দৈনিক জাগরণ : বিশ্বব্যাংক তাদের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার প্রশংসা করেছে। একই সঙ্গে ব্যাংকিং সেক্টরকে অর্থনীতির সবচেয়ে দুর্বল স্থান হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরের বর্তমান অবস্থাকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : বিশ্বব্যাংক যে মন্তব্য করেছে তা ঠিকই আছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি সাম্প্রতিক সময়ে যথেষ্ট উন্নতি সাধন করেছে। কিন্তু ব্যাংকিং সেক্টর সেই অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। বিশ্বব্যাংক এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) প্রায় একই রকম কথা বলেছেন। তারা বলেছেন, সার্বিক উন্নতির দিক থেকে অর্থাৎ বাংলাদেশের জিডিপি গ্রোথ ভালো হয়েছে। কিন্তু ব্যাংকিং সেক্টর খুবই নাজুক অবস্থার মধ্যে রয়েছে। উভয় সংস্থা একই রকম অভিমত দিয়েছে। আমরাও অনেক দিন ধরেই দেশের ব্যাংকিং সেক্টর সম্পর্কে প্রায় একই রকম অভিমত দিয়ে আসছিলাম। আমাদের এই সমালোচনার উদ্দেশ্য দেশের ব্যাংকিং সেক্টরকে খাটো বা হেয় করা নয়। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল ডুুবন্ত অবস্থা থেকে এই সেক্টরকে জাগানো। এখন বিশ্বব্যাংক এবং এডিবিও একই কথা বলছেন। আমরা এখন অপেক্ষায় আছি, দেখি এতে সরকারের টনক নড়ে কি না।
দৈনিক জাগরণ : আপনি কয়েক দিন আগে একটি জাতীয় দৈনিকের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সরকার এখন ঋণ খেলাপি বান্ধব। এই মন্তব্যের কারণ কি? এবং এই প্রেক্ষিতে ব্যাংকিং সেক্টরের বর্তমান অবস্থাকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : খেলাপি ঋণের সমস্যা সব ব্যাংকের জন্যই অত্যন্ত জটিল সমস্যায় পরিণত হয়েছে। আগে খেলাপি ঋণের সমস্যা মূলত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের ক্ষেত্রেই বেশি ছিল। এখন বেসরকারি ব্যাংকেও খেলাপি ঋণের সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। আগের যে অর্থমন্ত্রী ছিলেন তিনি ব্যাংকিং সেক্টরের খেলাপি ঋণের সমস্যার তেমন কোনো উন্নতি করতেই পারেন নি। তিনি ভালো ব্যবস্থাপনাও নিশ্চিত করতে পারেন নি। কিন্তু তা সত্বেও তিনি ঋণ খেলাপি বান্ধব ছিলেন এটা বলা যাবে না। তিনি ঋণ খেলাপিদের বকাবকি করতেন ঠিকই কিন্তু তাদের টাচ করতে পারতেন না। কিন্তু বর্তমান অর্থমন্ত্রী দেখা যাচ্ছে রীতিমতো খেলাপি ঋণ বান্ধব। আমার সাক্ষাৎকারে সরকার বলতে অর্থমন্ত্রীকেই বুঝাতে চেয়েছি। কারণ অর্থনীতি বা ব্যাংকিং ব্যবস্থা সম্পর্কে অর্থমন্ত্রীই দায়বদ্ধ। কয়েক দিন আগে তিনি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ঋণ খেলাপিরা তো ব্যবসায়ি। কাজেই তাদের জেলে যেতে হবে না। আমি বুঝতে পারিনা এটা কেমন কথা। কারণ পৃথিবীর প্রতিটি সভ্য দেশে ব্যবসায়িদের মধ্যে ২/৪ জন যারা খারাপ থাকেন বা যারা দুষ্ট প্রকৃতির তাদের জেলে যেতেই হয়। যারা ভালো তারা কেনো হয়রানির শিকার হবেন? যারা দুষ্ট প্রকৃতির তাদের তো শাস্তি পেতেই হবে। বাংলাদেশে ব্যাংকিং সেক্টর ১০ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। এর মধ্যে এক লক্ষ কোটি টাকার কিছু কম হচ্ছে খেলাপি ঋণ। এছাড়াও প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। তাহলে এই ১ লক্ষ ৩৬ হাজার কোটি টাকা বাদে অবশিষ্ট প্রায় পৌনে ৯ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে যারা ব্যবসায় করছেন তারাই হচ্ছেন প্রকৃত ব্যবসায়ি। তারা তো ক্ষতিকর কিছু করছেন না। তারা ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করেন আবার সময় মতো সুদসহ সেই ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেন। তাদেরকে সৎ ব্যবসায়ি বলতে আমরা রাজি আছি। কিন্তু যারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ঠিক মতো পরিশোধ করেন না তারা কি সত্যিকার ব্যবসায়ি? কাজেই ঋণ খেলাপিদের ব্যবসায়ি আখ্যায়িত করে প্রোটেকশন দেয়া ঠিক হবে না। এটা করা হলে যারা সৎ ব্যবসায়ি এবং যাদের সংখ্যাই বেশি তারা হতাশ হবেন, তাদের অবমাননা করা হবে। শুধু তাই নয় এতে যারা নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করছিলেন তারাও খেলাপি হতে উৎসাহিত হবেন।
দৈনিক জাগরণ : সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, আজ থেকে আর খেলাপি ঋণ বাড়বে না। তারপরই ব্যাংকিং সেক্টর এমন কিছু পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে যাতে কৃত্রিমভাবে খেলাপি ঋণকে কমিয়ে দেখানো যাবে কিন্তু প্রকৃত পক্ষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমবে না। ব্যাপারটি কিভাবে দেখছেন?
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবেই উদ্যাগটি নেয়া হয়েছে বলে মনে করি। কারণ তিনটি ঘটনা আমরা যদি একত্রিত করি তাহলে দেখবো, বর্তমান পর্যায়ে এই সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ব্যাংকারদের একটি সভায় একজন শীর্ষ ঋণ খেলাপি, যাকে খেলাপি বলা যাবে না মহামান্য আদালতের ‘স্টে অর্ডারের’ কারণে, তিনি বলেছিলেন, আপনারা খেলাপি খেলাপি করেন, আমরা এমন আইন করবো যাতে খেলাপি ঋণ বলে কিছু থাকবে না। এরপর থেকে আমরা লক্ষ্য করছি সমস্ত প্রচলিত নিয়ম-কানুন ভঙ্গ করে এমনভাবে আইনি সংস্কার করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে যাতে ঋণ খেলাপিরা সর্বোচ্চ সুবিধা পায়। যেমন, খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা পরিবর্তন করা হচ্ছে। খেলাপি ঋণের নতুন সংজ্ঞা অনুযায়ী, ঋণ গ্রহীতারা ঋণের কিস্তি পরিশোধে অধিকতর সময় পাবেন। ঋণ হিসাব অবলোপনের নিয়ম শিথিল করা হয়েছে। আগে একটি ঋণ হিসাব মন্দ ঋণ হিসেবে আখ্যায়িত হওয়ার পর ৫ বছর অতিক্রান্ত হলে উপযুক্ত আদালতে মামলা দায়েরের পর শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করে অবলোপন করা যেতো। এখন তিন বছর পরই একটি ঋণ হিসাব অবলোপন করা যাবে। মামলা দায়ের এবং শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণের নীতিমালাও শিথিল করা হয়েছে। ঋণ হিসাব পুন:তফসিলিকরণের নিয়ম সহজীকরণ করা হয়েছে। প্রস্তাবিত নতুন সংস্কার কার্যক্রমে ১৫ বছরের জন্য একটি ঋণ হিসাব পুন:তফসিলিকরণ করা যাবে। পুন:তফসিলিকরণকৃত ঋণ হিসাবের সুদের হার হবে ৭ শতাংশ। এতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে কমে আসবে। খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা পরিবর্তনের ফলে যে কাজটি হবে তাহলো আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা কমে যাবে। কারণ খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা তো বাংলাদেশ ব্যাংক তৈরি করে না। এটা ব্যাসেল এগ্রিমেন্টের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই প্রণয়ন করা হয়। আমরা এখন ব্যাসেল থ্রি’তে অবস্থান করছি। এটি সম্মানজনক ব্যবস্থা। আমার যদি সেই ব্যাসেল এগ্রিমেন্ট অমান্য করে খেলাপি ঋণ নির্ধারণ করি তাহলে ব্যাংকের মূলধন ক্যালকুলেশনে সমস্যা দেখা দিতে পারে। প্রভিশন সংরক্ষণের বিষয়েও ঝামেলা হবে। মালিকরা যে প্রফিট পাবার কথা তার চেয়ে বেশি প্রফিট তারা নিয়ে যাবে। এগুলো সবই যে ব্যাংকিং সংস্কৃতির পরিপন্থি তাই নয় আন্তর্জাতিকভাবেও বাংলাাদশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে। বিদেশের কোনো কোনো ব্যাংক আমাদের ব্যাংকের ঋণপত্র গ্রহণ করবে না। সেই অবস্থায় আমাদের ব্যাংকের ঋণপত্র গ্রহণ করার জন্য অন্য একটি ব্যাংকের নিশ্চয়তা পত্র দিতে হবে। এতে পণ্য আমদানি ব্যয় অনেকটাই বেড়ে যাবে,যা দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
দৈনিক জাগরণ : আপনার দীর্ঘ ব্যাংকিং ক্যারিয়ারের অভিজ্ঞতার আলোকে ব্যাংকিং সেক্টরের এমন কিছু সমস্যার কথা বলবেন কি যা তেমনভাবে আলোচিত হয় নি। কিন্তু আলোচনার দাবি রাখে?
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : ব্যাংকিং সেক্টরে ব্যাংক-কাস্টমার রিলেশনশিপ নিয়ে খুব একটা আলোচনা হচ্ছে না। অথচ বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থমন্ত্রী মহোদয় যেসব বিধিমালা করতে যাচ্ছেন তাতে আগামীতে ব্যাংক-কাস্টমার রিলেশনশিপ ভেঙ্গে যেতে পারে। আমাদের এই প্রসঙ্গে পুরনো কথা মনে করতেই হয়। ইংল্যান্ডে যখন আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু হয় তখন কোনো ব্যাংকিং আইন ছিল না। ব্যাংকার এবং গ্রাহকের পরস্পর আস্থার উপর নির্ভর করে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালিত হতো। এরপরে ব্রেঞ্চে বসে ব্যাংকিং করতো। সেই অবস্থা থেকে আস্তে আস্তে ব্যাংকিং ব্যবস্থা আজকের অবস্থায় এসেছে। ইংল্যান্ডেই প্রথম ব্যাংকিং আইন প্রণীত হয়। ব্যাংক পরিচালনার জন্য আইন করা হচ্ছে এতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু ব্যাংকিং ব্যবসায় চলছে ব্যাংক-গ্রাহক আস্থার উপর নির্ভর করে। কোনো কারণে যদি এই পারস্পিরিক আস্থা নষ্ট হয়ে যায় তাহলে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বিপর্যয় নেমে আসতে বাধ্য। কোনো ব্যাংকের উপর সাধারণ মানুষের আস্থা কমে গেলে সেই ব্যাংক থেকে গ্রাহক চলে যায়। এর সাম্প্রতিক উদাহরণ হচ্ছে ফারমার্স ব্যাংক। ফারমার্স ব্যাংকের উপর থেকে সাধারণ গ্রাহকের আস্থা চলে যাবার পর রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে এই ব্যাংকের সমস্যা সমাধানের জন্য অর্থায়ন করতে বলা হলো। কিন্তু তাতেও পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হলো না। শেষ পর্যন্ত এই ব্যাংকের নামই পরিবর্তন করা হলো। বিষয়টি এই রকম যে, আগের নামই রাখবো না দেখি তাতে জনগণের আস্থা ফেরে কিনা। এটি একটি উদ্ভট কল্পনা মাত্র। ফারমার্স ব্যাংকের অবস্থা দেখে এটা অনুধাবন করা যায় আসলে আইন কখনোই মানুষের আস্থার বিকল্প হতে পারে না। বলা হচ্ছে, সরকার কর্তৃক নিয়োজিত চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট দিয়ে যাচাই করে দেখা হবে কোন খেলাপি ভালো আর কোন খেলাপি মন্দ। প্রত্যেকটি ব্যাংক তো একাধিক চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট দিয়ে তাদের ব্যালেন্সশিট নিরীক্ষা করে থাকে। তাহলে নতুন করে আবার কেনো চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট দিয়ে যাচাই করেত হবে কেনো? এতে সরকারের আস্থাভাজন ঋণ খেলাপিরা বিশেষ সুবিধা পেতে পারেন। আবার যারা সরকারের আস্থাভাজন নন তারা খারাপ হিসেবে আখ্যায়িত হতে পারেন। একটি ব্যাংকে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষক দিয়ে অডিট করানো হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট টিম অডিট করে। আবার বাণিজ্যিক নিরীক্ষা দল কর্তৃক নিরীক্ষা করানো হয়। এই অবস্থায় পুনরায় চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট দিয়ে অডিট করানোর কোনো প্রয়োজন আছে কি?
দৈনিক জাগরণ : আপনি আগেও একবার আমার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ব্যাংকিং সেক্টরের সমস্যা আমাদের জানাই আছে। কাজেই নতুন করে ব্যাংকিং কমিশন গঠন করে সমস্যা জানার দরকার নেই। এখন দরকার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার। বর্তমানে আবারো নতুন করে সমস্যা জানার দরকার আছে কি?
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : আমি তো তা মনে করি না। সমস্যা আমাদের জানাই আছে। ব্যাংকের সমস্যা ব্যাংকার জানে, কাস্টমার জানে এমন কি সরকারও ভালোভাবেই অবহিত আছে। কাজেই ব্যাংকিং সেক্টরের সমস্যা নতুন করে জানার প্রয়োজন নেই। এখন প্রয়োজন শুধু সমস্যা সমাধানের জন্য কার্যকর এবং কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকার ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও দ্বিধান্বিত। যে কারণে আবারো নতুন করে সমস্যা খুঁজে বের করার কথা বলা হচ্ছে। এটা আর কিছুই নয় সময় ক্ষেপনের একটি কৌশল মাত্র।
দৈনিক জাগরণ : কিছু দিন আগে ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকে একই পরিবার থেকে ২ জনের পরিবর্তে একই সঙ্গে ৪ জন পরিচালক নিয়োগ এবং তাদের মেয়াদকাল অব্যাহতভাবে ৬ বছরের পরিবর্তে ৯ বছর করা হয়েছে। বিষয়টি আপনি কিভাবে দেখছেন?
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে, সরকারের চাইতে ব্যাংকের এক শ্রেণির দুষ্ট প্রকৃতির মালিক যেনো অধিক ক্ষমতাবান। আমি অবশ্য বলছি না যে, ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকের সব মালিকই দুষ্ট প্রকৃতির। ব্যাংকের অধিকাংশ মালিকই ভালো। কিছু দুষ্ট প্রকৃতির মালিক আছেন যারা সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেন। যারা ভালো ব্যাংক মালিক তারা দূরে দূরে থাকেন। সেই রকম কিছু লোকের লবিং এ সরকার আইন পরিবর্তন করে ফেললেন যে, এক পরিবার থেকে একই সময়ে ২ জনের পরিবর্তে ৪ জন পরিচালক নিযুক্ত হতে পারবেন। এবং তারা অব্যাহতভাবে তিন টার্ম অর্থাৎ ৯ বছর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। আগে তারা অব্যাহতভাবে ৬ বছর দায়িত্ব পালন করতে পারতেন। বেসরকারি ব্যাংক কিন্তু ব্যাংকের মালিকদের টাকায় চলে না। ব্যাংক পরিচালিত হয় সাধারণ আমানতকারিদের টাকায়। কিন্তু নতুন আইনি সংস্কারের ফলে ব্যাংকিং ব্যবস্থার উপর পারিবারিক আধিপত্য আগের তুলনায় আরো বাড়ানো হলো। ব্যাংকের মোট মূলধনের মধ্যে ৯০ শতাংশই হচ্ছে সাধারণ আমানতকারিদের। ব্যাংক ব্যবসায় পরিচালনা করতে গেলে সিআরআর( ক্যাশ রিজার্ভ রিকোয়ারমেন্ট) এবং এসএলআর(স্ট্যাটুউটুয়ারি লিকুইডিটি রিজার্ভ) রাখতে হয় ২০ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংক মালিকদের এক টাকাও ঋণ হিসেবে ব্যবহৃত হয় না। এ কারণেই ব্যাংকিং ব্যবসায় কখনোই পার্টনারশিপ হয় না। কখনো প্রপ্রাইটারশিপ ব্যাংক হয় না। লিমিটেড কোম্পানির মাধ্যমে ব্যাংক ব্যবসায় পরিচালিত হয়। এটা করা হয় এ জন্যই যে,যাতে জনগণের টাকা ছড়ানো ছিটানো থাকে। কেউ ইচ্ছে করলেই তা আত্মসাৎ করতে পারে না। কিন্তু একটি পরিবার থেকে যদি ৪জন ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডে থাকে তাহলে সেই ব্যাংকের উপর পারিবারিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে গ্রাহকের অর্থের নিরাপত্তা বিঘিœত হতে পারে।
দৈনিক জাগরণ : দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠি ৮ বা ৯টি ব্যাংকের মালিকানা অর্জন করেছে। এটা কি ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ?
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : আমাদের জানা মতে,এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ইসলামি ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড দিয়ে। প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা কিছুটা খুশিই হয়েছিলাম। কারণ ইসলামি ব্যাংক জামায়াতে ইসলামের সব লোকজনে দিয়ে ভর্তি ছিল। তারা নানাভাবে এই টাকা রাজনৈতিক কাজে ব্যবহৃর করতো বলে অভিযোগ ছিল। কিন্তু এখন আমাদের ধারনা অনেকটাই পাল্টে গেছে। একই পরিবার বা গোষ্ঠি থেকে অনেকগুলো ব্যাংক অধিগ্রহণ করলে এক ধরনের মনোপলি বিজনেসের সৃষ্টি হয়। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সরকার এই বিষয়টি বিচার বিশ্লেষণ করতে পারেন। জনগণের আমানত যাতে কোনো ধরনের ঝুঁকির মধ্যে না পরে তা নিশ্চিত করতে হবে।
দৈনিক জাগরণ : ব্যক্তি খাতের কিছু কিছু ব্যাংক ভালো চলছে না। এগুলো কি মার্জার করা প্রয়োজন?
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : দেশের দুর্বল ব্যাংকগুলো মার্জার হতে পারে যদি উভয় পক্ষ একমত হয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে দু’টি ব্যাংক মার্জার করতে গেলে উভয়পক্ষ একমত হয় না। প্রত্যেকেই তার স্বাতন্ত্র বজায় রাখতে চায়। কেউই নিজস্ব স্বকীয়তা বিসর্জন দিতে চায় না। মরে যাব কিন্তু তার স্বাতন্ত্র বিসর্জন দেবে না। এই মানষিকতা নিয়ে চললো তো মার্জার করা যাবে না। আমি মনে করি,দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভুত করার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করা দরকার। মার্জারের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দেয়া যেতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি মনে করে কোনো ব্যাংক ঠিকভাবে চলছে না, জনগণের আমানত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে তাহলে তারা সেই ব্যাংকটিকে অন্য কোনো ব্যাংকের সঙ্গে মার্জার করে দিতে পারে।
দৈনিক জাগরণ : কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন ক্ষমতা কমানোর কথা শোনা যাচ্ছে। এটা ব্যাংকিং ব্যবস্থার জন্য কতটা সুখকর হবে বলে মনে করেন?
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : এটা করা হলে দেশের ব্যাংকগুলো মারাত্মক সমস্যায় পতিত হবে। কারণ আমার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজের অনেক ধরনের সমালোচনা করি। কিন্তু তারপরও তারা যেটুকু পরিদর্শন করতে পারছে তার কারণে ব্যাংকগুলো মোটামুটি ভালোভাবে চলছে। তারা ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকের ক্ষেত্রে তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারছে। যদিও রাষ্ট্রায়ত্ম ব্যাংকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা অনেকটাই সীমিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনের কারণেই ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের চেয়ে তুলনামূলক ভালো চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন ক্ষমতা যদি আরো কমিয়ে ফেলা হয় তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রয়োজন কি?
দৈনিক জাগরণ : জাতীয় নির্বাচনের পর দেশের বিনিয়োগ কার্যক্রমে এক ধরনের গতিশীলতা সৃষ্টি হয়। একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর বাংলাদেশের বিনিয়োগ কার্যক্রমে গতিশীলতা সৃষ্টি হবে বলে আশা করা হয়েছিল। কিন্তু এখনো তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এর কারণ কি?
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : এই প্রশ্নটি নিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছি। কিন্তু এখনো কোনো গ্রহণযোগ্য উত্তর পাচ্ছি না। বিনিয়োগযোগ্য তহবিল মানুষের কাছে কিছু আছে। কিন্তু শোনা যাচ্ছে ব্যাংকিং সেক্টরে বিনিয়োগযোগ্য তহবিলের অভাব রয়েছে। ফলে তারা প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করতে পারছে না। উদ্যোক্তারা বলছেন,আমরা যে অর্থ ব্যয় করে মেশিনারি আনবো কিন্তু আমাদের ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল কে দেবে? কেউ কেউ বলছেন,তাদের মধ্যে নতুন করে বিনিয়োগের ব্যাপারে এক ধরনের আস্থার অভাব রয়েছে। তারা কম্পিটিটিভ হতে পারবেন কিনা। সেটা সুদের উচ্চ হারের কারণেও হতে পারে। সরকারের দলমুখিতাও একটি কারণ হতে পারে। সব সরকারই দলমুখিতা প্রদর্শন করে থাকেন। এ কারণে যারা সরকারের কিছুটা বিরাগভাজন অথচ বড় শিল্পপতি তারা নতুন করে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না।
দৈনিক জাগরণ : বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের বিদেশে বিনিয়োগের প্রতণতা আছে। আগামীতে এই প্রবণতা আরো বেড়ে যাবার সম্ভাবনা আছে কি?
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : এটা কিন্তু একটি শক্ত কাঠামোর মধ্যে আছে। একটি শক্তিশালি কমিটির মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় কাউকে বিদেশ থেকে ঋণ আনতে দেয়া হবে কিনা। অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে এই কমিটি গঠিত হয়। কাজেই যে কেউ ইচ্ছে করলেই বিদেশ থেকে ঋণ আনতে পারছে না। তবে স্থানীয় উদ্যোক্তারা বিদেশে বিনিয়োগ করতে পারবেন কিনা সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি মনে করে,বিদেশে বিনিয়োগ করা হলে পুঁজির নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকবে এবং সেখান থেকে মুনাফা দেশে আনা যাবে তাহলে তারা অনুমতি প্রদান করে।
দৈনিক জাগরণ : চলতি অর্থ বছরে আমরা আশা করছি,৮ দশমিক ১৩ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে। কিন্তু আমরা প্রত্যক্ষ করছি দেশে যে হারে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে সেভাবে বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। ফলে ধন বৈষম্য ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ব্যাপারে আপনার মতামত জানতে চাই?
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে উচ্চ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। অর্থনীতির অন্যান্য সূচকও বেশ ভালো। কিন্তু সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, বিত্তবান এবং বিত্তহীনের ব্যবধান বৃদ্ধি পাচ্ছে আশঙ্কাজনকভাবে। গিনি কোয়েফিশিয়েন বা গিনি সহগ দিয়ে এটা পরিমাপ করা হয়। বিত্তবান-বিত্তহীনের ব্যবধান দশমিক ৪ পর্যন্ত সহনীয় বলে মনে করা হয়। আমাদের দেশে এটা বর্তমানে দশমিক ৫ এর কাছাকাছি রয়েছে। এটা অসহনীয় একটি অবস্থা। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে এ ধরনের ব্যবধান থাকাটা ঠিক নয়। সিপিডি’র একটি গবেষণায় পাওয়া গেছে,আমাদের দেশে যে অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে তার সুফল ভোগ করছে দেশের উচ্চ পর্যায়ের শতকরা ৫ ভাগ মানুষ। আমাদের দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২২ শতাংশ। এখন হয়তো সেটা সাড়ে ২১ শতাংশ। দারিদ্র্য বিমোচনের হার কিছুটা হলেও একই স্থানে স্থির হয়ে আছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের এসএমই খাতের উপর বিশেষ জোর দিতে হবে। একই পণ্য যদি বড় শিল্প-কারখানায় উৎপাদিত হয় তাহলে তার ইউনিট প্রতি উৎপাদন ব্যয় কম হয়। একই পণ্য ছোট আকারের শিল্পে উৎপাদিত হলে উৎপাদন খরচ বেশি হয়। এই অবস্থা ছোট শিল্প-কারখানা টিকে থাকতে পারে না। এ জন্য জাপান বা অন্যান্য উন্নত দেশে এসএমই শিল্পে নানা ধরনের আর্থিক প্রণোদনা দেয়া হয়। কৃষি খাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রণোদনা দিয়ে যেমন এই খাতকে জাগিয়ে তুলেছেন। ক্ষুদ্র শিল্পের ক্ষেত্রেও এমন ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। এ ছাড়া সাব কন্ট্রাক্টিং পদ্ধতিতে পণ্য উৎপাদন ব্যবস্থার উপর জোর দিতে হবে। বিশেষ করে জাপানের মতো দেশে সাব কন্ট্রাক্টিং খুবই গ্রহণযোগ্য একটি উৎপাদন পদ্ধতি। জাপানের বড় বড় কোম্পানিগুলো নিজেরা পণ্য উৎপাদন না করে ছোট ছোট কোম্পানি থেকে তাদের নিজস্ব স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী পণ্য তৈরি করিয়ে নেয়। তবে সর্বাবস্থায় পণ্যের গুনগত মান বজায় রাখা হয়। আমাদের দেশেও সাব কন্ট্রাক্টিং ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে।
আপনার মতামত লিখুন :