২৫ মে ১১ জ্যৈষ্ঠ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের জন্মদিন। সাম্য,মৈত্রী,মানবতার জাগরণ ও শোষণ, বঞ্চনা নিপিড়ন, ধর্মের নামে অধর্ম, সাম্প্রদায়িক অশুভ শক্তি, স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ছিল তার সংগ্রাম। আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী। ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৮৯৯ খৃস্টাব্দের ২৫ মে কাজী নজরুল ইসলাম অবিভক্ত বাংলার বর্তমান পশ্চিম বঙ্গের, বর্ধমান জেলার,আসানসোল মহকুমার, চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। যা ছিল ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি। ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং নজরুল’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে এবার জাতীয় কবির জন্মবার্ষিকী উদযাপিত হচ্ছে।
দারিদ্রের নির্মম কষাঘাতে বাল্যকালে "দুখু মিয়া " নির্মম বাস্তবতাকে চিনে নেয়। মাত্র ৯ বছর বয়সে পিতৃহারা নজরুল পৃথিবীর পাঠশালায় পাঠ নিতে শুরু করেন। বালক বয়সে জীবিকা নির্বাহ করতে নজরুল `মাজারের পরিচর্চ্চা,মসজিদের মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করেন। এক সময়ে রুটির দোকানে কাজ নেয় সে। সেখানেই পরিচয় হয় দারোগা রফিজুল্লাহ`র সাথে। নজরুলের লেখা কবিতা শুনে তার প্রতি মমতায় ভরে উঠে রফিজুল্লাহ’র মন। ১৯১৪ খৃস্টাব্দে দারোগা রফিজুল্লাহ তার গ্রামের বাড়ী ময়মনসিংহের ত্রিশালে নিয়ে আসেন কবিকে। ত্রিশালের দরিরামপুর হাইস্কুলে ৮ম শ্রেনীতে ভর্তি করে দেওয়া হয় নজরুল কে। আবার আসানসোল ফিরে গিয়ে১৯১৭ খৃস্টব্দে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয় নজরুল।
সামরিক জীবনে কবি `ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের, ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে, ৪৯তম বেঙ্গল রেজিমেন্টে হাবিলদার পদে চাকুরী করেন ১৯১৭ থেকে ১৯২০ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ গ্রহন করে নজরুল। যুদ্ধের দামামা, রক্তাত্ব প্রান্তর তাকে অস্থির করে। কখনো সৈনিক পুরুষ, আবার শ্রমিক,কবি, প্রাবন্ধিক, সুরকার, গীতিকার, শিল্পী, বিদ্রোহী, রাজবন্দী, সবকিছুতেই মিশে ছিলেন তিনি। বাংলা সাহিত্যে যে রত্ন ভান্ডারে সম্মৃদ্ধ করে গেছেন হাজার বছরেও তার শেষ হবার নয়। গানের বুলবুলি হয়ে বাংলা গানে " নজরুল গীতি " এক অমিয় সংযোজন। আবার প্রেমের দেবতা হয়ে রাঙ্গিয়েছেন অন্তর। পবিত্র করেছেন ভালবাসার স্বপ্ন খেয়া পারাপার। কোথায় ছিলনা তার সৃষ্টির বন্ধনা। কবিতা, গান, নাটক, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, এমনকি তার লেখা চিঠি গুলি বাংলা সাহিত্যের এক রত্ন ভান্ডার। কালজয়ী সৃষ্টি নজরুলের। রাজদ্রোহী হয়ে নজরুল কাঠ গড়ায় দাড়িয়ে "রাজ বন্দির জবান বন্ধি" নামক যে বক্তব্য রেখেছেন। বিশ্ব সাহিত্য ভান্ডারে তা এক বলিষ্ট সংযোজন। নজরুলের জীবন আলেখ্য আর সৃষ্টি কর্ম নিয়ে ক্ষুদ্র পরিসরে আলোচনার সুযোগ নেই। নজরুল কিংবা দুখু মিয়া এক মহা কাব্যের নাম। যেই কাব্যগাথ হাজার বছর ধরে বাংলা সাহিত্য অমরত্ব দিয়ে বাঁচিয়ে রাখবে। যুগের পর যুগ শতাব্দীর মোহনা পেরিয়ে নজরুলের নাম লেখা থাকবে কালের খাতায়। বাংলা সাহিত্যের অফুরন্ত ভান্ডরে নজরুল হাজার বছরের শ্রেষ্ট বাঙ্গালী।
কাজী নজরুল ইসলামের বাবার নাম `ফকির আহাম্মদ ও মাতা জাহেদা খাতুন। কবি`র দাম্পত্য সঙ্গিনী ছিলেন "প্রমীলা দেবী ও নার্গিস আসার খানম। কাজী নজরুল ইসলামের নাগরিকত্ব ও জাতীয়তা ছিল, ব্রিটিশ ভারতীয়, ভারতীয় ও বাংলাদেশী।
তিনি ১৯৭৬ খৃস্টাব্দে একুশে পদক,১৯৭৭ খৃস্টাব্দে স্বাধীনতা পুরস্কার ও পদ্ধভুষণ পদক পান। এই ক্ষণজন্মা মানুষটি মাত্র ৭৭ বছর বয়সে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় মৃত্যু বরণ করে। তার সমাধী রয়েছে `ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ প্রাঙ্গনে ।
‘চেতনায় নজরুল’
দ্রোহের কবি, প্রেমের কবি, জাগরণের কবি
শোষণ, বঞ্চনা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার তার ছবি।
মুক্তির অবারিত বাণী ছিল তার মুখে
সাম্য,মৈত্রী মানবতার গান গেয়েছে সুখে দুঃখে।
অপশাসন, আধিপত্য বাদ, স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে
তার কলম গিয়েছে সদাই যুদ্ধে।
‘রাজবন্দীর জাবানবন্দী ’ আমার উপর অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী। তাই আমি আজ রাজকারাগারে বন্দি এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত।... আমি কবি,আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন, আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা ভগবানের বাণী। সেবাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যাদ্রোহী নয়। সত্যের প্রকাশ নিরুদ্ধ হবে না। আমার হাতের ধূমকেতু এবার ভগবানের হাতের অগ্নি-মশাল হয়ে অন্যায় অত্যাচার দগ্ধ করবে...।
‘আমার হাতের বাঁশি কেড়ে নিলেই সে বাঁশির মৃত্যু হবে না।’ কেননা আমি আর এক বাঁশি নিয়ে বা তৈরি করে তাতে সেই সুর ফোটাতে পারি। সুর আমার বাঁশির নয়, সুর আমার মনে এবং বাঁশির সৃষ্টির কৌশলে, অতএব দোষ বাঁশির নয়, সুরেরও নয়, দোষ তার, যিনি আমার কণ্ঠে তার বীণা বাজান, ... সে বাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে। কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়। সত্যদ্রোহী নয়। সে বাণী রাজদ্বারে দণ্ডিত হতে পারে। কিন্তু ধর্মের আলোকে ন্যায়ের দুয়ারে তা নিরপরাধ, নিষ্কলুষ, অম্লান, অনির্বাণ, সত্যস্বরূপ। ...তাকে শাস্তি দেয়ার মতো রাজশক্তি বা দ্বিতীয় ভগবান নেই। তাকে বন্দী করার মতো পুলিশ বা কারাগার আজো সৃষ্টি হয়নি। ...বিচারক জানে আমি যা বলছি, যা লিখেছি, তা ভগবানের চোখে অন্যায় নয়, ন্যায়ের এজলাসে মিথ্যা নয়। কিন্তু হয়তো সে শাস্তি দেবে। কেননা সে সত্যের নয়, সে রাজার। সে ন্যায়ের নয়, সে আইনের। সে স্বাধীন নয়, সে রাজভৃত্য। তবু জিজ্ঞাসা করছি, এই বিচারাসন কার? রাজার না ধর্মের? এই যে বিচার, এ বিচারের জবাবদিহি করতে হয় রাজাকে, না তার অন্তরের আসনে প্রতিষ্ঠিত বিবেককে, সত্যকে? ভগবানকে? এ বিচারককে কে পুরস্কৃত করে? রাজা, না ভগবান? না আত্মপ্রসাদ?
আজ ভারত পরাধীন। তার অধিবাসীবৃন্দ দাস। এটা নির্জলা সত্য। কিন্তু দাসকে দাস বললে, অন্যায়কে অন্যায় বললে এ রাজত্বে তা হবে রাজদ্রোহ। এত ন্যায়ের শাসন হতে পারে না, এই যে জোর করে সত্যকে মিথ্যা, অন্যায়কে ন্যায়, দিনকে রাত বলানো এটা কি সত্য সহ্য করতে পারে? এ শাসন কি চিরস্থায়ী হতে পারে? এত দিন হয়েছিল, হয়তো সত্য উদাসীন ছিল বলে। কিন্তু আজ সত্য জেগেছে, তা চুষ্মান জাগ্রত-আত্মা মাত্রই বিশেষ রূপে জানতে পেরেছে। এই অন্যায় শাসনকিষ্ট বন্দী সত্যের পীড়িত ক্রন্দন আমার কণ্ঠে ফুটে উঠেছিল বলেই আমি রাজদ্রোহী?
রাজবন্দীর জবানবন্দী কাজী নজরুল ইসলাম লিখিত একটি প্রবন্ধ। নজরূল সম্পাদিত অর্ধ-সাপ্তাহিক ধূমকেতু ১৯২৩ সালে ব্রিটিশ সরকার নিষিদ্ধ করে। সেই পত্রিকায় প্রকাশিত নজরুলের কবিতা আনন্দময়ীর আগমনে ও নিষিদ্ধ হয়। নজরুলকে জেলে আটক করে রাখার পর তার বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি লিখিতভাবে আদালতে উপস্থাপন করেন চার পৃষ্ঠার বক্তব্য। তাই রাজবন্দীর জবানবন্দী নামে পরিচিত। ১৯২৩ সালের ৭ ই জানুয়ারি কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে বসে তিনি এই চার পৃষ্ঠার জবানবন্দী রচনা করেন। ১৯২৩ খৃষ্টাব্দে ধুমকেতু, প্রবর্তক, উপাসনা সহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তা প্রকাশিত হয়।
বাংলা ও বাঙালির অহংকার বিদ্রোহী কবি নজরুল । অনন্ত প্রেম,আর দ্রোহের আগুন,কবিতা, গান, উপন্যাস, গল্প সর্বত্রই মানবমুক্তি প্রেম ও দ্রোহের বাণী। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার পাশাপাশি সামাজিক বৈষম্য, শোষণ, বঞ্চনা, কুসংস্কার, হীনম্মন্যতার বিরুদ্ধেও শিখিয়েছেন রুখে দাঁড়াতে।
জাতীয় কবি নজরুল দরিদ্র পরিবারে জন্ম নিয়েও ছিলেন অসাম্য, অসুন্দর ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে অক্লান্ত বিদ্রোহী চির উন্নত শির। বাংলা কাব্যে এক নতুন যুগের স্রষ্টা নজরুল পরাধীন ব্রিটিশ ভারতে মুক্তির বাণী বয়ে এনেছিলেন তার কাব্যে। সূচনা করেছিলেন এক নতুন যুগের। ‹অগ্নিবীণা›, ‹বিষের বাঁশী› আর ‹ভাঙ্গার গান› ‘যৌবনের জয়গান’ গেয়ে জাগিয়ে তুলেছিলেন তিনি গোটা উপমহাদেশের মানুষকে। ১৯২১ সালে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখে সে সময়ে ব্রিটিশ শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। বিদ্রোহী কবিতার জন্য কারাবরণ করেন সে। কিন্তু কখনোই ঔপনিবেশিক শাসনের কাছে মাথা নত করেননি। ঔপনিবেশিক শাসনের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্য উজ্জ্বীবিত করতে বারবার গেয়েছেনÑ বলবীর, বল উন্নত মম শির। শির নেহারি আমারি নতশির, ওই শিখর হিমাদ্রির।’
বাংলা গানের জগতে নজরুল সুর ও বাণীর ক্ষেত্রে ঘটিয়েছেন এক অনন্য বিপ্লব। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ২৪ মে কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে ঘোষণা করা হয় জাতীয় কবি হিসেবে। ১৯৭৬ সালে মৃত্যু বরণ করলে কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করা হয়। মৃত্যুর আগে তিনি লিখেছিলেন- “মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই, যেন গোরে হতে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই।
জাতীয়ভাবে নজরুল জন্মজয়ন্তী পালনসহ দেশে-বিদেশে বিভিন্ন সংগঠন দিনটিকে স্মরণ করবে নানা আয়োজনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন মসজিদ প্রাঙ্গণে নজরুলের মাজারে সকালে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে শুরু হবে জন্মদিনের কর্মসূচি। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে কবিকে নিয়ে নিবন্ধ। বাংলাদেশ বেতার, টেলিভিশনসহ বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশনে প্রচারিত হচ্ছে বিশেষ অনুষ্ঠান মালা।
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় তিন দিনব্যাপি অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে। আজ বিকেল ৪টায় রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরে এই আয়োজনের উদ্বোধন করা হবে। এছাড়াও জাতীয় কবির স্মৃতি বিজড়িত ময়মনসিংহের ভালুকা কুমিল্লার দৌলতপুরসহ বিভিন্ন স্থানে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় ও স্থানীয় প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় যথাযোগ্য মর্যাদায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫ তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করা হবে। এ উপলক্ষে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে স্থানীয় প্রশাসন। কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকী যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এমব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- কবির মাজারে পুষ্পস্তবক অর্পণ, আলোচনা সভা ও সঙ্গীতানুষ্ঠান।
জাতীয় কবির জন্মদিন উপলক্ষে পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা কর্মসূচির আয়োজন করেছে।
কবির সৈনিক জীবন
১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষদিকে নজরুল সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। প্রথমে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে এবং পরবর্তীতে প্রশিক্ষণের জন্য সীমান্ত প্রদেশের নওশেরায় যান। প্রশিক্ষণ শেষে করাচি সেনানিবাসে সৈনিক জীবন কাটাতে শুরু করেন। তিনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষভাগ থেকে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রায় আড়াই বছর। এই সময়ের মধ্যে তিনি ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাধারণ সৈনিক কর্পোরাল থেকে কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পর্যন্ত হয়েছিলেন। উক্ত রেজিমেন্টের পাঞ্জাবী মৌলবির কাছে তিনি ফার্সি ভাষা শিখেন। এছাড়া সহ-সৈনিকদের সাথে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র সহযোগে সঙ্গীতের চর্চা অব্যাহত রাখেন, আর গদ্য-পদ্যের চর্চাও চলতে থাকে একই সাথে। করাচি সেনানিবাসে বসে নজরুল যে রচনাগুলো সম্পন্ন করেন তার মধ্যে রয়েছে, বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী (প্রথম গদ্য রচনা), মুক্তি (প্রথম প্রকাশিত কবিতা); গল্প: হেনা, ব্যথার দান, মেহের নেগার, ঘুমের ঘোরে, কবিতা সমাধি ইত্যাদি। এই করাচি সেনানিবাসে থাকা সত্ত্বেও তিনি কলকাতার বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে প্রবাসী, ভারতবর্ষ, ভারতী, মানসী, মর্ম্মবাণী, সবুজপত্র, সওগাত এবং বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা। এই সময় তার কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং ফার্সি কবি হাফিজের কিছু বই ছিল। এ সূত্রে বলা যায় নজরুলের সাহিত্য চর্চার হাতেখড়ি এই করাচি সেনানিবাসেই। সৈনিক থাকা অবস্থায় তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন। এ সময় নজরুলের বাহিনীর ইরাক যাবার কথা ছিল। কিন্তু যুদ্ধ থেমে যাওয়ায় আর যাননি। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে যুদ্ধ শেষ হলে ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেয়া হয়। এরপর তিনি সৈনিক জীবন ত্যাগ করে কলকাতায় ফিরে আসেন।
কবির সাংবাদিক জীবন
তরুণ নজরুল যুদ্ধ শেষে কলকাতায় এসে নজরুল ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে বসবাস শুরু করেন। তার সাথে থাকতেন এই সমিতির অন্যতম কর্মকর্তা মুজফ্ফর আহমদ। এখান থেকেই তার সাহিত্য-সাংবাদিকতা জীবনের মূল কাজগুলো শুরু হয়। প্রথম দিকেই মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, উপাসনা প্রভৃতি পত্রিকায় তার কিছু লেখা প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে উপন্যাস বাঁধন হারা এবং কবিতা বোধন, শাত-ইল-আরব, বাদল প্রাতের শরাব, আগমনী, খেয়া-পারের তরণী, কোরবানি, মোহরর্ম, ফাতেহা-ই-দোয়াজ্দম্, এই লেখাগুলো সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়। এর প্রেক্ষিতে কবি ও সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার মোসলেম ভারত পত্রিকায় তার খেয়া-পারের তরণী এবং বাদল প্রাতের শরাব কবিতা দুটির প্রশংসা করে একটি সমালোচনা প্রবন্ধ লিখেন। এ থেকেই দেশের বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সমালোচকদের সাথে নজরুলের ঘনিষ্ঠ পরিচয় শুরু হয়। বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে কাজী মোতাহার হোসেন, মোজাম্মেল হক, কাজী আবদুল ওদুদ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, আফজালুল হক প্রমুখের সাথে পরিচয় হয়। তৎকালীন কলকাতার দুটি জনপ্রিয় সাহিত্যিক আসর গজেনদার আড্ডা এবং ভারতীয় আড্ডায় অংশগ্রহণের সুবাদে পরিচিত হন অতুলপ্রসাদ সেন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, শিশিরকুমার ভাদুড়ী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নির্মেলন্দু লাহিড়ী, ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ওস্তাদ করমতুল্লা খাঁ প্রমুখের সাথে। ১৯২১ সালের অক্টোবর মাসে তিনি শান্তিনিকেতনে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তখন থেকে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু পর্যন্ত তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় ছিল। কাজী মোতাহার হোসেনের সাথে নজরুলের বিশেষ বন্ধুত্ব গড়ে উঠে।
নজরুল সঙ্গীতের স্বরলিপি গ্রন্থের প্রচ্ছদ চিত্র। নজরুল নিজেই স্বরলিপি করেছিলেন। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই ১২ তারিখে নবযুগ নামক একটি সান্ধ্য দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হওয়া শুরু করে। অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রকাশিত এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন শেরে-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক এই পত্রিকার মাধ্যমেই নজরুল নিয়মিত সাংবাদিকতা শুরু করেন। ঐ বছরই এই পত্রিকায় "মুহাজিরীন হত্যার জন্য দায়ী কে" শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেন যার জন্য পত্রিকার জামানত বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং নজরুলের উপর পুলিশের নজরদারী শুরু হয়। যাই হোক সাংবাদিকতার মাধ্যমে তিনি তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পান। একইসাথে মুজফ্ফর আহমদের সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমিতিতে যোগদানের মাধ্যমে রাজনীতি বিষয়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পেয়েছিলেন। বিভিন্ন ছোটখাটো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কবিতা ও সঙ্গীতের চর্চাও চলছিল একাধারে। তখনও তিনি নিজে গান লিখে সুর দিতে শুরু করেননি। তবে ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গীতজ্ঞ মোহিনী সেনগুপ্তা তার কয়েকটি কবিতায় সুর দিয়ে স্বরলিপিসহ পত্রিকায় প্রকাশ করছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে: হয়তো তোমার পাব দেখা, ওরে এ কোন স্নেহ-সুরধুনী- সওগাত পত্রিকার ১৩২৭ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যায় তার প্রথম গান প্রকাশিত হয়। গানটি ছিল: "বাজাও প্রভু বাজাও ঘন"।
পারিবারিক জীবন
১৯২১ সালের এপ্রিল-জুন মাসের দিকে নজরুল মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে গ্রন্থ প্রকাশক আলী আকবর খানের সাথে পরিচিত হন। তার সাথেই তিনি প্রথম কুমিল্লার বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে আসেন। আর এখানেই পরিচিত হন প্রমীলা দেবীর সাথে যার সাথে তার প্রথমে প্রণয় ও পরে বিয়ে হয়েছিল।
তবে এর আগে নজরুলের বিয়ে ঠিক হয় আলী আকবর খানের ভগ্নী নার্গিস আসার খানমের সাথে। বিয়ের আখত সম্পন্ন হবার পরে কাবিনের নজরুলের ঘর জামাই থাকার শর্ত নিয়ে বিরোধ বাধে। নজরুল ঘর জামাই থাকতে অস্বীকার করেন এবং বাসর সম্পন্ন হবার আগেই নার্গিসকে রেখে কুমিল্লা শহরে বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে চলে যান। তখন নজরুল খুব অসুস্থ ছিলেন এবং প্রমিলা দেবী নজরুলের পরিচর্যা করেন। এক পর্যায়ে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
একুশে সংবাদ/হ.ক.প্র/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :