৫৩ ডেসিবেলের মধ্যে সীমিত রাখার সুপারিশ করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত এ মাত্রা বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, ঢাকা ও রাজশাহীতে শব্দের তীব্রতা এ নির্ধারিত মাত্রার দ্বিগুণেরও বেশি।শব্দদূষণ রোধে যানবাহনের হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার বন্ধ ও বিভিন্ন উৎস থেকে উৎপন্ন হওয়া শব্দ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ঐক্যবদ্ধ কর্মপ্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে প্রাপ্ত দিকনির্দেশনা শব্দদূষণকে নিয়ন্ত্রণের পর্যায়ে নিয়ে যেতে সহায়ক হবে। এছাড়া হাজারো উপায় রয়েছে যা আমাদের সবুজ পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষমতা রাখে। এখন শুধু প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টার। আসুন, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আমরা একটি বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তুলি।
একুশে সংবাদ/ এস কে
আপনার মতামত লিখুন :