পৃথিবীতে মানুষের চলার পথটি সর্বদা কুসুমাস্তীর্ণ নয়। মানুষের চলার পথে আছে সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না।
যখন কোনো ব্যক্তি তার বিবেক, বুদ্ধিমত্তা বা বিচার বিবেচনা হারিয়ে ফেলে তখন সে নিজেকে হত্যা করে। নিজেকে হত্যা করাই আত্মহত্যা। আত্মহত্যা এক অর্থে আত্ম খুন-নিজেকে নিজে খুন করা। আত্মহত্যা বলতে এমন এক ধরনের মৃত্যুকে বুঝায়, যেখানে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় বা নিজের হাতে নিজের জীবন সংহার করে।
ফরাসি সমাজ বিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইম তার বিখ্যাত ‘The Suicide’ গ্রন্থে আত্মহত্যা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন, আধুনিক সমাজে বিভিন্ন সামাজিক সংহতির ভিত্তিতে আত্মহত্যা লক্ষ্য করা যায়। তার মতে, আত্মহত্যা কোনো ব্যক্তিগত, মানসিক, বংশগত, ভৌগোলিক বা দৈহিক কারণে ঘটে না বরং সামাজিক সংহতির মধ্যে নিহিত থাকে। তিনি মনে করেন, আত্মহত্যা হচ্ছে যান্ত্রিক সংহতির নেতিবাচক ফলশ্রুতি। ইদানিং প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মেধাবী শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা করার খবর শোনা যাচ্ছে। খবরগুলো বেশ উদ্বেগজনক। এমন মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। আত্মহত্যা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। নিজের জীবন হলেও আত্মহত্যার মাধ্যমে এ জীবন নষ্ট করার অধিকার কারও নেই। আত্মহত্যা করা এক ধরনের অপরাধ। এ ধরনের অপরাধকে ভিকটিমলেস ক্রাইম বলে চিহ্নিত করা হয়, যেখানে আত্মহত্যাকারী নিজেই অপরাধী ও ভিকটিম।
কোন ব্যক্তির স্বাধীন ইচ্ছা প্রকাশে বিঘ্ন সৃষ্টি হলে একদিকে যেমন সামাজিক সংহতি রক্ষায় বিঘ্ন ঘটে, অন্যদিকে তার মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ সামাজিক সংহতির ওপর আত্মহত্যা নির্ভরশীল। দুঃখ আক্রান্ত মানুষ যখন আত্মহত্যা করে তখন এটি ব্যক্তিগত বিষয় থাকে না। কেননা তার দুঃখবোধ সমাজ থেকেই সৃষ্টি হয়। আত্মহত্যা কোনো ব্যক্তিগত, মানসিক, বংশগত, ভৌগোলিক বা দৈহিক কারণে ঘটে না বরং সামাজিক সংহতির মধ্যে নিহিত থাকে। খুব আশ্চর্যের ব্যাপার হলো একজন কেন আত্মহত্যা করে এর সঠিক কারণ পুরোপুরি কখনই জানা যায় না।
নরসিংদীর পলাশে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে সাড়া না পেয়ে মারুফ মিয়া নামে এক যুবক আত্মহত্যা করে।
মঞ্জুরুল ইসলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ২০১৬-১৭ সেশনের শিক্ষার্থী। গোপালগঞ্জ থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকায় আসা। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে থাকতেন। ওই রুমে আট শিক্ষার্থীর বাস। একদিন বিকালে রুমের অন্যরা যখন বাইরে তখন মঞ্জুরুল সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ফাঁস দেন। মঞ্জুরুলের রুমমেটরা জানান, তিনি কিছুদিন ধরে অর্থনৈতিক সমস্যা ও হতাশায় ভুগছিলেন।
শুধু মঞ্জুরুল নয়, বিশ্বে প্রতিদিনই কোনো না কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে নারী-পুরুষ, কিশোর-কিশোরী, শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নেয়। দিশাহারা হয়ে পড়ে তাদের পরিবার।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের মানসিক উন্নয়নে কাজ করলে তাদের আত্মহত্যার পথ থেকে ফেরাতে পারে। নিয়মিত তাদের কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া খেয়াল রাখতে হবে তাদের পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনের দিকে। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে যুক্ত করতে হবে। সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হলে তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা কমবে। ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি, স্ট্রেস, প্যানিক, ফোবিয়া, মনোযৌন সমস্যাসহ বেশকিছু মানসিক সমস্যা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে খুব বেশি।
কাউন্সেলিংয়ের পাশাপাশি জীবনের খারাপ সময়গুলোকে খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষমতা, নিজের প্রতি শ্রদ্ধা ও আত্মবিশ্বাস, সমস্যা সমাধানের কার্যকর দক্ষতা এবং প্রয়োজনে অন্যের কাছ থেকে ইতিবাচক সহায়তা লাভের চেষ্টা- এগুলোকে আত্মহত্যার ক্ষেত্রে রক্ষাকারী বা প্রতিরোধী বিষয় হিসেবে গণ্য করা হয়। সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিনীতি, অনুশাসন, ভালো-মন্দ, প্রতিবেশী ও সহকর্মীদের সঙ্গে সামাজিক সুসম্পর্ক প্রভৃতিও আত্মহত্যার প্রবণতা হ্রাসে সহায়তা করে। আত্মহত্যা প্রতিরোধে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত মানুষের পাশে থাকা।
আত্মহত্যা কোনো ব্যক্তির অধিকার হতে পারে না। আত্মহত্যায় কোনো পৌরষত্ব বা বীরত্ব নেই, আছে কাপুরুষোচিত বর্বরতা আর অনৈতিক আত্মগ্লানির বহির্প্রকাশ। আত্মহত্যাকারীর স্বামী বা স্ত্রী, পিতা-মাতা, ছেলে-মেয়েসহ আত্মীয়স্বজনরা যে দুঃখ, ব্যথা, বেদনা, অশান্তি, হতাশা এবং কান্নার মধ্যে নিমজ্জিত হন তা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বহাল থাকে। বরং কখনোই তা শেষ হওয়ার মতো নয়। আত্মহত্যাকারীর জন্য আত্মীয়স্বজনকে কখনো কখনো সমাজে হেয়প্রতিপন্ন হতে হয়।
২০২৩ সালে এক বছরে আত্মহত্যা করেছেন ৫১৩ জন শিক্ষার্থী। যাদের মধ্যে ৬০ ভাগেরও বেশি নারী শিক্ষার্থী। আরো উদ্বেগের বিষয়, যারা আত্মহত্যা করেছেন তাদের মধ্যে ৪৪ ভাগেরও বেশি স্কুল শিক্ষার্থী। বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘আচঁল ফান্ডেশন’ তাদের এক জরিপে এই তথ্য প্রকাশ করেছে।
সংগঠনটি জানিয়েছে, আত্মহননকারীদের মধ্যে প্রায় ১০ ভাগ মানসিক সমস্যার কারণে এই পথ বেছে নিয়েছেন। আর জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যৌথ গবেষণা বলছে কিশোর-কিশোরীদের প্রায় ১৩ ভাগ মানসিক রোগে আক্রান্ত। আর দেশের তিন কোটি মানুষ মানসিক রোগাক্রান্ত।
আঁচল ফাউন্ডেশন তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৫১৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। তবে ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিলো ৫৩২ জন।
এই সংগঠন জানায়, নারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। আত্মহননের পথ বেছে নেয়াদের মধ্যে ৬০ দশমিক ২ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের তুলনায় স্কুলমুখী শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করেছে তারা। তার পরিমাণ ৪৪ দশমিক ২ শতাংশ।
২০২৩ সালে যে ৫১৩ জন আত্মহত্যা করেছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন ২২৭ জন স্কুল শিক্ষার্থী, ১৪০ জন কলেজ শিক্ষার্থী, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ৯৮ জন এবং ৪৮ জন মাদরাসা শিক্ষার্থী।
আত্মহননকারীদের মধ্যে সবার শীর্ষে রয়েছে ঢাকা বিভাগের নাম। এই বিভাগের অন্তত ১৪৯ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এরপর চট্টগ্রাম বিভাগের ৮৯, রাজশাহী বিভাগের ৭৭, খুলনা বিভাগের ৬৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তালিকার পঞ্চম স্থানে যৌথভাবে রয়েছে বরিশাল ও রংপুর বিভাগের নাম। আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪৩ জন। ময়মনসিংহ বিভাগে ৩৬ এবং সিলেট বিভাগের ১২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন।
সাধারণভাবে আত্মহত্যার কারণ হিসাবে অভিমান, প্রেম, মানসিক সমস্যা, পারিবারিক কলহ, পারিবারিক নির্যাতন, পড়ালেখার চাপ, পরীক্ষায় ভালো ফল করতে না পারা, যৌন হয়রানি ও অপমান বোধের মত বিষয়গুলো উঠে এসেছে আঁচলের প্রতিবেদনে। সংগঠনটি জানিয়েছে, ১৩-১৯ বছর বয়সি ৩৪১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন যা মোট আত্মহননকারীর ৬৬ দশমিক ৫ ভাগ।
আঁচল ফাউন্ডেশনের সভাপতি তানসেন রোজ বলেন, ২০২২ সালের সঙ্গে তুলনা করলে ২০২৩ সালে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সামান্য কম। চূড়ান্ত হতাশা থেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়ার পেছনে অর্থনৈতিক, পারিবারিক ও সামাজিক কারণ আছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের যে অস্থিরতা, যারা এসব নিতে পারেন না তারাই আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন বা পড়া শেষ করেছেন তাদের ওপর পরিবারের চাপ আছে চাকরি বা কর্মসংস্থানের, সমাজও তাদের নানা কথা বলে।
বাংলাদেশে এখন মোট জনগোষ্ঠীর ১৮ ভাগ মানসিক রোগে ভুগছেন। ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) এক গবেষণায় বলা হয়, ওই হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের ৪৮ দশমিক ৪ ভাগ মানসিক রোগী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগ ৩৪৭ জন রোগীর ওপর গবেষণা করে ওই তথ্য প্রকাশ করেছে। ওই রোগীদের মধ্যে ১৬৮ জন কোন না কোনোভাবে মানসিক রোগে ভুগছিলেন।
পোশাক কর্মী এবং তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ‘মনের বন্ধু` এর প্রতিষ্ঠাতা তৌহিদা শিরোপা বলেন, পোশাক কর্মীদের ২০ ভাগ নানা ধরনের মানসিক চাপ ও উদ্বেগের মধ্যে থাকেন। তারা মূলত তাদের পরিবার, সন্তান ও তাদের ভবিষ্যত নিয়ে চাপে থাকেন। তরুণদের মধ্যে যারা নারী, তাদের ৫০ ভাগ এবং পুরুষদের ৩০ ভাগ এখন মানসিক অস্থিরতার মুখে আছেন।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ২০০৫ ও ২০০৬ সালের গবেষণায় আমরা দেখেছি, তখন দেশের ১৬ শতাংশ মানুষ মানসিক রোগী ছিলেন। ২০১৮ সালে তা হয়েছে ১৮ শতাংশ। মানসিক রোগী বাড়ছে, তবে তার চেয়ে আত্মহত্যার হার বাড়ছে। এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা পৃথিবীতেই বাড়ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণাপত্রের তথ্য ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুারোর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৩২ জন মানুষ আত্মহত্যা করে। ২০১৬ সালে দেশে ৯ হাজারেরও কম আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছিল। ২০১৭ ও ২০১৮ সালে এ সংখ্যা ১০ হাজার ও ১১ হাজারের বেশি ছিল। ২০২২ সালে ৩৬৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৮ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে। দিন প্রতি ২ হাজার ১৯১ জন। প্রতি লাখে প্রায় ১৬ জন এবং প্রতি ৪০ সেকেন্ডে ১ জন। ইন্টারন্যাশনাল এসোসিয়েশন ফর সুইসাইড প্রিভেনশন (আইএএসপি) এর এক তথ্যগ্রাফিতে তুলে ধরা হয়েছে যে, বিশ্বব্যাপী আত্মহত্যার হার নারীদের চেয়ে পুরুষদের মধ্যে দ্বিগুণেরও বেশি এবং মোট আত্মহত্যাকারীদের অর্ধেকেরও বেশি (৫৮ শতাংশ) ৫০ বছর বয়সের আগে আত্মহত্যা করে থাকে। আত্মহত্যার প্রবণতার দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে দশম স্থানে রয়েছে।
সাধারণত আমরা দেখতে পাই, কোনো একটি বিশেষ প্রতিকূল অবস্থার সৃষ্টি হলেই পরিবারের অভ্যন্তরে নারীরা আত্মহত্যা করে। নিজের জীবন শেষ করে সমাধান করতে চায় বিষাদগ্রস্ত জীবনের। আমাদের সমাজে অনেক সময় স্বামীর সঙ্গে কলহ, ডিভোর্স, পরকীয়া ইত্যাদি কারণও অনেক নারীকে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত করে।
পৃথিবীর সব ধর্মেরই বিধানেই আছে আত্মহত্যা মহাপাপ। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা নিজেদের হত্যা করো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু এবং যে কেউ সীমা লঙ্ঘন করে অন্যায়ভাবে তা (আত্মহত্যা) করবে, তাকে অগ্নিতে দগ্ধ করব, এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ’ (সূরা আন-নিসা, আয়াত ২৯-৩০)। কুরআনে সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা ঘোষিত হয়েছে, ‘তোমরা নিজের হাতে নিজেদের জীবনকে ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ করো না (সূরা আল বাকারা, আয়াত: ১৯৫)।
আপনার মতামত লিখুন :