রমজান মাস এলেই বিভিন্ন দেশে ইফতার আয়োজনে বৈচিত্র্যময় ঐতিহ্যবাহী খাবারের প্রচলন দেখা যায়। বাংলাদেশে সাধারণত খেজুর দিয়ে রোজা ভাঙার পর ছোলা, বেগুনি, আলুর চপ, মুড়ি ও শরবত খাওয়ার রীতি রয়েছে। যদিও ধর্ম এক, তবে ভিন্ন সংস্কৃতির কারণে প্রতিটি দেশের ইফতার আয়োজনেও থাকে আলাদা স্বকীয়তা। আসুন, জেনে নেওয়া যাক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইফতারে কী ধরনের খাবার খাওয়া হয়।
বাংলাদেশ
বাংলাদেশে ইফতারে সাধারণত ছোলা, বেগুনি, পেঁয়াজু, সমুচা, আলুর চপ, খেজুর, মুড়ি, দই-চিড়া এবং বিভিন্ন ধরনের ফল খাওয়া হয়। সঙ্গে শরবত বা লেবুর পানি থাকে।
সৌদি আরব

সৌদির ইফতার সাধারণত “গাহওয়া” নামক অ্যারাবিক কফি ও খেজুর দিয়ে শুরু হয়। মাগরিবের নামাজের পর তারা ভারী খাবার গ্রহণ করেন। জনপ্রিয় খাবারের মধ্যে রয়েছে আসিদাহ, মারগগ, মাফরৌক ও মাতাজিজ, যা বাদামি আটা, গরুর মাংস, সবজি, মধু, পেঁয়াজ ও ঘি দিয়ে তৈরি হয়।
তুরস্ক
তুরস্কের ইফতার আয়োজনে দোলমা অন্যতম একটি পদ। ‘দোলমা’ শব্দের অর্থ ‘ভরা’ বা ‘স্টাফড’। এই খাবারে আঙুরপাতা, বেলপেপার বা ক্যাপসিকামের ভেতরে চাল, মসলা ও কিমা করা মাংস ভরে রান্না করা হয়। সাধারণত এটি ঠান্ডা অবস্থায় অ্যাপেটাইজার হিসেবে পরিবেশন করা হয়, তবে দইয়ের সঙ্গে প্রধান খাবার হিসেবেও খাওয়া যায়। ইফতারে হালকা ও সুস্বাদু কিছু খেতে চাইলে দোলমা বেশ জনপ্রিয়।
মিসর
মিসরের অন্যতম জনপ্রিয় ইফতারি কাতায়েফ, যা একধরনের মিষ্টান্ন। এটি দেখতে প্যানকেকের মতো, তবে এর ভেতরে মিষ্টি চিজ বা বাদাম ভরে ভাজা হয় যতক্ষণ না সোনালি ও মচমচে হয়ে ওঠে। এরপর সিরা বা চিনির সিরাপ মেখে পরিবেশন করা হয়। কাতায়েফের দুটি ধরন আছে—ভাজা কাতায়েফ, যা বাইরে মচমচে ও ভেতরে নরম, এবং বেক করা কাতায়েফ, যা কেকের মতো স্পঞ্জি। মিসর থেকে শুরু হলেও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে এই খাবার বেশ জনপ্রিয়।
ইরান
ইরানের ৯২% জনসংখ্যা মুসলিম। ইফতারে রুটি, স্যুপ, কাবাব ছাড়াও জাফরানের সুগন্ধিযুক্ত পার্শিয়ান হালুয়া ও “শোলেহ জার্দ” নামক জাফরান চালের পুডিং বেশ জনপ্রিয়। সেইসঙ্গে তাবরেজি চিজ, জুলবিয়া (জিলাপি) ও বামিয়েহ নামের মিষ্টান্নও ইফতারে থাকে।
ইন্দোনেশিয়া
ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিম জাভার জনপ্রিয় খাবার মি গ্লোসর, যা ইফতারিতে প্রচলিত। এটি একধরনের নুডলস, যার নামের অর্থ ‘স্লাইড’ বা ‘পিছলে পড়া’। মসৃণ ও নরম টেক্সচারের কারণে এমন নামকরণ। এই বিশেষ নুডলস কাসাভা ময়দা ও হলুদ দিয়ে তৈরি হয়, যা স্বাদ ও রঙে গমের নুডলসের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
মরক্কো
মরক্কোর ঐতিহ্যবাহী ইফতারি হারিরা, যা একধরনের সুস্বাদু ও পুষ্টিকর স্যুপ। এটি সাধারণত খেজুর ও মিষ্টি পেস্ট্রির সঙ্গে পরিবেশন করা হয়। হারিরা তৈরি হয় মসুর ডাল, ছোলা, টমেটো, পেঁয়াজ, আদা, হলুদ, দারুচিনি ও নানা সুগন্ধি মসলা দিয়ে। ধীরে ধীরে রান্নার ফলে এটি ঘন ও সুস্বাদু হয়ে ওঠে। শেষে ময়দা ও ডিমের কুসুম দিয়ে স্যুপটি আরও ঘন করা হয়। দীর্ঘ সময় রোজা রাখার পর হারিরা শরীরে শক্তি জোগায় এবং স্বস্তি দেয়।
নাইজেরিয়া
নাইজেরিয়ায় মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় ১০ কোটি। ইফতারে সাধারণত শর্করাজাতীয় খাবার ও ফলমূল প্রাধান্য পায়। ঐতিহ্যবাহী খাবারের মধ্যে রয়েছে জল্লফ রাইস, মই মই (এক ধরনের পুডিং), ইয়াম (আলুর মতো খাবার), মাসা (রাইস কেক), ইলুবো এবং আমালা (ইয়াম দিয়ে তৈরি বিশেষ খাবার)।
মালয়েশিয়া
নাসি লেমাক হলো মালয় রন্ধনপ্রণালীতে উৎপত্তিপ্রাপ্ত একটি খাবার যা নারকেলের দুধ এবং পান্ডান পাতায় রান্না করা সুগন্ধি ভাত দিয়ে তৈরি। এছাড়া মালয়েশিয়ায় জনপ্রিয় ইফতার আইটেমের মধ্যে রয়েছে রেন্ডাং, গোরেঙ্গান এবং বিভিন্ন ধরনের স্থানীয় ফলের শরবত।
আফগানিস্তান
আফগানিস্তানে ইফতারে রুটির সঙ্গে শোরবা, কাবাব, সামোসা, ফল এবং নানা রকমের দুধ-মিশ্রিত পানীয় খাওয়া হয়।
পাকিস্তান
পাকিস্তানের প্রায় ২৪ কোটি মানুষ মুসলিম, যা মোট জনসংখ্যার ৯৮% এর বেশি। এখানে ইফতারের সময় পানি ও খেজুরের পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী মাংস-রুটি, কাবাব, তান্দুরি ও টিক্কা জনপ্রিয়। বিশেষত, হালিম অন্যতম প্রিয় পদ, যা মসুর ডাল, গম ও মাংস দিয়ে তৈরি হয় এবং এতে স্বাদ বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন মসলা যোগ করা হয়।
বিশ্বের প্রতিটি দেশেই ইফতারের খাবারে থাকে নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ছোঁয়া।
একুশে সংবাদ/আ.ট/এনএস
আপনার মতামত লিখুন :