কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশে শিখ নেতা হারদীপ সিং নিজ্জার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে জোর আলোচনা চলছে। সেই সঙ্গে এ নিয়ে কানাডা ও ভারত সরকারের সম্পর্কেও নজিরবিহীন টানাপোড়েন অব্যাহত রয়েছে। এর মধ্যেই কিভাবে হারদীপ সিং নিজ্জার হত্যা করা হয়েছিল তা সামনে এসেছে।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে হারদীপ সিং হত্যাকাণ্ডের সেই রোমহর্ষক ঘটনা উঠে এসেছে। প্রতিবেদন মতে, হারদীপকে হত্যা করতে সমন্বিত হামলা চালানো হয়েছিল। অংশ নিয়েছিল অন্তত ছয়জন। হত্যাকাণ্ডে দুটি গাড়ি ব্যবহার করা হয়। হামলাকারীরা হারদীপকে লক্ষ্য করে ৫০টি গুলি ছোঁড়ে। যার মধ্যে ৩৪টিই তার শরীর বিদ্ধ করেছিল।
চলতি বছরের ১৮ জুন কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় গুরু নানক শিখ গুরুদুয়ারার বাইরে হারদীপকে গুলি করে হত্যা করা হয়। স্থানীয় শিখ সম্প্রদায়ের লোকজনের বরাত দিয়ে ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছে, হত্যা নিয়ে তদন্তকারীরা তাদের খুব কম তথ্য দিয়েছেন।
ঘটনাস্থলে পুলিশও গিয়েছিল দেরিতে। আর ওই গুরুদুয়ারার কাছের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক ও বাসিন্দারা জানিয়েছেন, হত্যাকাণ্ড নিয়ে বক্তব্য শুনতে বা সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ নিতে তদন্তকারীরা তাদের কাছে যাননি।
হারদীপ হত্যার প্রায় চার মাস পর গত সপ্তাহে এ নিয়ে কানাডার পার্লামেন্টে বিস্ফোরক মন্তব্য করেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। তিনি বলেন, এই হত্যায় ভারতের হাত রয়েছে। এটা পক্ষে ‘বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ’ও পেয়েছেন তিনি। সেই সঙ্গে দেশটিতে অবস্থান করা ভারতীয় গোয়েন্দা স্টেশনের প্রধানকে বহিষ্কার করেন।
হারদীপ হত্যা নিয়ে কানাডার অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে ভারত। একে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে আখ্যা দেয় দেশটি। সেই সঙ্গে ইটের বদলে পাটকেল হিসেবে কানাডার কূটনীতিক বহিষ্কার করে। পাল্টাপাল্টি কূটনীতিক বহিষ্কারের পর নাগরিকদের ভারত ভ্রমণে সতর্কতা অবলম্বন করতে বলে কানাডা। বিপরীতে ভারতও তাদের নাগরিকদের কানাডা ভ্রমণে সতর্কতা জারি করে।
যে শিখ মন্দিরের বাইরে ৪৫ বছর বয়সী হারদীপ হত্যার শিকার হন, ওই মন্দিরের সভাপতি ছিলেন তিনি। ভারতে শিখদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের দাবিতে খালিস্তান আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন তিনি। হত্যার ঘটনা ধরা পড়েছে ওই মন্দিরে স্থাপন করা একটি সিসিটিভি ক্যামেরায়।
৯০ সেকেন্ডের ওই ভিডিও তদন্তকারীদেরকেও দেয়া হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, হারদীপের একটি ধূসর পিকআপ ভ্যান মন্দিরের কাছে পার্কিং থেকে বের হচ্ছে। এ সময় সাদা একটি গাড়িও কাছাকাছি দেখা যায়। পরে সেটি হারদীপের পিকআপের পাশাপাশি চলতে থাকে।
মন্দিরের এক স্বেচ্ছাসেবক ভূপেন্দরজিৎ সিং হত্যাকাণ্ডের সময় কাছেই একটি পার্কে ফুটবল খেলছিলেন। গুলির শব্দ শুনে প্রথমে আতশবাজির শব্দ বলে মনে করেন তিনি। পিকআপটি পার্কিং থেকে বের হওয়ার সময় সাদা গাড়িটি সেটির সামনে এসে পথরোধ করে দাঁড়ায়।
এ সময় কাছের একটি জায়গা থেকে বেরিয়ে দুজন পিকআপটির দিকে যান। তারা মাথা ঢাকা পোশাক পরে ছিলেন। পিকআপের চালকের আসনের দিকে বন্দুক তাক করেন তারা। এরপর পার্কিং থেকে সাদা গাড়িটি বের হয়ে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যায়। বন্দুকধারী দুজনও একই দিকে দৌড়ে যান।
হারদীপকে হত্যার পর প্রথম তার পিকআপের কাছে পৌঁছেছিলেন ভূপেন্দরজিৎ। তিনি বলেন, গাড়ির কাছে গিয়েই তিনি চালকের পাশের দরজা খোলেন। সেখানে হারদীপ ছিলেন। তিনি তার কাঁধে হাত দেন। বুঝতে পারেন যে তিনি আর শ্বাস নিচ্ছেন না।
ভূপেন্দরজিৎ আরও সিং বলেন, চারপাশে রক্ত ও ভাঙা কাচ পড়ে ছিল। মেঝেতে গুলি ছড়িয়ে–ছিটিয়ে ছিল। এর পরপরই গুরমিত সিং নামে মন্দিরের আরেক নেতা পিকআপ নিয়ে সেখানে আসেন। ভূপেন্দরজিৎ ওই পিকআপে ওঠার পর তারা বন্দুকধারীদের ধরতে বেরিয়ে পড়েন।
সম্প্রতি হারদীপের পিকআপের চাকায় অবস্থান শনাক্তের যন্ত্র (ট্র্যাকার) খুঁজে পাওয়া গেছে বলে জানান ব্রিটিশ কলাম্বিয়া শিখ গুরুদুয়ারা কাউন্সিলের মুখপাত্র মনিন্দর সিং।
মন্দিরের কমিটির আরেক সদস্যের নাম মালকিত সিং। হারদীপকে হত্যার সময় তিনিও ফুটবল খেলছিলেন। মাথা ঢাকা পোশাক পরা দুজনকে কাছের কুগার ক্রিক পার্কের দিকে দৌড়ে যেতে দেখেছিলেন তিনি। ওই দুজনকে তাড়া করেছিলেন মালকিত। তবে তাদের চিনতে পারেননি।
মালকিত সিং বলেন, দুজনকে দেখে শিখ বলেই মনে হয়েছে তার। একজনের উচ্চতা পাঁচ ফুটের সামান্য বেশি ও স্থূলকায়। দ্রুত দৌড়াতে কষ্ট হচ্ছিল তার। আরেকজন ছিলেন প্রথমজনের চেয়ে প্রায় চার ইঞ্চি লম্বা ও রোগা-পাতলা। দৌড়ে গিয়ে তারা একটি রুপালি গাড়িতে ওঠেন। ওই গাড়িতে আরও তিনজন অপেক্ষা করছিলেন। তাদের কারও চেহারা দেখতে পাননি তিনি। এরপর গাড়িটি সেখান থেকে চলে যায়।
হত্যার ঘটনাটি তদন্ত করছে দ্য রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ (আরসিএমপি)। তারা জানিয়েছে, ১৮ জুন রাত ৮টা ২৭ মিনিটে প্রথম হরদীপকে হত্যার খবর পায় পুলিশ। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, গুলি চলার পর ঘটনাস্থলে পুলিশের আসতে ১২ থেকে ২০ মিনিট সময় লেগেছিল। এটি অবাক করার বিষয়। কারণ এই এলাকায় অনেক পুলিশ সদস্য নিয়মিত টহল দেন।
এদিকে খালিস্তান আন্দোলনের নেতা হরদীপের হত্যাকাণ্ড নিয়ে কানাডার অভিযোগের জবাবে ভারতের অসন্তুষ্টির স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। মঙ্গলবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশনে দেয়া ভাষণে এ বিষয়ে কথা বলেন তিনি।
জয়শঙ্কর জানান, রাজনৈতিক স্বার্থে কখনো সন্ত্রাসবাদ, সহিংসতা ও উগ্রপন্থাকে সমর্থন করা উচিত নয়। এমনকি আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার পাশাপাশি কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী ব্যবহার করা উচিত নয় বলেও জানান তিনি। ভাষণে কোনো দেশের নাম উল্লেখ না করলেও কানাডাকে ইঙ্গিত করেই তিনি এ কথা বলেন বলে জানায় গণমাধ্যম।
একুশে সংবাদ/স.ট.প্র/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :