- সংরক্ষণের গলদে কার্যকারিতা হারাচ্ছে মান
- দাম বাড়িয়েই সংকট কাটাতে চান মালিকরা
- ঔষধ শিল্প প্রতিষ্ঠানের নেতারাও দাম বাড়ানোর পক্ষে
- ক্যাবের কিছু সুপারিশ
চলতি বছরের শুরু থেকে আবারো ওষুধের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। ২০ টাকার নাপা সিরাপ বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৪৫ টাকায়। ৪৫ টাকার সেকলোর পাতা কিনতে হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ টাকায়। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে অ্যান্টিবায়োটিক জাতীয় ওষুধের দাম। সেফথ্রি বা সেফিক্সিম জাতীয় ওষুধ পিসপ্রতি বেড়েছে ১০ টাকা করে। এমন পরিস্থিতিতে অন্যান্য খরচ কাটছাঁট করে চিকিৎসা খরচ চালাতে হচ্ছেন সাধারণ ভোক্তারা।
ব্যবসায়ীরা ওষুধের দাম বৃদ্ধির জন্য গত বছরের মতো এ বছরও ডলারের ঊর্ধ্বগামিতাকে দায়ী করছেন। তারা আরও বলছেন, সংকট কাটাতে ওষুধের দাম বাড়াতে হয়। না হলে বাজারে সম্ভাব্য ঘাটতি হতে পারে এবং ওষুধের গুণমান হ্রাস পেতে পারে। যদিও ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। সংরক্ষণের গলদে কার্যকারিতা হারাচ্ছে সব ধরনের ওষুধ। চলমান তীব্র তাপপ্রবাহে দোকানে নির্দেশিত তাপমাত্রায় ওষুধ সংরক্ষণ করাও অনেকক্ষেত্রে সম্ভব হচ্ছে না। এতে ওষুধের গুণগত মান কমে যাচ্ছে।
এদিকে, ফার্মাসিটিক্যাল কোম্পানিগুলোকে অনুমোদনবিহীন কাঁচামাল আমদানি বন্ধ এবং অনুমোদন ছাড়া বিদেশি ওষুধ বিক্রি বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। স্বাস্থ্য সচিব ও ঔষধ প্রশাসনের মহাপরিচালককে এই আদেশ বাস্তবায়নের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে অব্যাহতভাবে ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি রোধে কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন আদালত। গত সোমবার বিচারপতি মোস্তফা জামান ও বিচারপতি মোহাম্মদ আতাউল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ শুনানি শেষে আদেশ দেন।
উল্লেখ্য, এর আগে দুই সপ্তাহে ‘ওষুধের দাম বেড়েছে ৭ থেকে ১৪০ শতাংশ’ শিরোনামে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে হাইকোর্টে এ রিট আবেদন করেন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভোক্তা অভিযোগ নিষ্পত্তি জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব আলমগীর কবীর।
যেভাবে নির্ধারণ হয় ওষুধের মূল্য-
প্রাইস ফিক্সেশন পলিসি-১৯৯২ অনুযায়ী, অত্যাবশ্যকীয় তালিকাভুক্ত যেসব ওষুধের দাম নির্ধারণ করা নেই অথবা কোনো ওষুধের দাম সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি করতে চাইলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে আবেদন করতে হয়। এক্ষেত্রে ওষুধটির সক্রিয় ও সহযোগী উপাদান কেনার ইনভয়েস, বিল অব এন্ট্রি, কস্টিং শিট জমা দিতে হয়। এরপর অধিদফতরে থাকা রেকর্ড থেকে সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় উপাদানের গত ছয় মাসের দামের গড়ের (এইচএস কোড অনুযায়ী শুল্ক ও অন্যান্য খরচ ৮ শতাংশ ধরে) সঙ্গে পণ্যটির প্যাকিং উপকরণের দাম যোগ করে যে টাকা দাঁড়ায়, তাকে নির্ধারিত মার্কআপ দিয়ে গুণ করে দাম (ভ্যাট ছাড়া) নির্ধারণ করা হয়। অত্যাবশ্যকীয় তালিকাভুক্ত ওষুধের দাম নির্ধারণের সূত্র হচ্ছে- {কাঁচামালের দাম (সক্রিয়+নিষ্ক্রিয়) + প্যাকিং উপকরণের দাম} x মার্কআপ = এমআরপি (ভ্যাট ছাড়া)।
নির্ধারিত মার্কআপগুলো হচ্ছে- পুনরায় মোড়কজাত ওষুধের ক্ষেত্রে ১.৫০, মুখে খাওয়ার সব রকম ওষুধ (অ্যান্টিবায়োটিক ও জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ি ছাড়া) ও ট্রপিক্যাল প্রিপারেশনের ক্ষেত্রে ২.২৫, মুখে খাওয়ার সব অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের ক্ষেত্রে ২.৩০, স্টেরাইল ওষুধ ও জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ির ক্ষেত্রে ২.৮০, অ্যাসেপটিক প্রিপারেশনের ক্ষেত্রে ৩.৪০, স্টেরয়েড ও হরমোন জাতীয় ওষুধের ক্ষেত্রে ৩.৪০, অ্যান্টিভাইরাল, অ্যান্টিফাংগাল, অ্যান্টি-ইনফেকটিভ ওষুধের ক্ষেত্রে ২.৩০, সাসটেইন রিলিজ ট্যাবলেট বা ক্যাপসুলের ক্ষেত্রে ২.৮০ ও ডিসপারসিবল ট্যাবলেটের ক্ষেত্রে ৩.০০।
তালিকার বাইরের ওষুধের দাম যেভাবে নির্ধারণ করা হয়-
প্রাইস ফিক্সেশন পলিসি-১৯৯২ অনুযায়ী, অত্যাবশ্যকীয় তালিকার বাইরে থাকা ওষুধের মূল্য নির্দেশক মূল্য হিসেবে পরিচিত; যা ওষুধ কোম্পানি ইচ্ছেমতো নির্ধারণ করে। এসব ওষুধের ভ্যাট প্রদান করতে মূল্য সনদের জন্য নির্ধারিত ফরমেট অনুযায়ী ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরে আবেদন করতে হয়। মূল্য সনদের আবেদনের সঙ্গে প্রস্তাবিত মূল্য, বৈধ মেয়াদের অ্যানেক্সার, সক্রিয় উপাদানের অনুমোদিত ব্লকলিস্টের কপি, পুনর্নির্ধারণের ক্ষেত্রে আগে ইস্যু করা মূল্য সনদের কপি দিতে হয়। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর শুধু ভ্যাট প্রদানের জন্য মূল্য সনদ ইস্যু করে থাকে।
উল্লেখ্য, ওষুধ সংরক্ষণের বিষয়ে দোকানিদের নানা পরামর্শ দিয়ে গত বছরের মে মাসে চিঠি দেয় ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর। তবে তদারকি না থাকায় পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতি হয়নি। শুধু দোকানে নয়, সরকারি সংরক্ষণ ব্যবস্থায়ও অনেক ক্ষেত্রে নির্দেশনা মানা হচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন,
এসব কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। ৯০ শতাংশ ওষুধের মোড়কে ২০ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণের নির্দেশনা রয়েছে। চলমান তীব্র তাপপ্রবাহে বিভিন্ন স্থানে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলেও ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নীতিমালায় বলা হয়েছে, ১৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যে ওষুধ সংরক্ষণ ও পরিবহন করতে হবে। হিমাঙ্কের নিচে তাপমাত্রা প্রয়োজন– এমন ওষুধ মাইনাস ৪ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সংরক্ষণ করতে হবে। দেশে জাতীয় ওষুধ নীতিতেও ওষুধের দোকানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং রেফ্রিজারেটর থাকার বাধ্যবাধকতা আছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা না থাকলে ওষুধের দোকানের নিবন্ধন দেওয়ার বিধান নেই। তবে বাস্তবে বেশিরভাগ জায়গায় এ নিয়ম মানা হচ্ছে না।
ঔষধ প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে,
দেশে নিবন্ধিত ফার্মেসি ২ লাখ ৩২ হাজার ৫৩৫টি। এর মধ্যে ৫২৮টি দোকানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রয়েছে। এর বাইরে বেশিরভাগ দোকানে সঠিক তাপমাত্রায় ওষুধ সংরক্ষণ করা হচ্ছে না।
বাংলাদেশ সোসাইটি ফর ফার্মাসিউটিক্যাল প্রফেশনালসের (বিএসপিপি) ভাইস প্রেসিডেন্ট আনসারুল ইসলাম বলেন,
দীর্ঘ সময় ধরে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির কাছাকাছি থাকলে ওষুধের গুণগত মান কমে যায় বা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। অনেকক্ষেত্রে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই কার্যকারিতা কমে যায়। এই ওষুধ রোগ সারাতে পারে না। প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় ওষুধ উৎপাদন ও সংরক্ষণ করলেও ওষুধের দোকানিরা তা করছেন না। এগুলো তদারকির দায়িত্ব ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের। তবে জনবল কম থাকায় তারাও সঠিকভাবে তদারকি করতে পারে না। তাই স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. সাইয়েদুর রহমান বলেন, ওষুধের ক্ষেত্রে টানা ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রা ঝুঁকিপূর্ণ। দীর্ঘ সময় ধরে এমন তাপপ্রবাহ চলতে থাকলে ওষুধের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ ওষুধের ক্ষেত্রে তালিকা দেওয়া যেতে পারে। বিশেষ করে অ্যান্টিবায়োটিক, ইনসুলিন, টিকা সংরক্ষণ ক্রয় ও বিক্রয়ে সতর্ক হতে হবে।
ওষুধ বিশেষজ্ঞ ডা. এ বি এম ফারুখ বলেন,
দেশের ফার্মেসিগুলোতে ৯০ শতাংশ ওষুধ ঠান্ডা জায়গায় রাখা হচ্ছে না। আমরা বারবার বলে আসছি, ফার্মেসিগুলোতে যেন শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকে। তা না হলে দোকানির অজান্তেই ওষুধের মান নষ্ট হয়ে যায়। টিকা, ব্লাড প্রডাক্ট, বিভিন্ন ধরনের ডায়াগনস্টিক কিট বেশি ঠান্ডায় যেমন ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখতে হয়। এ বিষয়গুলো আমাদের দেশে মানা হচ্ছে না, অধিকাংশ দোকানে রেফ্রিজারেটর নেই। এভাবে চলতে থাকলে মহাবিপদ অপেক্ষা করছে।
ওষুধ শিল্প মালিকদের দাবি, ওষুধের দাম না বাড়ালে বাজারে ওষুধের সংকট দেখা দেয় এবং ওষুধের গুণগতমানে ঘাটতি হতে পারে। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের (বিএপিআই) সাধারণ সম্পাদক এসএম শফিউজ্জামান বলেন, ডলার প্রাইস দীর্ঘদিন ছিল ৮৪ টাকা। এখন সেটি হয়েছে ১৩০ টাকা। টাকা বেশি দিলেও ১০০ শতাংশ এলসি করা যায় না। সবদিক থেকে ঝামেলা। দাম বাড়াতে বললে সরকার আমাদের চাপ দেবে আবার বাজারে ওষুধ পাওয়া না গেলেও তারা চাপ দেবে।
তিনি আরো বলেন,
৬ মাস ধরে ডলারের দাম বেশি, যে কারণে বেশি দাম দিয়ে কাঁচামাল আনতে হচ্ছে। দাম বাড়ানোর বিষয়ে আমরা লিখিত কোনো প্রস্তাব দেইনি। মুখে মুখে বলেছি আমাদের অনেক বিপদ।
সাধারণ ভোক্তাদের কথা বিচেনায় না নিয়ে দাম বাড়ানোর পক্ষেই সাফাই গাইলেন ঔষধ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের নেতারা। তারা বলছেন, টাকার অবমূল্যায়ন, ডলার সংকট, জ্বালানি খরচ বৃদ্ধি ও বৈশ্বিক বাজারে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে গত এক বছরে উৎপাদন ব্যয় অন্তত ৩০ শতাংশ বেড়েছে। ওষুধের দাম বাড়ানো ছাড়া বিকল্প নেই।
ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, মোট ৩০৮টি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে অ্যালোপ্যাথি ওষুধ তৈরি করে আসছে। দেশে দেড় হাজারেরও বেশি জরুরি ওষুধের ২৭ হাজারেরও বেশি ব্র্যান্ডের ওষুধ উৎপাদন করা হয়। এর মধ্যে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকায় ওষুধ রয়েছে ২১৯টি। তার মধ্যে ১১৭টি ওষুধের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দেয় সরকার। অন্য সব ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করে উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো।
স্বাস্থ্য বিভাগের দাবি,
দেশের মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য তালিকাভুক্ত ১১৭টি ওষুধের দাম বাড়ানোর ক্ষমতা রয়েছে সরকারের হাতে। আর এই ক্ষমতাবলে সেগুলোর দাম বাড়ানো হয়। ঐ সময় জরুরি ব্যবহৃত ৫৩টি ওষুধের দাম পুনর্নির্ধারণ করা হয়।
সম্প্রতি সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, অধিক মুনাফার লোভে ৫৩টি ওষুধের বদলে অন্যান্য ওষুধেরও দাম বাড়িয়ে দিয়েছে ফার্মেসিগুলো। তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন ওষুধের বাড়তি দাম আদায় করলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।
তিনি বলেন, আমরা চাই না একটি রোগীও বিনা চিকিৎসায় মারা যাক। ওষুধ কিনতে না পেরে আরো অসুস্থ হোক। ডলারের ঊর্ধ্বমুখিতার কারণে কিছু ওষুধের দাম বেড়েছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু ব্যবসায়ীদের খেয়াল রাখতে হবে তা যেন সাধারণ মানুষের জন্য চাপ তৈরি না করে।
সোমবার রাজধানীর শাহবাগে ফার্মেসিতে কথা হয় বাচ্চার জন্য নাপা সিরাপ কিনতে আসা আকলিমা আক্তারের সঙ্গে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, শুধু ওষুধই নয়, সবকিছুর দাম ঊর্ধ্বমুখী। ওষুধ ছাড়া যে কোনো কিছুর দাম বাড়লে সেটা কম কেনা যায়, কিন্তু ওষুধের প্রয়োজনীয়তা কমাবো কীভাবে? শিশুর যদি জ্বর হয়, তাহলে নাপা সিরাপ খাওয়াতেই হয়।
এ নিয়ে ঐ ফার্মেসির বিক্রয়কর্মী রাজু জানান, আগে আমরা কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে এই সিরাপ কিনতাম ১৮ টাকায়। ক্রেতাদের কাছে তা বিক্রি করতাম ২০ টাকায়। কিন্তু আমাদেরই এখন কেনা পড়ছে ৩১ টাকা করে। যা আমরা ৩৫ থেকে ৪০ টাকা করে বিক্রি করছি। এখানে আমাদের করার কিছু নেই। আগে যে মূল্যে ওষুধ আমরা কোম্পানি থেকে কিনতাম, কয়েক মাসের ব্যবধানে তা দ্বিগুণ হয়ে গেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা তিনগুণ হয়ে গেছে। আমাদেরও দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে।
জানা গেছে,
বাজারে এক হাজার ৭০০ জেনেরিকের প্রায় ২০ হাজার ওষুধ রয়েছে। এর মধ্যে গেজেটভুক্ত ১১৭টি জেনেরিকের ৪১৭টি অত্যাবশকীয় ওষুধের দাম নির্ধারণ করে সরকার। অন্যগুলোর বিষয়ে মূল্য নির্ধারণের জন্য কোম্পানিগুলো ঔষধ প্রশাসনে দাখিল করে। ঔষধ প্রশাসন যাচাই-বাছাই শেষে অনুমোদন করে।
এ হিসাবে গেজেটভুক্ত মাত্র ৬.৮৮ শতাংশ ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। বাকি ৯৩.১১ শতাংশ ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণের সুযোগ কম। আর এ কারণে ওষুধের সামগ্রিক বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না বলে দাবি করেন সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এ নিয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের ভূমিকায় ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ রয়েছে বলে অভিযোগ করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য খাত পর্যবেক্ষকরা।
তারা বলছেন, একসময় দুইশ’র বেশি ওষুধের দাম নির্ধারণ করে দিত সরকার, এখন ঠিক করতে পারে মাত্র ১১৭টির। এক্ষেত্রে কিছু আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণের বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু খোদ ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরই আইন মানছে না।
১৯৮২ সালের ঔষধ (নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশের ১১(১) ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, সরকার অফিসিয়াল গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে ওষুধের দাম নির্ধারণ করতে পারবে। আইনের এই ধারা অমান্য করে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ওষুধের দাম বাড়িয়ে চলেছে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর। ২০২২ সালে এভাবে দুবার ওষুধের দাম বাড়িয়েছে সংস্থাটি। ঐ বছরের ২০ জুলাই ওষুধের দাম বাড়িয়ে প্রথম প্রজ্ঞাপনটি প্রকাশ করা হয়। সেই প্রজ্ঞাপনে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় বহুল ব্যবহৃত ২০টি জেনেরিকের ৫৩টি ব্র্যান্ডের ওষুধের দাম বাড়ানো হয়।
এগুলোর মধ্যে বিভিন্ন মাত্রার প্যারাসিটামলের দাম বাড়ানো হয় ৫০ থেকে শতভাগ। ৪০ টাকার অ্যামোক্সিসিলিনের দাম বাড়িয়ে করা হয় ৭০ টাকা এবং ২৪ টাকার ইনজেকশন হয়ে যায় ৫৫ টাকা। ফের ওষুধের দাম বাড়াতে দ্বিতীয় প্রজ্ঞাপনটি জারি করা হয় গত বছরের ৪ ডিসেম্বর। সেই প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ২৪টি ওষুধের দাম বাড়ায় ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর। শুধু তাই নয়, প্রজ্ঞাপন ডিসেম্বরে জারি করা হলেও মূল্য কার্যকর হয় আরো আগে, ২০ নভেম্বর থেকে।
গেজেট প্রকাশ না করে এভাবে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ঘোষণা দিয়ে ওষুধের দাম বাড়ানোটা বেআইনি বলে জানিয়েছে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।
ওষুধের মূল্য বৃদ্ধি সংক্রান্ত ১০টি অসঙ্গতি তুলে ধরে ক্যাব জানায়, দেশে উৎপাদিত এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবায় ব্যবহৃত ১১৭টি ওষুধের দাম নির্ধারণ করে সরকার। আইন অনুসারে প্রতিটি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই এই তালিকার ৬০টি ওষুধ উৎপাদন করতে হবে। কিন্তু বেশিরভাগ উৎপাদনকারীই এর মধ্যে অল্প কয়েকটি ওষুধ উৎপাদন করে। এই ১১৭টির বাইরে অন্য সব ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করে উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো, যা ১৯৮২ সালের ওষুধ (নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশের ১১(১) ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
ক্যাবের সুপারিশ-
ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরকে অনতিবিলম্বে বৃদ্ধি করা ওষুধের মূল্য সংশ্লিষ্ট পক্ষের প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত কমিটি দ্বারা রিভিউ করার দাবি জানিয়েছে ক্যাব। ঐ রিভিউ না হওয়া পর্যন্ত আইভি ফ্লুইড জাতীয় ওষুধসহ অন্যান্য ওষুধের কাঁচামাল ও অন্যান্য ওষুধ আমদানিতে মার্ক-আপ কমিয়ে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
আইভি ফ্লুইড জাতীয় ওষুধের মার্ক-আপ ছিল ৩ দশমিক ৪। মার্ক-আপ কমানো গেলে ওষুধের দাম কমে আসবে। আমদানিকৃত ওষুধে মার্ক-আপও কমাতে হবে। সরকারকে ভর্তুকি দিয়ে ওষুধের দাম বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান বলেন,
এক সময় দুই শতাধিক ওষুধের মূল্য নির্ধারণের দায়িত্ব ছিল ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের। এখন শুধু ১১৭টি ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করছে প্রতিষ্ঠানটি। এর বাইরের ওষুধগুলোর মূল্য নির্ধারণ অনেকটাই নির্ভর করে ওষুধ কোম্পানিগুলোর ওপর। এতে ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। আমরা চাই জেনেরিক নামের যে দুই শতাধিক ওষুধের মূল্য নির্ধারণের দায়িত্ব ঔষধ প্রশাসনের ছিল, তা পুনর্বহাল করা হোক।
তিনি বলেন, স্বাধীনতার আগে দেশে মাত্র ২ থেকে ৩ শতাংশ ওষুধ তৈরি হতো। এখন আমরা ৯৮ শতাংশ ওষুধই দেশে উৎপাদন করি। দেশে উৎপাদিত ১২৪টি ওষুধ রফতানিও হচ্ছে।
ওষুধের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ গণমাধ্যমে বলেন, অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের দাম এক পয়সাও বাড়ানো হয়নি। ১১৭টি ওষুধের দাম সরকার আগে যা ঠিক করে রেখেছিল, সেগুলো আমরা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছি। যেসব ওষুধ না খেলে মানুষ মারা যেতে পারে, সেই ১১৭টি ওষুধের দাম এক পয়সাও বাড়ানো হয়নি।
একুশে সংবাদ/ন.প্র/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :