মাত্র কয়েক মিলিটার দীর্ঘ হলেও অন্যতম আক্রমণাত্মক প্রজাতির পোকা হিসেবে পরিচিত রেড ফায়ার অ্যান্ট অথবা আগুন পিঁপড়া। সম্প্রতি ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছে এরা। গবেষকদের দাবি, এই পিঁপড়া ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে কৃষিক্ষেত্রে বড় ধরনের ক্ষতি হবে।
কৃষিবিজ্ঞানী ফার্দিনান্দো কালদারেলা ইতালির সিসিলির সাইরাকিউজ অঞ্চলে আগুন পিঁপড়ার বংশবিস্তার পর্যবেক্ষণ করছেন। তিনি বলেন, এরা এরই মধ্যে ইতালিতে ছড়িয়ে পড়েছে৷ এই পিঁপড়া গাছের নিচের শিকড় খেয়ে নেয় ও চাষের জন্য উপকারী পোকামাকড়ও মেরে ফেলে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এই পিঁপড়াকে আক্রমণাত্মক প্রজাতির লাল তালিকার শীর্ষে রেখেছে। এর আগে ভাবা হতো ইউরোপের মাটিতে এমন পোকা থাকতে পারে না। তবে গত বছরের হেমন্তে বিজ্ঞানীরা এর সন্ধান পেয়ে চমকে উঠেছিলেন। সিসিলির সাইরাকিউজ অঞ্চলে সেই পিঁপড়া প্রথম চোখে পড়েছিল।
তার এক বছর আগেই ফার্দিনান্দো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু সেসময় কেউ তার কথায় কান দেয়নি। ফার্দিনান্দো বলেন, এই পিঁপড়া বেশ বড়। সেই প্রজাতির সম্প্রসারণ প্রতিরোধ করতে অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল। কারণ ব্রাজিল, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ কোটি কোটি ডলার ব্যয় করেও এই পিঁপড়ার বংশবিস্তার প্রতিরোধ করতে পারেনি। আর এর ফলে কৃষিক্ষেত্রে মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।
জানা যায়, এই প্রজাতির পিঁপড়ার আদি নিবাস ব্রাজিল। সেই পোকা কীভাবে ও ঠিক কবে যে সিসিলিতে পৌঁছালো, তা এখনো জানা যায়নি। ফার্দিনান্দো মনে করিয়ে দেন, এখন পর্যন্ত এই পিঁপড়ার হামলা নিয়ে হইচই হচ্ছে না। তেমন বড় ক্ষতিও হয়নি। কিন্তু পিঁপড়ার বাসার সংখ্যা মারাত্মক হারে বেড়ে গেলে শস্য, ফল ও শাক-সবজির চাষে বিশাল ক্ষতি হবে। বিশেষ করে যেসব এলাকায় মাটিতে পানি দেওয়া হয়, সেখানে এই পিঁপড়া স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। যেমন খেলার মাঠ বা ব্যক্তিগত বাগান।
সিসিলিতে এই পিঁপড়ার কামড় প্রথম খেয়েছিলেন কারমেন কারুসো। তখনই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এটা মোটেই স্থানীয় প্রজাতির নয়। এই পিঁপড়ার আক্রমণে তার গোলাপের বাগান নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সেই নেতিবাচক অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে কারমেন বলেন, গোলাপপ্রেমি হিসেবে এটা আমার কাছে মারাত্মক অভিজ্ঞতা। অনেক ভালোবাসা দিয়ে গোলাপের বাগানটা গড়ে তুলেছিলাম। যখন দেখি, এই পিঁপড়া আমার সাধের বাগানটা নষ্ট করে দিচ্ছে, তখন মনে হয় তারা যেন আমাকেই মেরে ফেলছে। আমি এখনো জানি না যে কীভাবে এই পিঁপড়ার আক্রমণ ঠেকাবো।
সিসিলির আঞ্চলিক প্রশাসনও এই পিঁপড়া নির্মূল করতে চায়। সম্প্রতি স্থানীয় বন কর্মকর্তা জানলুকা ফেরলিতোকে বিশেষ কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছে। তিনি সার্দিনিয়া থেকে একটি যন্ত্র আনিয়েছেন। সেটির মধ্যে একটি পাম্প ১৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার বাতাস পিঁপড়ার বাসার মধ্যে চালনা করা হয়।
প্রথম পরীক্ষা চালানোর প্রায় ছয় সপ্তাহ পর জায়গাটি পরীক্ষা করা হয়। ভালো করে দেখেশুনে জানলুকা বলেন, গরম বাতাস চালনা করার পর সেখানে মাত্র একটা পিঁপড়া ছিল। এই পদ্ধতিতেই সিসিলি থেকে এই পিঁপড়া নির্মূল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
গবেষকরা সিসিলির একটি নদীর পার্শ্ববর্তী ৪ দশমিক ৭ হেক্টর এলাকায় এই প্রজাতির পিঁপড়ার মোট ৪৪টি বাসা খুঁজে পান। স্থানীয়দের সাথে কথা বলার পরে, গবেষকরা জানতে পারেন যে সিসিলিয়ান অঞ্চলের লোকজন বেশ কয়েক বছর ধরে ঘন ঘন এই পিঁপড়ার কামড় খেয়ে আসছেন। অনেকে জানিয়েছেন, এর কামড়ে অসহ্য যন্ত্রণা হওয়ার পাশাপাশি শরীরে কাঁপুনিও ওঠে।
গবেষণা অনুসারে, ইউরোপীয় মহাদেশের পরিবেশগত অবস্থার ৭ শতাংশ এই পিঁপড়ার জন্য উপযুক্ত। তবে জলবায়ু পরিবর্তন তাদের বিস্তার ও সংখ্যা বৃদ্ধিকে আরও ত্বরান্বিত করতে পারে। আর শহুরে এলাকাগুলো বিশেষভাবে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
স্পেনের জীববিজ্ঞানী রজার ভিলা বলেন, প্রকৃতপক্ষে, ইউরোপের ৫০ শতাংশ শহর এই পোকার আক্রমণ ঝুঁকিতে রয়েছে। বিষয়টি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক কারণ লন্ডন, আমস্টারডাম ও রোমসহ অনেক শহরে বড় সমুদ্রবন্দর রয়েছে, যা এই পিঁপড়ার বিস্তার খুব দ্রুত অন্যান্য দেশ এবং মহাদেশে ছড়িয়ে দিতে পারে।
তিনি আরও বলেন, এই সমস্যা সম্পর্কে আমাদের আরও সচেতন থাকা দরকার। কারণ সমস্যাটি এরই মধ্যে ইউরোপে ছড়াতে শুরু করেছে। এমন পরিস্থিতিতে দরকার সমন্বিত পদক্ষেপের যথাসম্ভব দ্রুত বাস্তবায়ন।
একুশে সংবাদ/ এসএডি
আপনার মতামত লিখুন :