পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ বাঙালির প্রাণের উৎসব। দিনটি সকল বাঙালি জাতির ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণের দিন। এটি বাঙালিদের একটি সর্বজনীন লোকউৎসব হিসেবে বিবেচিত হলেও এইদিনে বাংলাদেশের আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষেরা পালন করে ভিন্ন ভিন্ন উৎসব। বিঝু-বৈসু-সাংগ্রাই-বিহু-বিষু-সাংক্রান আদিবাসীদের প্রাণের উৎসব।
পহেলা বৈশাখের দিনটি আদিবাসীরা বিভিন্ন আয়োজনের মাধ্যমে উদযাপন করে থাকে। কেমন হয়ে থাকে তাদের এই আয়োজন? তারা কিভাবে উদযাপন করে বর্ষবরণের এই দিনটি? এই দিনটি ঘিরে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাসের গল্প তুলে ধরছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আল-ফিকহ্ অ্যান্ড লিগ্যাল স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী আবির হোসেন।
বিঝু মানে সুখ-দূঃখ ভাগাভাগি করা
আমি ছায়া চাকমা। আমাদের চাকমা সম্প্রদায়ের প্রধান উৎসব হচ্ছে বিঝু। বিঝুর উদ্দেশ্য হচ্ছে পুরাতন বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে সাদরে গ্রহণ করা। বাংলা বছরের শেষ ২দিন এবং নববর্ষ নিয়ে মোট ৩দিন বিজু পালন করা হয়। প্রথম দিনকে বলা হয় ফুল বিঝু। এই দিনে সারা বছরের সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে গিয়ে নতুন বছরের জন্য সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রার্থনা নিয়ে নদীতে ফুল নিবেদন করা হয় এবং ফুল দিয়ে ঘর সাজানো হয়।
পরের দিন হচ্ছে মূল বিঝু। এই দিনে ঘরে ঘরে নানাবিধ খাদ্যের আয়োজন করা হয়। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘পাজন’, যা ৩২ প্রকার বা তারও অধিক উপকরণ দিয়ে বানানো হয়। এছাড়াও নানা ধরনের পিঠা, সেমাই প্রভৃতিরও আয়োজন করা হয়। এদিন ছেলে মেয়ে, যুবক-যুবতী, পাড়া-প্রতিবেশী একে অপরের বাড়িতে বিঝু খেতে যায় এবং নানা আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠে।
তৃতীয় দিন অর্থাৎ নববর্ষের দিন হচ্ছে গোজ্যপোজ্যা দিন। এই দিনে নতুন বছরের শুভ কামনায় বিহারে গিয়ে বুদ্ধের আশীর্বাদ গ্রহণ করা হয় এবং পাড়ার ছেলে-মেয়েরা বয়স্কদের স্নান করিয়ে দিয়ে আশীর্বাদ প্রার্থনা করে। এই আমাদের বিঝু এই আমাদের প্রধান উৎসব। বিঝু মানে আনন্দ, বিঝু মানে সুখ-দূঃখ ভাগাভাগি করা। বিঝু মানে দল বেঁধে ঘুরে বেড়ানো, বিঝু মানে মিলনমেলা। পরিশেষে সবাইকে বিঝুর অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
ছায়া চাকমা
শিক্ষার্থী, জীবপ্রযুক্তি ও জিন প্রকৌশল বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
বিঝু হচ্ছে আমাদের জাতির চিহ্ন
আমি মন্টু চাকমা, আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের তেরো ভাষাভাষী চৌদ্দটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে আমি একজন চাকমা সম্প্রদায়ের আদিবাসী। চাকমা সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় উৎসব হচ্ছে বিঝু। বাংলা বছরের চৈত্র মাসের শেষ দুইদিন ও নববর্ষ মিলে বিঝু উৎসব পালন করে থাকে। প্রথমদিনে ফুল বিঝু উৎসব পালন করা হয়।
ভোরবেলায় সূর্যোদয়ের সাথে সাথে নদীতে মা দেবি গঙ্গার উদ্দেশ্যে ফুল নিবেদন করা হয়। ফুল নিবেদনের উদ্দেশ্য হলো পুরোনো বছরের সব দূঃখ-কষ্ট পানিতে ভাসিয়ে দিয়ে নতুন বছরকে বরণ করে দেওয়া। সেদিন নানা রঙের ফুল দিয়ে বাড়িকে সাজানো হয়।
দ্বিতীয়দিন হচ্ছে মূল বিঝু। মূলবিঝু দিনে নানা রকমের তরকারি রান্না করা হয়। হরেক রকম তরকারির মধ্যে সবচেয়ে সুস্বাদু খাদ্য হচ্ছে ‘পাজন’। চাকমা সমাজে অনেকে বলে বিঝুর দিনে পাজন খেলে সারা বছর কোন রোগ-ব্যাধি হয়না। তাই সেদিন ঘরে ঘরে পাজন রান্না করা হয়। পাজন তরকারিতে ৩২ রকমের অধিক তরকারি মিশিয়ে রান্না করা হয়। সেদিন যুবক-যুবতীরা হইহুল্লোড় ও গান গেয়ে বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে বেড়ায়।
তৃতীয় দিন হচ্ছে গজ্জেপজ্জে দিন। গজ্জেপজ্জে দিনে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়। নতুন বছরের দিনগুলো যাতে ভালোমতো কেটে যায় সেজন্য সবাই মিলে বিহারে প্রার্থনা করতে যায়। সেদিন বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদেরকে গোসল করিয়ে আশীর্বাদ নেওয়া হয়।
এটি হচ্ছে আমাদের বিঝু। বিঝু হচ্ছে আমাদের জাতির চিহ্ন। বিঝু হচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি, বিঝু হচ্ছে আমাদের ঐতিহ্য। সবশেষে সবাইকে আমাদের বিঝুর শুভেচ্ছা।
মন্টু চাকমা
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
সাংগ্রাইং মারমা জনগোষ্ঠীর প্রাণের উৎসব
সাংগ্রাইং, সে তো এক আবেগঘন মূহুর্ত যার অনুভূতি আসলে লিখে প্রকাশ করার মতো নয়। ইংরেজি বর্ষের এপ্রিলের ১৪ তারিখ আমাদের সেই সুন্দরতম দিন। যেদিন সব মানুষের আনন্দ উচ্ছ্বাসের যেন শেষ নেই। সাংগ্রাইং চারদিনের উৎসব হলেও মানুষের মাঝে এর রেশ থেকে যায় অনেক দিন।
বৈচিত্র্যময় আয়োজনের মধ্যে প্রথম দিনে আমরা তরুণ-যুবারা সকল বৃদ্ধ বয়সীদের গোসল করানোর মাধ্যমে দিনটি শুরু করি। এরপর বিহারে গিয়ে সবাই বিহার পরিস্কার করি। এরপর বিহারে গিয়ে বিহার পরিষ্কার করি।
দ্বিতীয় দিনে সবাই বিহারে গিয়ে বুদ্ধ স্নান করে পঞ্চশীল গ্রহন করি এবং বিভিন্ন ধরনের পিঠা বানিয়ে তা অন্যদের মধ্যে দান করি। আর তৃতীয় দিনে আমাদের বিহানে ছোয়াইং (খাবার) দান করি। চতুর্থ দিনে সকলে মিলে ভান্তের পবিত্র সূত্র শুনে আমাদের এই ধর্মীয় উৎসব শেষ হয়।
তবে সাংগ্রাইংয়ে মূল আকর্ষণীয় অংশ হলো মৈত্রীময় পানি খেলা। যা মূলত তরুণ-তরুণীদের মধ্যে একে অপরকে পানি নিক্ষেপ করার মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়। এই পানি বর্ষণের মাধ্যমে আমরা বিশ্বাস করি পুরনো বছরে সকল ভুল-ভ্রান্তি, অন্যায় অপ্রাপ্তি, হতাশা ইত্যাদি ধুয়ে মুছে নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়া।
সাংগ্রাইংয়ে বুদ্ধ স্নানের পর থেকে শুরু হয় এই পানি বর্ষনের অনুষ্ঠান। সাংগ্রাইংকে নিয়ে প্রত্যেক বছর পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের বাঙালি-অবাঙালি সব ধরনের মানুষের আনন্দ-উচ্ছ্বাস আলাদা দৃষ্টি কাড়ে। প্রতি বছর এই দিনটির জন্য সব বয়সীদের মধ্যে যে আনন্দ-উচ্ছ্বাস সেটা সত্যিই দেখার মতো। সকলকে সাংগ্রাইংয়ের শুভেচ্ছা জানাই।
চাইন্দাওয়াং মারমা,
শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
সাংগ্রাই আমাদের একটি আনন্দের উৎসব
আমি নুমংসিং মারমা। সাংগ্রাই আমাদের একটি আনন্দের উৎসব। আমরা মৈত্রী ফুল দিয়ে মাহা সাংগ্রাই উৎসব উদযাপন করি। আমরা সবাই বিহারে গিয়ে মৈত্রী পানি সাহায্যে বুদ্ধ স্নান করি।
আর আমরা এ দিনে পঞ্চম শীল গ্রহণ করি। নানা ধরনের পিঠা বানিয়ে দান করি। পরিশেষে সবাইকে মৈত্রীময় শুভেচ্ছা জানাই।
নুমংসিং মারমা
শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
এইদিনে সকলের মঙ্গল কামনা করা হয়
আমি ফলিন্ত্র ত্রিপুরা। আমাদের ত্রিপুরা সমাজের সবথেকে বড় উৎসব হচ্ছ বৈসু। চৈত্র সংক্রান্তির শেষের দুইদিন বৈশাখ মাসে প্রথম দিন আমরা বৈসু উৎসব উযাপন করে থাকি। মূলত তিনদিন ধরে আমরা বৈসু উৎসব পালন করি। প্রথমদিনকে বলা হয় ‘বৈসু’। এরপরের দিন হলো বৈসুমা এবং তৃতীয় দিন তথা শেষদিনটাকে বলা হয় বিসিকাতাল।
ত্রিপুরা ছোট এবং বড়দের মধ্যে ভোরবেলায় ফুলগাছ থেকে কে আগে ফুল আনতে পারে তার প্রতিযোগিতা হয়। ফুল এনে বাড়িতে সাজানো হয় আর ফুলের মালা দিয়ে বাড়িতে পালন করা গরু-ছাগলের গলায় পরানো হয়।
বৈসু: এদিনে ত্রিপুরারা নদীর তীরে ফুল, ধূপ ও দ্বীপ দিয়ে গঙ্গাদেবীকে পূজা করে শ্রদ্ধা নিবেদন করে আগামী দিনের সুখ ও সমৃদ্ধি কামনা করা হয়।
বৈসুমা: এরপরের দিন হলো বৈসুমা। এই দিনটিকে খাদ্য উৎসব বলা হয়। এইদিনে প্রতিটি বাড়িতে পিঠা, সেমাই, পাচন ও মুলমুল আয়োজন করা হয়। ত্রিপুরা ছেলেমেয়েরা একত্র হয়ে পাড়া পাড়া ঘুরে প্রতিটি বাড়িতে পাচন ও সেমাই খায়।
বিসিকাতাল: এদিনে নতুন বছরকে বরণ করা হয়। পরিবারের ছোটরা বয়োজেষ্ঠদের পা ধুয়ে প্রণাম করে তাদের কাছ থেকে আশীর্বাদ নেয়।
বৈসু দিনটিকে আরও সুন্দর করে উপভোগ করার জন্য ত্রিপুরা ছেলেমেয়েরা ‘সুকুই’ খেলা আয়োজন করে আর গড়য়া নৃত্য করা হয়। ত্রিপুরারা প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে গিয়ে গড়য়া নৃত্য করে আসে এবং তাদের মঙ্গল কামনা করা হয় ।
ফলিন্দ্র ত্রিপুরা
শিক্ষার্থী, উন্নয়ন অধ্যায়ন বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
পানি দিয়ে পুরোনো দিনের সব গ্লানি ধুয়ে দেওয়া হয়
আমি সূচনা ত্রিপুরা। ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর প্রধান উৎসব বৈসু বা বৈসুক। এই দিনে মূলত আগামী দিনের সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা হয়। ত্রিপুরারা নদীর তীরে, মন্দিরে কিংবা বিশেষ পবিত্র স্থানে ফুল, ধুপ ও দ্বীপ জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে।
এদিন ছোটরা আগামী দিনের সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য রিনাই-রিসা, ধুতি পরে গ্রামে প্রত্যেক পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের পা ধুয়ে প্রণাম করে। এতে পরিবার তথা আত্মীয়তার বন্ধন আরও দৃঢ় হয়। কথিত আছে, ছোটদের তোলা ফুল বড়রা নিতে পারবে, কিন্তু বড়দের তোলা ফুল ছোটরা নিতে পারবে না।
এই দিন ফুল দিয়ে পুরো বাড়ি সাজানো হয়। এইদিন পুরোনো শত্রুতা, দ্বন্দ্ব, বিবাদ ভুলে পরস্পরের বাড়িতে হরেকরকম পিঠা, ফলমূল, মিষ্টান্ন সহ নানা ধরনের মুখরোচক খাবার পাঠানো হয়। গ্রামের সব মানুষ গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায় এবং পরস্পরের সঙ্গে কুশল বিনিময় করে।
এদিনের বিশেষ আয়োজন নাচ, গান, রং মাখা এবং পানি দিয়ে খেলা। যেটার প্রধান উদ্দেশ্য পানি দিয়ে পুরোনো দিনের সব গ্লানি ধুয়ে দেওয়া। পরিশেষে সবাইকে জানাই বৈসুর শুভেচ্ছা। ভালো থাকুন সবাই, সবার বৈসুক ভালো কাটুক।
সূচনা ত্রিপুরা
শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
উৎসবগুলো আমাদের স্বকীয়তার প্রমাণ দেয়
বিঝু-বৈসু-সাংগ্রাই-বিহু-বিষু-সাংক্রান আদিবাসীদের প্রাণের উৎসব। এই উৎসবগুলো মূলত পুরাতন বছরকে বিদায় দিয়ে নতুন বছরকে বরণ করার প্রত্যয়ে উদযাপন করা হয়ে থাকে। কাকতালীয়ভাবে বাংলা নববর্ষের দিন আদিবাসীদের এই উৎসবটি উদযাপিত হলেও বাংলা নববর্ষের সাথে এই উৎসবগুলোর কোন যোগসূত্র নেই।
এই দিনটি আদিবাসীরা তাদের স্ব স্ব রীতিনীতি অনুযায়ী পালন করে থাকে। এই দিনটি একেক জনগোষ্ঠীর কাছে একেক নামে পরিচিত। চাকমারা এই উৎসবটিকে বিঝু উৎসব হিসেবে পালন করে, মারমা রা সাংগ্রাই, ত্রিপুরারা বৈসু, অহমিয়ারা বিহু, তংচগ্যারা বিষু, ম্রোরা সাংক্রান। আদিবাসীদের সংস্কৃতি যেমন বৈচিত্র্যময় তেমনি আমাদের উৎসবগুলো বৈচিত্র্যময়।
এই উৎসবের মাধ্যমে আদিবাসীরা সারা বছরের সকল দুঃখ-কষ্ঠ, ভুল-ভ্রান্তি, দ্বন্দ্ব-সংঘাট ভুলে এই দিনটি উদযাপন করে থাকে। এই উৎসবগুলো আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি চর্চা করতে শেখায়। এই উৎসবগুলো আমাদের স্বকীয়তার প্রমাণ দেয়। আমাদের এই উৎসবগুলো ঠিকে থাকুক যুগ যুগান্তরে। ঠিকে থাকুক আমাদের ঐতিহ্য সংস্কৃতি। সবাইকে বিঝু-বৈসু-সাংগ্রাই-বিহু, বিষু-সাংক্রানের মৈত্রীময় শুভেচ্ছা।
মিলন জ্যোতি চাকমা
লোক প্রশাসন বিভাগ
শিক্ষাবর্ষ: ২০১৮-১৯।
একুশে সংবাদ/এসএপি
আপনার মতামত লিখুন :