ইনাম আহমদ চৌধুরী : শৈশব ও কৈশোর থেকেই সমাজ সচেতন ছিলাম। আপনা-আপনিভাবেই এটা আমরা মধ্যে বিধৃত হয়েছে। আমরা মা-বাবা ও পারিবারিক যে পট-ভূমিকা আছে সেটা আমার জন্য বিশেষ অবদান রেখেছে। ছাত্র থাকাকালে ‘প্রভাতি’ নামে একটা মাসিক পত্রিকা বের করেছিলাম আমরা। তখন প্রথম যে কিশোর গল্প সঙ্কলন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে হয়েছিল সেটা ‘নতুন ছবি’ নামে আমরা তা প্রকাশ করি। সেটা ছিল একটা ছোটগল্প সঙ্কলন- যা পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম হয়েছিল। এর জন্য শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন অন্নদা শঙ্কর রায়সহ আরও গুণীরা। তাদের সঙ্গে আমাদের পত্রালাপ ছিল। বড় হয়েও সেই পত্রালাপগুলো আমাদের অক্ষুণ্ণ ছিল। কলেজে প্রবেশ করে আমি ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হই। এটা ১৯৫২-৫৩ সালের কথা। আমরা সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায় যোগদান করতাম। ঢাকায় তখন কলেজের সংখ্যা কম ছিল। তখন ঢাকা কলেজ ও জগন্নাথ কলেজের ছাত্র প্রতিনিধিরাও সেখানে যোগদান করতো। আমরা ঢাকা কলেজে একটা শহীদ মিনার স্থাপন করেছিলাম এবং ১৯৫৩ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে সেখানে আমরা একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করি। ওই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবদুল গাফফার চৌধুরীর (প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট) সেই বিখ্যাত গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ প্রথমবারের মতো গাওয়া হয়েছিল। শহীদ মিনার, সেই গান এবং ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আমাকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। একই সঙ্গে আরও কয়েকজনকেও বহিষ্কার হয়েছিল। এ নিয়ে আবদুল গাফফার চৌধুরী লিখেছেন, আমিও লিখেছি। আমাদের বিরুদ্ধে বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহারের জন্যে আন্দোলন শুরু হলো। সেই আন্দোলন বেশ দানা বেঁধে উঠলো। সেই আন্দোলনের সূত্র ধরে আমরা তদানীন্তন বিরোধী দলের একজন প্রখ্যাত আইনজীবী ও রাজনৈতিক নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সাথে আমরা দেখা করেছিলাম। তার সঙ্গে দেখা করে আমরা তার উপদেশ ও নির্দেশনা নিয়েছিলাম। তখনই আমাদের দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। সেটাই ছিল তার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। আমার মনে আছে, সেটা ছিল তদানীন্তন যে রমনা রেস্ট হাউস ছিল, সেখানে-গুলিস্তানের কাছে শহীদ সাহেব তার কক্ষেই ছিলেন। আমরা যখন গেলাম- আমি ছিলাম, গাফফার চৌধুরী ছিলেন আর আমাদের সহ-সভাপতি মশিউর হোসেন, তিনি সাংবাদিকও ছিলেন। আমার মনে আছে, তখন তিনি বঙ্গবন্ধু আখ্যায়িত হন নি। তিনি আমাদের ইন্সপায়ার করেছিলেন, তিনি বলেছিলেন, আমাদের দাবি অত্যন্ত ন্যায্য তবে এ জন্য আপনাদের সংগ্রাম করতে হবে। পরিষ্কারভাবেই তিনি এ কথা আমাদের বলেছিলেন। মুহিত সাহেব (সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত) তার একটি বইয়ে উল্লেখ করেছেন- ‘‘ তখন প্রথম অন্তপ্রাদেশিক যে একটা ছাত্র আন্দোলন হয়েছিল, সেটা আমাদের বহিষ্কার আদেশকে কেন্দ্র করেই হয়েছিল।’’ পরে সেই বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার করা হয়। সে থেকেই আমি ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পরেছিলাম। তখন কিন্তু রাজনীতির সঙ্গে ছাত্র আন্দোলনের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল না। এরপর আমি এস এম হল কেবিনেটের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করেছি। একটা কেবিনেট আমি ও মুহিত সাহেব একসঙ্গে নির্বাচিত হয়েছিলাম, মুহিত সাহেব সহ-সভাপতি পদে আর আমি জয়েন্ট সেক্রেটারি পদে। আমি সংস্কৃতি সংসদের সভাপতি। সংস্কৃতি সংসদে আমার সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন জহির রায়হান। তখন আমরা সংস্কৃতি সংসদের কার্যক্রমে নতুন একটা প্রাণ সঞ্চার করতে পেরেছিলাম। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে গঠনধর্মী, জনকল্যাণমুখী ও সমাজ সচেতনমূলক মুক্তবুদ্ধির সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিল। ১৯৬০ সালে আমি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেই।
● রাজনীতিতে কিভাবে নিজেকে যুক্ত করলেন ?
ইনাম আহমদ চৌধুরী :প্রথম পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগদান করে ওখানে প্রশাসনিক পদে খুব কম সময়ের মধ্যেই আমাকে সাব ডিভিশনাল অফিসার করা হলো সিরাজগঞ্জে। যাকে ‘ডেপুটি কমিশনার’ বলা হতো। সিরাজগঞ্জের মিউসিপ্যালটির চেয়ারম্যানও কিন্তু আমি ছিলাম। সিরাজগঞ্জে থাকাকালীন আমি বিয়ে করি। এরপর যশোরে ছিলাম, চট্টগ্রামে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্টেট ছিলাম। এরপর খুলনাতে জেলা ম্যাজিস্ট্যাট ছিলাম। তারপর অক্সফোর্ডে গিয়ে আমাকে ডেভলপমেন্ট নিয়ে পড়াশোনা করতে হয়েছে। যখন বঙ্গবন্ধু আহ্বান করলেন, তখন তো সমস্ত জাতি তার পেছনে দাঁড়ালো। তখন সিভিল সার্ভিসের যে ইস্ট পাকিস্তান শাখা ছিল, ১১ মার্চ একটা মিটিং করে যার সভাপতি ছিলেন এস এন হাসান, যিনি অনেক সিনিয়র সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তা ছিলেন তার সভাপতিত্বে মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। সিদ্ধান্ত ছিল- আমরা সিভিল সার্ভিসরা আমাদের জাতির প্রতি যে দায়িত্ব রয়েছে তাতে আমরা মনে করি, নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতাবদলের যে সুযোগ এসেছে, সেই সুযোগে আমরা সহযোগিতা ও সমর্থন দেবো এবং এই হিসেবে আমরা মনে করি যিনি সংখ্যাগরিষ্টের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন, সংবিধান অনুসারে ক্ষমতা তারই লাভ করা উচিত। তখন বাংলাদেশ হয়নি, পাকিস্তানি আমল। এটা বঙ্গবন্ধুর গোচরে আনা হয়েছিল। আমার কাছে মনে হয়, পরবর্তীতে সিভিল সার্ভিসের প্রতি তিনি যে আস্থা দেখিয়েছেন, সেটার কারণ হয়তো এটা থাকতে পারে। সে সময় সিভিল সার্ভিসের অনেকেই এগিয়ে এসেছিলেন (দেশের জন্য) রুহুল কুদ্দুস সাহেব, এইচ টি ইমাম সাহেব, তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, সাহাব উদ্দিন সাহেবসহ অনেকেই। দেশের বাইরে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে মুহিত সাহেব, শাহ এম এস কিবরিয়া সাহেব। বাংলাদেশ হওয়ার পরবর্তীকালে আমি প্রথম জয়েন্ট সেক্রেটারি ছিলাম। তখন থেকেই আমি সম্পৃক্ত হয়ে পড়লাম। ভারতে আমাদের প্রথম ডেলিগেশন টিম গেলাম জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে (১৯৭২), ৩ কিংবা ৪ তারিখে। যার নেতৃত্বে ছিলেন আবদুস সামাদ আজাদ সাহেব, তখন তিনি নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন। সেই ডেলিগেশনে ছিলেন ফারুক চৌধুরী, যিনি আমার বড় ভাই। আমি গেলাম বাণিজ্য সেক্টরের জন্য, এ ছাড়া হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী সাহেব, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন অধ্যাপক মোশারফ হোসেন, তিনিও গিয়েছিলেন। দিল্লি থাকাকালীনই আমরা খবর পেলাম, বঙ্গবন্ধু মুক্ত হয়েছেন। তিনি ঢাকা আসার পথে লন্ডনে যাচ্ছেন। আমার মনে আছে, জে এন দীক্ষিত দরজা খুলে আমাকে জানালেন- ‘বঙ্গবন্ধু ইজ ফ্রি’। এর পর আমি চীনের সঙ্গে কাজ করেছি, জাতিসংঘে কাজ করেছি। আমি লন্ডনে কর্মরত ছিলাম ৬ বছর। আমি বাংলাদেশে প্ল্যানিংয়ের (পরিকল্পনা কমিশন) সচিব ছিলাম। ইআরডিতে ছিলাম, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে ছিলাম, আমি ইসলামিক ডেভলপমেন্ট ব্যাংকেরও-(আইডিবি) ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলাম। আমি যখন আইডিবি’তে কর্মরত অবস্থায় জেদ্দাতে ছিলাম তখন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম সেখানে সফর করেছিলেন। ১৯৯৬ সালে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার জেদ্দা সফর ছিল। তখন আমি সকলকে বললাম, দল-মত নির্বিশেষে তাকে আমাদের স্বাগত জানানো উচিত। তখন আমি এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছিলাম। সব দলের সবাইকে ডেকে নিয়ে আমি বলেছি, আমাদের প্রধানমন্ত্রী আসছেন। আবদুস সামাদ আজাদ ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার সহযোগিতায় আমি সব কিছুর আয়োজন করেছিলাম। এরপরে যখন আমি দেশে ফিরে এসে রাজনৈতিকভাবে অংশগ্রহণ করতে চাইলাম, তখন আমি অপজিশনে (বিএনপি) যোগ দিলাম। কিন্তু আমি যখন অপজিশনে (বিএনপি) গেলাম তখনও তার (শেখ হাসিনা) প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আমার সব সময়ই ছিল। আপনারা হয়তো লক্ষ্য করেছেন, সব সময় আমি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কথা উচ্চারণ করেছি। বলেছি, তার নেতৃত্ব আমাদের রাখতে হবে, তিনি জাতির জনক। তিনি শুধু জাতির জনকই নন, তিনি বাঙালি জাতিস্বত্বার সৃষ্টাও। আমি সব সময়, গণতন্ত্রের চর্চা করতে চেয়েছি কিন্তু একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যখন আমি দেখলাম, গণতন্ত্র নিয়ে বাণিজ্য করতে তখন আমার কাছে এটা অদ্ভুত ব্যাপার বলে মনে হলো। গণতন্ত্রের চর্চার নামে যেখানে মনোনয়ন বাণিজ্য হয়, সেখানে কি গণতন্ত্রের চর্চা হতে পারে? এটা আমাকে গভীরভাবে আঘাত করলো। তখন আমার মনে হলো, আমি কিসের পেছনে থাকবো। তখন আমি দেখতে পেলাম যে, জননেত্রী শেখ হাসিনা চেষ্টা করে যাচ্ছেন দেশকে উন্নত স্তরে এগিয়ে নিতে, কিছু ভুল-ত্রুটি হয়তো থাকতে পারে। তখন যেহেতু আমি ত্যাগ (দল) করলাম, তখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম তাকে সমর্থন জানাতে চাই। তার পেছনে থাকতে চাই, তার এই অগ্রযাত্রায় সামিল হতে চাই। এ জন্য কোনও শর্ত নেই, কিছু নেই, আমার কথা হচ্ছে উন্নয়নের পক্ষে থাকা আমার দায়িত্ব। আপনি জানতে চাইলেন, কেন আমি আওয়ামী লীগে যোগ দিলাম। আমি দেখলাম যে, ওখানে (বিএনপি) ওই সোনার হরিণ সেটা হচ্ছে না। এখানে (আওয়ামী লীগ) আমাদের দেশকে গঠন করার জন্য তিনি যে আগ্রহ নিয়ে শুরু করেছেন- তাকে সমর্থন জানানোই আমার উচিত হবে। তারই জন্য আমি তখন যোগদান করেছি (আওয়ামী লীগে)।
আপনার মতামত লিখুন :