মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ফিলিস্তিনি জাতির কণ্ঠস্বর হিসেবে পরিচিত সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদন দর্শক, শ্রোতা ও পাঠকদের কাছে পৌঁছাতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এগুলো কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক। এক প্রতিবেদনে এমন অভিযোগ করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
ফিলিস্তিনভিত্তিক ২০টি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদমাধ্যমের ফেসবুক পেজে দর্শক, শ্রোতা ও পাঠকদের সম্পৃক্ততা যাচাই করেছে বিবিসি নিউজ অ্যারাবিক। গত বছরের ৭ অক্টোবর গাজা যুদ্ধ শুরুর আগে-পরের সম্পৃক্ততা যাচাই ও তুলনা করে ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে লন্ডলভিত্তিক সংবাদমাধ্যমটি।
এছাড়া কিছু ফাঁস হওয়া নথি বিবিসির হাতে এসেছে। সেখানে দেখা গেছে, মেটার মালিকানাধীন আরেকটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইনস্টাগ্রাম কর্তৃপক্ষ ২০২৩ সালের অক্টোবরের পর থেকে ফিলিস্তিন-সংক্রান্ত মন্তব্যগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে।
ফেসবুকের তথ্য-উপাত্তগুলো ব্যাপকভাবে বিশ্লেষণ করে বিবিসি জানিয়েছে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনের গাজা ও পশ্চিম তীরের বার্তাকক্ষগুলোর সঙ্গে দর্শক, শ্রোতা ও পাঠকদের মিথস্ক্রিয়া কমে গেছে।
তবে ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা জানিয়েছে, ইচ্ছাকৃতভাবে নির্দিষ্ট কণ্ঠস্বর দমনের অভিযোগ ‘দ্ব্যর্থহীনভাবে মিথ্যা’।এর আগে ইসরায়েলের গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর হাতে গোনা কয়েকজন বহিরাগত সাংবাদিককে গাজা উপত্যকায় ঢুকতে দেওয়া হয়েছিল। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর পাহারায় তারা ঢুকতে পেরেছেন। যারা গাজার অধিবাসীদের অবস্থা জানতে চান, তাদের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাদের কাছে প্যালেস্টাইন টিভি, ওয়াফা নিউজ এজেন্সি ও আল-ওয়াতান নিউজের মতো সংবাদমাধ্যমগুলোর ফেসবুক পেজ গুরুত্বপূর্ণ সংবাদসূত্র হয়ে উঠেছে। এসব সংবাদমাধ্যম পশ্চিম তীরের বাইরে থেকে পরিচালিত হয়।
তবে ফিলিস্তিনি সাংবাদিকেরা অভিযোগ করে আসছেন, তাদের অনলাইন কনটেন্টগুলোর (আধেয়) ওপর ‘ছায়া নিষেধাজ্ঞা’ দিয়ে রেখেছে মেটা। আরও পরিষ্কার করে বললে, ফেসবুকে কতজন মানুষ কনটেন্টগুলো দেখতে পাবেন, তা নির্ধারণ করে দিচ্ছে মেটা।
তাদের এই অভিযোগ যাচাই করতে ফেসবুকে ২০টি ইসরায়েলি সংবাদ সংস্থার পেজে একই ধরনের ডেটা বিশ্লেষণ করেছে বিবিসি। এসব সংবাদমাধ্যমের মধ্যে আছে ইয়েদিওত আহরোনোত, ইসরায়েল হেয়োম ও চ্যানেল থার্টিন। এতে দেখা গেছে, এগুলোর পেজে বিপুলসংখ্যক যুদ্ধ সংক্রান্ত কনটেন্ট প্রকাশ করার পরও তাদের দর্শক, শ্রোতা ও পাঠকের সংখ্যা প্রায় ৩৭ শতাংশ বেড়েছে।
যদিও যুদ্ধকালে অডিয়েন্স এনগেজমেন্ট বা শ্রোতা-পাঠক সম্পৃক্ততা বাড়বে বলে ধারণা করা হয়। অথচ ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর ফিলিস্তিনি সংবাদমাধ্যমের পাঠক সম্পৃক্ততা ৭৭ শতাংশ কমেছে। এর মধ্যে ফেসবুকে প্যালেস্টাইন টিভির ফলোয়ার (অনুসারী) সংখ্যা ৫৮ লাখ। টেলিভিশন চ্যানেলটির বার্তাকক্ষে নিযুক্ত সাংবাদিকেরা বলেছেন, আগে ফেসবুকে তাদের পোস্টগুলো যত মানুষের কাছে পৌঁছাত, সেই সংখ্যা এখন ৬০ শতাংশ কমে গেছে।
এর আগে একই অভিযোগের জবাবে ২০২১ সালে মেটার তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত এক স্বাধীন প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ইচ্ছাকৃতভাবে নয়; বরং মডারেটরদের মধ্যে আরবি ভাষাসংক্রান্ত দক্ষতার অভাব থাকায় এমনটা হচ্ছে। ভাষাদক্ষতা না থাকায় তারা নিরীহ শব্দ ও বাক্যাংশগুলোও আক্রমণাত্মক বা হিংসাত্মক হিসেবে ব্যাখ্যা করে ফেলেন।
মেটা ভাষাসংক্রান্ত যে ব্যাখ্যাটি দিয়েছে, তা আসলে কতটুকু সত্য, তা জানতে অন্য জায়গার ৩০টি আরবি ভাষার সংবাদমাধ্যমের ফেসবুক পেজ নিয়ে একই বিশ্লেষণ করেছে বিবিসি। এসব সংবাদমাধ্যমের মধ্যে স্কাই নিউজ অ্যারাবিয়া ও আল–জাজিরাও ছিল। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এসব পেজে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পাঠকদের সম্পৃক্ততা গড়ে প্রায় ১০০ শতাংশ বেড়েছে।
বিবিসির গবেষণার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে মেটা কর্তৃপক্ষ জানায়, তারা কিছু গোপন রাখেনি। তবে তারা মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। কারণ, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আছে এবং মেটার নিজস্ব নীতিমালার আওতায় সংগঠনটিকে বিপজ্জনক বলে বিবেচনা করা হয়।
একুশে সংবাদ/ এস কে
আপনার মতামত লিখুন :