শিশুশ্রমের ভয়াবহতা দিন দিন বাড়ছে। শিশু শ্রমিকদের প্রতি অমানবিক নির্যাতন প্রতিনিয়তই ঘটছে। বাংলাদেশে বাসাবাড়ি থেকে শুরু করে বিভিন্ন শিল্পকারখানাতেই শিশু শ্রমিক খুঁজে পাওয়া যায়। মূলত পেটের দায়ে এই শিশুরা কাজ করতে বাধ্য হয়। দরিদ্র জীবনে মা-বাবাও এ ক্ষেত্রে নিরুপায় হয়ে পড়ে। বয়সের চেয়ে কাজের ভার বেশি হওয়ায় বেশির ভাগ শিশুর জীবনই কর্মক্ষেত্রে অনিরাপদ হয়ে ওঠে। ঝুঁকিপূর্ণ অনেক কাজেই শিশুদের অঙ্গহানির ঘটনা প্রায়ই শোনা গেলেও এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধ করা যাচ্ছে না।
ছোট শিশু গৃহকর্মী কাজ করতে গিয়ে যদি প্লেট ভাঙ্গে সেই অপরাধে বাড়ির গৃহকর্তীর দ্বারা নির্মম নির্যাতিত হয়। হোটেলের শিশু ওয়েটারকে গ্লাস ভাঙার অপরাধে মালিকের নির্যাতন সহ্য করতে হয়। সব জায়গায়ই শিশু শ্রমিক কাজে ভুল করলে তাকে দেয়া হয় বেঁধে রেখে লোমহর্ষক নির্যাতন। এমনই বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত শিশুরা প্রতিনিয়ত কীভাবে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়, তা আমরা গণমাধ্যমে প্রায়শই দেখে থাকি।
৬ থেকে ৭ বছরের শিশুদের যে হাতে পড়ার বই থাকার কথা, জীবনের তাগিদে সেই হাতেই কাজের সরঞ্জাম তুলে নেয় এই কোমলমতি শিশুরা। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংস্থা শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও এখনো বিশ্বে বন্ধ হয়নি শিশুশ্রম। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শুধু আইন প্রণয়ন নয়, শিশুশ্রম বন্ধে প্রয়োজন সুষ্ঠু নীতিমালা ও বাস্তবায়ন।
এমন পরিস্থিতিতে শিশুশ্রম বন্ধের একমাত্র উপায় হলো দারিদ্র্য নিরসন। তবে যেকোনো দেশের দরিদ্র অবস্থা সহজেই পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। তাই দেশের দারিদ্র্যতা দূরীকরণের আগ পর্যন্ত শিশুশ্রম বন্ধে সরকারি ও বেসরকারিভাবে যৌথ উদ্যোগের প্রয়োজন। পাশাপাশি শিশুদের জন্য নিরাপদ কর্মঘণ্টা ও কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির প্রসারসহ সারাদেশে দরিদ্র শিশুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রম বন্ধ করতে হলে সরকারের দিক থেকে দৃঢ় পদক্ষেপসহ প্রয়োজন বাস্তবসম্মত কর্মপরিকল্পনা। সেই সঙ্গে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সর্বস্তরের মানুষের সমন্বিত অংশগ্রহণই পারবে বাংলাদেশকে শিশুশ্রম মুক্ত দেশে পরিণত করতে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ৬ হাজার ৭০ শিশু জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু এ নতুন শিশুর জন্য রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে কোনো বাজেট বরাদ্দ থাকে না। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রতিটি শিশু ৬০ হাজার টাকা ঘাটতি বাজেট নিয়ে বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করে।
পান্থপথ অফিস থেকে প্রতিদিনই তাদের গাড়িতে বাসায় ফিরি। কিন্তু হঠাৎ যদি কোনদিন জরুরী কাজে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হয় তখন টেম্পুতে ফার্মগেইট যাই। এরপর বাসে করে পল্লবীর বাসায় ফেরা। খুব খারাপ লাগে যখন দেখি চালক তো ছোট তার চেয়ে ছোট তার হেলপার। বেশকিছুদিন খেয়াল করলাম হেলপারদের বয়স খুব বেশি হলে ১১ থেকে ১২ বছর বয়স হবে। ঝুলে ঝুলে হাওয়ায় ভেসে হেলপাররা যাচ্ছে। খুব খারাপ লাগে এই বাচ্চা শিশুরা জীবনের তাগিদে কিভাবে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। যেই বয়সে ওদের বাবা মা’র আদরে ঘরে থাকার কথা সেই বয়সে তারা ক্ষুধার জ্বালা পেটাতে ব্যস্ত। একদিন একজনকে তার নাম জিজ্ঞেস করতে হাসি মুখে বলল, তুহিন। সে স্কুলে পড়ত। তার মা বাসা বাড়িতে ঝি’য়ের কাজ করেন। করোনাভাইরাসে সময় বাবা কাজ হারিয়ে ঘরে বসে আছেন। সংসারের বড় ছেলে হিসেবে সেই হাল ধরেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সরকার শিশুদের নিরাপত্তা ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য বদ্ধপরিকর। এ কারণে ঝুঁঁকিপূর্ণ কাজ থেকে তাদের সরিয়ে বৃত্তিমূলক কারিগরি প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। শিশুশ্রম রোধে এবং তাদের কল্যাণে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসার কার্যকরী ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। ১২ জুন বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষ্যে দেয়া এক বিশেষ বাণীতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকারের পাশাপাশি শিশুশ্রম-প্রতিরোধ ও তাদের কল্যাণে বেসরকারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা, উন্নয়ন-সহযোগী, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সিভিল-সোসাইটি ও গণমাধ্যম, মালিক ও শ্রমিক-সংগঠনসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। তাদের সবাইকে এক সাথে এগিয়ে আসতে হবে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘মুজিববর্ষের আহ্বান, শিশুশ্রমের অবসান’ অত্যন্ত সময়োপযোগী হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ১২ জুন যথাযথভাবে ‘বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস’ পালন করা হচ্ছে জেনে আনন্দিত। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তথা শিশুদের শিক্ষা, নিরাপত্তা ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে আমরা বদ্ধপরিকর। আমাদের সরকার জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ ও ঝুঁঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বিষয়ক আইএলও কনভেনশন অনুসমর্থন করেছে। শিশুশ্রম-নিরসনের লক্ষ্যে ‘জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি-২০১০’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ‘জাতীয় শিশুশ্রম কল্যাণ পরিষদ’ কাজ করছে। গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুদের অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি-২০১৫’ প্রণয়ন করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় শিশুশ্রম-নিরসনে বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা কমিটিগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাজ করে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত মোট ৮টি সেক্টরকে শিশু শ্রমমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। শিশুদের জন্য ঝুঁঁকিপূর্ণ ৩৮ ধরনের কাজ চিহ্নিত করে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এ তালিকা হালনাগাদ করার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ঝুঁঁকিপূর্ণ কাজে নিযুক্ত শিশুদের প্রত্যাহার করে বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা প্রদান করা হচ্ছে। তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে শিশু আইন প্রণয়ন ও প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেন। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার উন্নয়ন ও সুরক্ষার বিভিন্ন কার্যক্রমের সাথে জাতীয় শিশু নীতি-২০১১, শিশু আইন-২০১৩, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭ প্রণয়ন করেছে। এছাড়া জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শিশুদিবস উদযাপন, সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুদের পুনর্বাসন এবং বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুর বিকাশে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, শিক্ষার্থীদের বছরের শুরুতে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক প্রদান করা হচ্ছে। প্রায় শতভাগ শিশু স্কুলে যাচ্ছে। সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে ২০১৩ সালে শিশুশ্রম সমীক্ষায় শ্রমে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা হ্রাস পেয়ে ১.৭ মিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। শিশুশ্রম-নিরসনে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এসব কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নসহ সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশ থেকে শিশুশ্রম নিরসন সম্ভব।
সরকার তো শিশুশ্রম নির্মূল করতে বদ্ধপরিকর সেই সাথে আমাদেরও শিশুশ্রম নিরসনে সহযোগিতা হাত বাড়াতে হবে। প্রশিক্ষণ ও কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুদের সরিয়ে আনতে হলে সবাইকে আন্তরিক হয়ে কাজ করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত যেই শিশুরা কাজ করছে তাদের খুঁজে বের করে আনতে হবে। তাদের শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলেই দেশ আরও এগিয়ে যাবে।
আপনার মতামত লিখুন :