আকর্ষণীয় এলইডি বা আগের চেয়ে আরও বেশি জীবন্ত টিভি স্ক্রিন কিংবা সূক্ষ্ম লেজার চিকিৎসা-এ সবকিছুই অনেক দিন ধরে বাস্তব। আর এই অতি সূক্ষ্ম আলো ও চার্জের বিতরণ সম্ভব হয়েছে যার মাধ্যমে, তার নাম কোয়ান্টাম ডটস। কোয়ান্টাম ডটস আবিষ্কার ও ন্যানোপ্রযুক্তিতে এর প্রায়োগিক সাফল্যের কারণে তিন বিজ্ঞানীকে এবার দেওয়া হয়েছে রসায়নে নোবেল পুরস্কার। কথা হলো, এই কোয়ান্টাম ডটস আসলে কী? কেনই–বা এটি এত গুরুত্বপূর্ণ? আলোচনায় ঢোকার আগে এর প্রয়োগক্ষেত্রগুলোর দিকে একটু তাকানো যাক।
টিউমার কোষ অপসারণ এক সময় বেশ ঝুঁকির বিষয় ছিল। কিন্তু এখন ছোটখাটো টিউমার অপসারণে আর বড় কোনো অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন পড়ে না। কিংবা বলা যেতে পারে কিডনির পাথর অপসারণের কথা। এসবই এখন লেজারের মাধ্যমে অপসারণ করা যাচ্ছে। আর এই সূক্ষ্ম চিকিৎসা সম্ভব করেছে যে প্রযুক্তি, তাই হলো ন্যানোপ্রযুক্তি, যার উন্নয়ন হয়েছে কোয়ান্টাম ডটসের আবিষ্কার ও এর অগ্রগতির মধ্য দিয়ে।
এই কোয়ান্টাম ডটকে এক কথায় বলা যায় মানুষের তৈরি ন্যানোক্রিস্টাল, যা বিশেষ আলোক ও ইলেকট্রনিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। অতিবেগুণী রশ্মির সান্নিধ্যে এলে এটি অনায়াসে আকৃতির ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন রং বিচ্ছুরণ ও ইলেকট্রন পরিবহন করতে পারে। ফলে এটি অতি ক্ষুদ্রকায় সেমিকন্ডাক্টর হিসেবে কাজ করে। এ কারণে এই সময়ের সোলার সেল থেকে শুরু করে নানা ধরনের কম্পোজিটে এটি ব্যবহার হচ্ছে। পাশাপাশি চিকিৎসার ক্ষেত্রে নানা ধরনের পরীক্ষায়, বিশেষত শরীরের অভ্যন্তরের ছবি তোলার কাজে এটি ব্যবহার হচ্ছে।
অতি ক্ষুদ্রকায় এই কণায় উপস্থিত কোয়ান্টাম বৈশিষ্ট্যই এর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার সবচেয়ে বড় কারণ। এই অর্ধপরিবাহী ন্যানোপার্টিকেলগুলো একই সঙ্গে ইলেকট্রন ও হোল (ইলেকট্রনের অনুপস্থিতি) বহন করে। এর ফলে সৃষ্ট শক্তির এই তারতম্য বা আদান–প্রদানের সক্ষমতাই একে বিভিন্ন রঙের আলোক পরিবহনে সক্ষম করে তোলে। কণার আকারের বদল হলে শক্তির ভারসাম্যেও বদল আসে, যা রঙের পরিবর্তনের জন্য দায়ী।
রসায়নের শিক্ষার্থী মাত্রই জানেন যে, পদার্থের ধর্ম তাতে উপস্থিত ইলেকট্রন সংখ্যা দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। ফলে কোনো পদার্থকে তার ধর্ম অক্ষুণ্ন রেখে যদি অতিমাত্রায় সংকুচিত করা যায়, তবে তা কোয়ান্টাম জগতে প্রবেশ করে। বিজ্ঞানীরা ঠিক এ কাজটিই করেছেন সাফল্যের সাথে, যাকে বলা হচ্ছে কোয়ান্টাম ডটস।
এ বিষয়ে রসায়নের নোবেল কমিটির প্রধান জোহান অ্যাকভিস্ট বলেন, কোয়ান্টাম ডটের বেশ কিছু অসাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বিশেষত আকারের ওপর নির্ভর করে তাদের ভিন্ন ভিন্ন রং আলাদা মাত্রা যোগ করেছে।
বহু আগে থেকেই অবশ্য পদার্থবিদদের ধারণা ছিল, কোয়ান্টাম দুনিয়ায় আকারের বৈচিত্র্য দিয়ে অনেক কিছু করা সম্ভব। কিন্তু তখন এটি অর্জন সম্ভব হয়নি। কিন্তু ১৯৮০-এর দশকে অ্যালেক্সেই একিমোভ রঙিন কাচে আকার-নির্ভরশীল কোয়ান্টাম প্রভাব তৈরিতে সক্ষম হন। মূলত কপার ক্লোরাইডের ন্যানোপার্টিকেল থেকেই উৎপন্ন হয় ওই রং। তবে রঙের বদলের পেছনে সংশ্লিষ্ট কণার আকার বড় কারণ হিসেবে কাজ করছে বলে সে সময় ব্যাখ্যা দেন একিমোভ।
এর কয়েক বছর পর লুইস ব্রাস প্রথম বিজ্ঞানী হিসেবে তরলে মুক্তভাবে ভাসমান কণায় কোয়ান্টাম–প্রভাবের প্রমাণ হাজির করেন। আর সর্বশেষ ১৯৯৩ সালে মোঙ্গি বাভেন্ডি প্রায় যথার্থ আকৃতির কোয়ান্টাম ডটসের রাসায়নিক উৎপাদনের সফল হন।
বর্তমানে কোয়ান্টাম ডটের হাজারটা ব্যবহার হচ্ছে। এর মধ্যে নিত্যকার ব্যবহারের মধ্যে সবার আগে উল্লেখ করা যেতে পারে কম্পিউটার ও টেলিভিশন স্ক্রিনের কথা, যা আগের তুলনায় অনেক বেশি সংবেদনশীল হয়েছে। এ ছাড়া এলইডি প্রযুক্তিতে এর ব্যাপক ব্যবহার হচ্ছে, যা জীববিজ্ঞানী, চিকিৎসকদের মতো পেশাদারদের জৈবিক টিস্যুর কলকবজা খুঁজতে সহায়তা করছে।
একুশে সংবাদ/আ.ভ.প্র/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :