প্রতি বছরই দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে বজ্রপাত। ঋতু ভিত্তিক ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের রূপ পরিগ্রহ করেছে এই প্রাণঘাতী বজ্র-পতন। মার্চ মাস থেকে টানা চার মাস আতঙ্কজনক পরিস্থিতির আবর্ত তৈরি হয় হাওড়-বাওড়,ক্ষেত-খামার-উন্মুক্ত মাঠ-ঘাটে। প্রতি বছরই দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে বজ্রপাত। ঋতু ভিত্তিক ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের রূপ পরিগ্রহ করেছে এই প্রাণঘাতী বজ্র-পতন। দেশে বজ্রপাত শুরুর সময় ধরা হয় এপ্রিল মাসকে। আর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বজ্রপাত থাকলেও শুরুর তিন মাসকে ‘পিকটাইম’ হিসেবে গণ্য করেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন,বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে বজ্রপাতের মতো ঘটনা বাড়ছে। যা অস্থির বায়ুম্ললের ইঙ্গিত। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বজ্রপাতের পরিমাণও বাড়ছে। অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে গবেষণায় বলেছে,বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ৮৪ লাখ বজ্রপাত হচ্ছে। যার ৭০ শতাংশই হয় এপ্রিল থেকে জুন মাসে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দেশে বজ্রপাতের ঘটনা বছর বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে; বৃদ্ধি পাচ্ছে বজ্রপাতপ্রবণ এলাকার পরিধিও। দেশের যেসব অঞ্চলে আগে খুব একটা বজ্রপাত হতো না, এখন সেসব অঞ্চলে বজ্রপাত বেড়ে গেছে।
কীভাবে বজ্রপাত হয়?
বজ্রঝড় বা বজ্রসহ বৃষ্টিপাতের শুরুটা হয় বাতাসের আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে। বছরের নির্দিষ্ট কিছু সময় দিনের দৈর্ঘ্য বড় হয়। বেশি মাত্রায় সূর্যের তাপ ভূপৃষ্ঠে পড়ায় পৃথিবীপৃষ্ঠ উত্তপ্ত হয়। উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে বায়ুতে। উষ্ণ, আর্দ্র বায়ুর ঘনত্ব ঠাণ্ডা বাতাসের চেয়ে বেশি হওয়ায় দ্রুত ওপরে উঠে যায়। ঠাণ্ডা, শুষ্ক বাতাস পড়ে থাকে নিচে।
ওপরে ওঠার সময় বাতাসের জলীয়বাষ্প ধীরে ধীরে আরো ঠাণ্ডা হয়ে পরিণত হয় পানির ফোঁটায়। তৈরি হয় মেঘ। এই পানির কণাসমৃদ্ধ বাতাস দ্রুত তাপ ছাড়তে থাকে চারপাশে। ফলে, মেঘ ওপরে উঠতে থাকে। মেঘের আশপাশের অংশে শক্তিশালী ও উর্ধ্বমুখী বায়ুপ্রবাহ তৈরি হয়। এর প্রায় ৩০ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয় বিশাল বজ্রমেঘ।
মেঘের মধ্যে যত বেশি জলীয়বাষ্প ঘনীভূত হয়, ততই পানির ফোঁটাগুলো একটা আরেকটার সঙ্গে যুক্ত হয়ে বড় হতে থাকে। ওপরের অংশে তাপমাত্রা কম হওয়ায় সেখানে পানি আরো শীতল হয়। ফলে জমতে থাকে বরফকণা। বায়ুপ্রবাহের কারণে মেঘের অজস্র পানির কণা বরফের কণাগুলোর সঙ্গে ক্রমাগত ঘষা খেতে থাকে। মেঘের ঋণাত্মক চার্জ ভূ-পৃষ্ঠের ইলেকট্রনকেও আন্দোলিত করে।
কারা মারা যাচ্ছে-
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বজ্রপাতে যারা মারা যাচ্ছেন তাদের ৯৩ শতাংশ গ্রামের বাসিন্দা। তারা মূলত কৃষিকাজে যুক্ত। এক দশকে ৩ হাজার ৪ জনের মৃত্যু,গত আড়াই মাসে মৃত্যু হয়েছে ৯৮ জন। এর মধ্যে ২০১৪ সালে ১৭০, ২০১৫ সালে ২২৬, ২০১৬ সালে ৩৯১, ২০১৭ সালে ৩০৭, ২০১৮ সালে ৩৫৯, ২০১৯ সালে ১৯৮, ২০২০ সালে ২৫৫ এবং ২০২১ সালে ৩১৪ জন,২০২২ সালে ৩৪৬, জন ২০২৩ সালে ৩৪০ এবং ২০২৪ সালে গত আড়াই মাসে ৯৮ জন।
বজ্রপাত বা বজ্রঝড়ের সময় যদি বাইরে থাকেন, তবে ঝুঁকি এড়াতে নিচের বিষয়গুলো পালন করা বাধ্যতামূলক
ক. উঁচু স্থান অবশ্যই এড়াতে হবে বা নদী, পুকুর, খাল–বিল ইত্যাদির আশপাশে থাকা যাবে না।
খ. কোনো অবস্থাতেই ভূমিতে শোবেন না বা বিচ্ছিন্ন কোনো বড় গাছের নিচে দাঁড়াবেন না।
গ. বৈদ্যুতিক তারের বেড়া, ধাতব পদার্থ বা সংশ্লিষ্ট বস্তু (টাওয়ার) থেকে দূরে থাকুন। কেননা, ধাতব পদার্থের মাধ্যমে বজ্রপাত অনেক দূর পর্যন্ত চলাচল করতে পারে।
ঘ. পুকুর, নদী–নালা বা হ্রদে মাছ ধরা বা নৌকা ভ্রমণ যেকোনো উপায়ে পরিহার করতে হবে।
ঙ. অনেক মানুষ একসঙ্গে থাকলে (যেমন খেলার মাঠে) ছড়িয়ে–ছিটিয়ে যেতে হবে। বজ্রঝড়ের সময় মানুষ জড়ো অবস্থায় থাকলে অনেকজনের একসঙ্গে প্রাণহানির আশঙ্কা থাকে
সামনের দিনে মানুষ ও সম্পদের ঝুঁকি আরো বাড়বে। দেশে বজ্রপাতের মৌসুম চলছে। এমতাবস্থায় গণসচেতনতা বাড়ানো ছাড়া বায়ুমণ্ডলীয় এ দুর্যোগ থেকে মানুষকে রক্ষা করার পথ সামান্য। নতুবা বাংলার জনপ্রিয় প্রবাদ ‘বিনা মেঘে বজ্রপাত’–এর মতো ঝড় ও বজ্রপাত অনেকের জীবন ও জীবিকাকে বিপদাপন্ন করে তুলতে পারে।
বজ্রপাতে আহতদের চিকিৎসা-
বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় বজ্রপাত নিয়ে নানা ধরণের সতর্কবার্তা প্রচার করছে।
সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, বজ্রপাতে কেউ আহত হলে বৈদ্যুতিক শকে আহতদের মতো করেই চিকিৎসা করতে হবে।
বজ্রপাতে আহত ব্যক্তির শ্বাস-প্রশ্বাস এবং হৃৎস্পন্দন দ্রুত ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। কয়েক মিনিটের মধ্যে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করতে পারলে বাঁচানো সম্ভব হতে পারে। বেশি দেরি হলে আহত ব্যক্তির মৃত্যু হতে পারে।
চিকিৎসক তানভীর আহমেদ বলেন, "বজ্রপাতে আহত হলেও কিছু কিছু মানুষের হৃদপিণ্ড বন্ধ হয়ে তাৎক্ষনিকভাবেই মারা যায়। আবারো কারো-কারো হার্ট একটু বন্ধ হয়ে আবার চালু হয়। তাদের যখন হাসপাতালে আনা হয় তখন হয়তো আমরা কাউকে-কাউকে রক্ষা করতে পারি।"
চিকিৎসক তানভীর আহমেদ বলেন, যদি আহত ব্যক্তির হৃৎপিণ্ড সচল থাকে তাহলে তাকে সাথে সাথে সিপিআর দিতে হবে। সেজন্য সিপিআর সম্পর্কে জ্ঞান থাকা জরুরি।
সিপিআর দিয়ে হৃদপিণ্ড সচল রাখতে হবে। এর মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স বা কোন গাড়ি ডেকে দ্রুত আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে নিতে হবে। আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে নেবার ক্ষেত্রে বিলম্ব করা যাবে না।
তানভীর আহমেদ বলেন, বজ্রপাতে আহত ব্যক্তিকে ধরার ক্ষেত্রে কোন সমস্যা নেই। কারণ আহত কিংবা মৃত ব্যক্তির শরীরে বিদ্যুৎ থাকে না।
বেশী বজ্রপাত হয় যে সব এলাকায়-
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এমএ ফারুখের নেতৃত্বে এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় সুনামগঞ্জ এবং মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে। বজ্রপাত বেশী হচ্ছে: সুনামগঞ্জ,নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট,টাঙ্গাইল, জামালপুর, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, পাবনা, নওগাঁ, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, জামালপুর, গাইবান্ধায়। সুনামগঞ্জে বজ্রপাতে দেশের মোট প্রাণহানির ৪.৮২ শতাংশ ঘটে।
বিশেষজ্ঞ মতামত: অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড.আশরাফ দেওয়ান জানান,দেশে বছরে বজ্রপাত হয় ৮০ থেকে ১২০ দিন। যা বাড়ছে। উন্নত দেশগুলো আধুনিক প্রযুক্তি ও সচেতনতা তৈরির মাধ্যমে প্রাণহানি কমাতে পারলেও, তা সম্ভব হয়নি বাংলাদেশে। বিশ্বে মিনিটে বজ্রপাত হয় ৮০ লাখ বার। সবচেয়ে বেশি প্রকোপ ভেনেজুয়েলার মারাকাইবো হ্রদে।বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে? ৮৪ লাখ বজ্রপাত হয়। যার ৭০ শতাংশই এপ্রিল থেকে জুন মাসে।এ থেকে বাঁচার সবচেয়ে জনপ্রিয় মার্কিন পদ্ধতির নাম থার্টি সেকেন্ড টু থার্টি মিনিটস।
একুশে সংবাদ/চ.ট.প্র/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :