আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের ক্ষেত্র তৈরির লক্ষ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে সংসদের নিন্মকক্ষ ভেঙে দিয়েছেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবা। জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইশিবা শিগেরু চলতি মাসের শুরুতে দায়িত্ব নেয়ার ঠিক আট দিন পর এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। নির্বাচনী বিধান অনুযায়ী অক্টোবর মাসের ২৭ তারিখে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
জাপানের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের মেয়াদ চার বছর। তবে নির্ধারিত সময়ের আগে নিম্নকক্ষ ভেঙে দেওয়ার অধিকার সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া হয়েছে। ফলে অধিকাংশ সময়েই দেখা গেছে, নতুন একজন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম একটি পদক্ষেপ হিসেবে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন আহ্বান করেন।
এর পেছনে প্রধান কারণ হচ্ছে, দায়িত্ব গ্রহণের পরপর নতুন প্রধানমন্ত্রীর প্রতি জনসমর্থনের হার সাধারণত বেশি থাকে। ফলে তিনি সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে দলের এবং নিজের অবস্থান কিছুটা হলেও শক্তিশালী করে নিতে চান। পূর্ববর্তী প্রধানমন্ত্রী কিশিও ফুমিওকেও একই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা গেছে। তবে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর ইশিবার মতো এতটা অল্প সময়ে নিম্নকক্ষ ভেঙে দেওয়ার দৃষ্টান্ত জাপানে নেই।
দুই কক্ষবিশিষ্ট জাপানের পার্লামেন্টে উচ্চকক্ষ প্রধানত উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করে। রাষ্ট্র পরিচালনাসহ বিভিন্ন আইন পাস করিয়ে সরকারের দৈনন্দিন কার্যাবলি পরিচালনার দায়িত্ব নিম্নকক্ষের ওপর ন্যস্ত। ফলে নিম্নকক্ষের সদস্যদের মধ্য থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাকে সাধারণত প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করা হয় এবং প্রধানমন্ত্রী তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের অধিকাংশকে নিম্নকক্ষের সদস্যদের মধ্য থেকে বেছে নেন।
অন্যদিকে নিম্নকক্ষের মেয়াদ চার বছর হলেও উচ্চকক্ষের সদস্যরা ছয় বছরের জন্য নির্বাচিত হয়ে থাকেন। উচ্চকক্ষ ভেঙে দেওয়ার অধিকার প্রধানমন্ত্রীর না থাকায় পুরো মেয়াদেই দায়িত্ব পালনের সুযোগ তারা পেয়ে থাকেন।
জাপানের সংবাদমাধ্যম ও রাজনৈতিক ঘটনাবলির ওপর আলোকপাত করা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনে প্রধানমন্ত্রী ইশিবার চটজলদি এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনে কোনো কারণ রয়েছে কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে। ৪৬৫ সদস্যবিশিষ্ট পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে প্রধান ক্ষমতাসীন উদার গণতন্ত্রী দল এলডিপির ২৫০টি আসনের ভালো সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় আছে। তবে ইশিদা নিশ্চয় আশঙ্কা করছেন, পুরো মেয়াদে নিম্নকক্ষ দায়িত্ব পালন করলে ২০২৫ সালের অক্টোবর মাসের শেষ দিকে হতে যাওয়া নির্বাচনে এ রকম বলিষ্ঠ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখা দলের পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে।
এলডিপির পার্লামেন্ট সদস্যদের বড় একটি অংশের আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার বিভিন্ন ঘটনা সম্প্রতি ফাঁস হয়ে যায়। ফলে জনসমর্থন হারে ধস না নামলেও দলের প্রতি সাধারণ নাগরিকদের সমর্থন কমেছে। এ ধারাকে উল্টো পথে ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে ইশিবার প্রধান লক্ষ্য। দায়িত্ব গ্রহণের পরপর নতুন প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সমর্থনের হার সাধারণত বেশি থাকে। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে জনগণের ম্যান্ডেট তিনি নতুনভাবে আদায় করে নিতে চাইছেন।
তবে নিজের সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে পারা ইশিবার পক্ষে কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়ে শুরুতে কিছুটা সন্দেহ দেখা দিয়েছে। এর কারণ হলো, আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িত দলের বেশ কয়েকজন সদস্যের জন্য নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন লাভের সুযোগ তিনি করে দিয়েছেন। তাদের কাউকে পরবর্তী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হবে না বলে ইতিপূর্বে দেওয়া নিজের ঘোষণার পরিপন্থী হিসেবে এ পদক্ষেপকে দেখা হচ্ছে। যদিও ইশিবা নিজে সে রকম অভিযোগ মেনে নিতে নারাজ। তিনি বলছেন, কেবল একক আসনের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ তাদের জন্য করে দেওয়া হলেও আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভোটের তালিকায় তাদের কাউকে তিনি অন্তর্ভুক্ত রাখবেন না। ফলে স্থানীয়ভাবে জনগণের সমর্থন লাভ করে কেউ বিজয়ী হলে তাকে তিনি স্বাগত জানাবেন। কিন্তু দলের এর আগে দলের অনুসরণ করা নিয়ম থেকে তিনি অবশ্যই সরে যাবেন। আগের বিভিন্ন নির্বাচনে এলডিপির প্রার্থীদের মধ্যে অনেকেই সরাসরি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া সত্ত্বেও একক আসনের প্রার্থী তালিকাতেও নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করতেন। সরাসরি নির্বাচনে পরাজিত হলেও আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব তালিকায় অন্তর্ভুক্ত থাকা সংসদ সদস্য হওয়ার সুযোগ তাদের জন্য করে দেওয়া হতো।
জাপানের পার্লামেন্টে নির্বাচন সরাসরি এবং আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব, দুই নিয়ম অনুসরণ করেই হয়ে থাকে। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের নির্বাচনের জন্য দেশকে ১১টি ভাগে বিভক্ত করে নিয়ে প্রতিটি অংশের জন্য নিজেদের প্রার্থীদের তালিকা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে আগে থেকে নির্বাচন পরিচালনা কার্যালয়ে জমা দিতে হয় এবং সেই তালিকা অনুসরণ করে প্রতিটি অংশের বিজয়ীদের জন্য পার্লামেন্ট সদস্য হতে পারার সুযোগ করে দেওয়া হয়। ফলে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের অনেকেই এটাকে নিরাপদ অবলম্বন হিসেবে গণ্য করে একক আসনে প্রার্থী হওয়া সত্ত্বেও আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের তালিকাতেও নিজেদের নাম অন্তর্ভুক্ত রাখার চেষ্টা করতেন।
ইশিবা এখন বলছেন, কেলেঙ্কারিতে জড়িত পার্লামেন্ট সদস্যদের জন্য সেই সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে গ্রহণ করা শাস্তিমূলক পদক্ষেপ। তবে তার এই ব্যাখ্যা জনগণ কীভাবে গ্রহণ করবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। ২৭ অক্টোবরের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল তা হয়তো দেখিয়ে দেবে।
বিরোধী দলগুলোর বিরোধিতা সত্ত্বেও নিম্নকক্ষ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন আহ্বান করাকেও অনেকেই ইশিবার জন্য নেতিবাচক হিসেবে দেখছেন। প্রধান বিরোধী শাসনতান্ত্রিক গণতন্ত্রী দল সিডিপি বলে আসছিল যে সম্পূরক বাজেট বিল পাস করিয়ে নেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু দায়িত্ব পালন না করে চটজলদি নিম্নকক্ষ ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ হবে প্রতারণামূলক। তবে ইশিবা এতে কর্ণপাত করেননি এবং নিজের অবস্থানে অটল থেকেছেন। সাধারণ ভোটাররা এটাকে কীভাবে গ্রহণ করবেন, তার অনেকটাই এখন নির্ভর করবে নিজেদের সঠিক বার্তা নাগরিকদের কাছে পৌঁছে দিতে বিরোধী দলগুলো কতটা সফল হয় তার ওপর। ফলে ২৮ অক্টোবরের সাধারণ নির্বাচন ইশিবার পাশাপাশি জাপানের দুর্বল বিরোধী দলগুলোর জন্যও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিচ্ছে।
সূত্র: নিক্কেই এশিয়া, এএফপি
একুশে সংবাদ/ এস কে
আপনার মতামত লিখুন :