AB Bank
ঢাকা শনিবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫, ৩ মাঘ ১৪৩০

সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

Ekushey Sangbad
ekusheysangbad QR Code
BBS Cables
Janata Bank
  1. জাতীয়
  2. রাজনীতি
  3. সারাবাংলা
  4. আন্তর্জাতিক
  5. অর্থ-বাণিজ্য
  6. খেলাধুলা
  7. বিনোদন
  8. শিক্ষা
  9. তথ্য-প্রযুক্তি
  10. অপরাধ
  11. প্রবাস
  12. রাজধানী

উজিরপুরের ‘গানের বাড়ি’র মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়


Ekushey Sangbad
নিজস্ব প্রতিবেদক
০২:১৪ পিএম, ১৭ জানুয়ারি, ২০২৫
উজিরপুরের ‘গানের বাড়ি’র মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়

                                                               শাহ আলম ডাকুয়া ও মোয়াজ্জেম হোসেন

Composer Manabendra Mukhopadhyay‍‍`s musical journey - Anandabazar
মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়

উজিরপুর উপজেলা। বরিশাল বিভাগের তথা বরিশাল জেলার একটি উপজেলা ও বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের আদি ভূখণ্ড। রহমতপুরে অবস্থিত বরিশাল বিমানবন্দর থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার (ইচলাদি) উত্তর-পশ্চিমে মেজর (অব.) এমএ জলিল সেতুর পশ্চিমপাড়ে সন্ধ্যা নদীর তীরে অবস্থিত উজিরপুর উপজেলা সদর। সন্ধ্যা নদীটি ঘুরে দক্ষিণে কালিবাজার হয়ে আবার পশ্চিমে প্রবাহিত হয়ে উজিরপুর বাজার হয়ে চৌধুরীহাট, ভবানীপুর, গালা হয়ে কচা নদীতে মিশেছে (২০২৫ সালের জানুয়ারি সময়ের কথা)। সে হিসেবে উজিরপুর বাজারটি সন্ধ্যার দক্ষিণপাড়ে অবস্থিত। এ উপজেলার বুক চিড়ে চলে গেছে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক। ইচলাদি, নতুন শিকারপুর, আটিপাড়া, জয়শ্রী, সানুহার ও বামরাইল হলো মহাসড়কের উজিরপুর অংশের অন্যতম বাসস্টান্ড। ‘ইচলাদি’ উজিরপুর পৌরসভার মধ্যে অবস্থিত প্রধান বাসস্টান্ড। ইচলাদি থেকে ২ কিলোমিটার পশ্চিম-দক্ষিণে উপজেলা সদরের বাজার বা উজিরপুর বাজার। এই বাজারের দক্ষিণে বাদামতলার কাছে ছিল (বর্তমান পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ড) ‘গানের বাড়ি’ নামে মুখার্জি অর্থাৎ মুখোপাধ্যায়দের বসতবাড়ি। এই গানের বাড়ির (মুখার্জি) পরিবারের সন্তান ভারতীয় উপমহাদেশের সংগীতের দিকপাল নজরুলগীতি ও আধুনিক গানের শিল্পী মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়।

উজিরপুর বন্দরের বাদামতলা দক্ষিণে লঞ্চঘাটসংলগ্ন পশ্চিম পাশের চর এলাকায় ছিলো মুখার্জিদের বাড়ি

গানের বাড়ি :
ষাটের দশকে উজিরপুর বন্দরের বাদামতলা পর্যন্ত ছিল সন্ধ্যা নদীর উত্তরকূল। বর্তমানে উজিরপুরের দক্ষিণ প্রান্তে বিআইডব্লিউটিএর লঞ্চঘাটসংলগ্ন পশ্চিম পাশ দিয়ে ঘুরে কুমার বাড়ি থেকে ডাকবাংলো হয়ে ঠাকুরহাট-চৌমুহনী পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে একটি খাল। লঞ্চঘাটসংলগ্ন এ খালের পশ্চিম দিকে বিশাল চর রয়েছে। এ চরের উত্তরাংশে ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত দেখা যায় অনেক বসতি গড়ে উঠেছে। সন্ধ্যা নদীর কোলঘেষে এ খালের পশ্চিমপাড়েই চর ও চরের উত্তরাংশের বসতিপূর্ণ এলাকায় ছিল মুখার্জিদের বাড়ি। সন্ধ্যার কোলঘেষে মুখার্জিদের এ বাড়ি এলাকায় তখন পরিচিত ছিল ‘গানের বাড়ি’ হিসেবে। বর্তমানে জায়গাটি উজিরপুর বাজার এলাকার পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত।

স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এখানের চরে বর্তমানে (২০২৫ জানুয়ারি) অনেক বসতবাড়ি উঠেছে। এখানে গানের বাড়ি তথা মুখার্জিদের দোতলা পাকা ভবন ছিল। বনেদি পরিবার হিসেবে উপজেলায় মুখার্জিদের পরিচিতি ছিল আকাশচুম্বী। তাদের বাড়িতে বিভিন্ন পূজা-পার্বণে গান, কীর্তন, রয়ানি, জারি, ধর্মীয় অন্য গানবাজনা হতো নিয়মিত। বাড়িতে ছিল জলসাঘর। ছিল নাট্যশালাও।

সন্ধ্যা নদীর জেগে উঠা চরে এখন বসতি গড়ে উঠছে। এখানেই ছিল গানের বাড়ি

এই ‘গানের বাড়ি’র সন্তানই নজরুলগীতির প্রখ্যাত গায়ক মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় ১১ আগস্ট ১৯২৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তারা বাবা অতুলচন্দ্র তখন কলকাতার কালীঘাটে থাকতেন। ছোটবেলা কলকাতায় কাটলেও মানবেন্দ্র ‘উজিরপুর-বারোপাইকা ইউনিয়ন মডেল ইন্সটিটিউশনে (ডব্লিউ বি ইউনিয়ন মডেল ইন্সিটিউশন) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধলে ভর্তি হন। উজিরপুরের এই বিদ্যালয় (মুখার্জিদের বাড়ির কাছে) থেকে তিনি ১৯৪৬ সালে ম্যাট্রিকুলেশন (এসএসসি) পাস করেন। এবং ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার পর তিনি আবার কলকাতার বাসায় চলে যান। এবং নিজেকে সংগীত সাধনায় ব্যস্ত রাখেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। শিল্পী মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় ১৯ জানুয়ারি ১৯৯২ কলকাতায় মারা যান। 

বর্তমান (২০২৫) উজিরপুর পৌরসভার ডব্লিউ বি ইউনিয়ন মডেল ইন্সিটিউশনটি উপজেলার একমাত্র সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। ১৮৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এ স্কুলটি সন্ধ্যা নদীর অব্যাহত ভাঙনে ১৯৫৮ সালে স্থানান্তর করে ডাকবাংলোর পূর্ব পাশে আনা হয়। ওই সময় মুখার্জিদের বাড়িসহ ওই এলাকার অনেক বাড়ি-ঘর সন্ধ্যা নদীতে বিলীন হয়। 

১৯৫৮ সালে সন্ধ্যা নদীর প্রচণ্ড ভাঙনের মুখে স্কুলটিকে বর্তমান স্থানে স্থানান্তরিত করা হয় বলে স্থানীয় লোকজন ও বিশিষ্ট ইতিহাস গবেষক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বাচ্চু ফকির জানান। তিনি জানান, অনুমান করা হচ্ছে, সন্ধ্যা নদীর প্রচণ্ড ভাঙনের ফলে পূর্বেকার জনবসতি বা স্থাপনার কোনো চিহ্ন পর্যন্ত অবশিষ্ট ছিলো না। ফলে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়দের পৈত্রিক ভিটাও নদীগর্ভে চলে যায়। বর্তমানে সুনির্দিষ্ট কোনো স্থান নির্ণয় করা দুরূহ হয়ে পড়ে। বাচ্চু ফকির আরো জানান, এখানে উজিরপুর থানা (পুলিশ স্টেশন) ভবনও ছিল। এ থানা থেকে পূর্ব দিকে মুখার্জিদের বাড়ি ছিল। নদী ভাঙনের কারণে থানা কার্যালয় সরিয়ে এনে বর্তমান ডাকবাংলো এলাকায় স্থানান্তর করা হয়। মুখার্জিদের বাড়িসহ ওই এলাকার অনেক বাড়িঘর, স্থাপনা নদীতে বিলীন হয়।

বিগত ৬ এপ্রিল ২০১৭ সালে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের বংশধর আরেক প্রখ্যাত নজরুলগীতি শিল্পী মুনতারিন মহল নাড়ির টানে উজিরপুরের মাটিতে পা রাখেন। মুনতারিন তার পূর্বপুরুষদের জন্ম ভিটার সন্ধান করেন। স্থানীয় লোকজনদের সাথে কথা বলেন ‘গানের বাড়ি’ তথা মুখার্জিদের বাড়ির অস্তিত্ব প্রসঙ্গে। তাদের ভিটাবাড়ির এলাকার কতটুকু মাটিও মুনতারিন স্মৃতি হিসেবে নিয়ে যান। এসময় তার সাথে ছিলেন উজিরপুর মহিলা কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক রতন কুমার চ্যাটার্জি ও সাংবাদিক কল্যাণ কুমার চন্দ।

প্রভাষক রতন কুমার চ্যাটার্জি জানান, মুনতারিন মহলের সাথে তিনি ঘুরিয়ে তাদের (মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়দের বাড়ি) পূর্বপুরুষদের বসতবাড়ি (আনুমানিক) এলাকা দেখান। 

সাংবাদিক কল্যাণ কুমার চন্দর সাথে তার বাবা ও মুনতারিন মহল

সাংবাদিক কল্যাণ কুমার চন্দ জানান, এক সময় উজিরপুর বাজারের বাদামতলার দক্ষিণে উজিরপুর-বারোপাইকা ইউনিয়ন মডেল ইন্সটিটিউশন ছিল ৩৩ শতক জমির ওপর। সেই স্কুলের পূর্ব দিকে ছিল উজিরপুর থানা (পুলিশ) ভবন। এবং এই থানা ভবন থেকে আরো একটু দূরে পুবে ছিল ‘গানের বাড়ি’ নামে মুখার্জিদের বাড়ি। যে বাড়ির সন্তান উপমহাদেশের প্রখ্যাত নজরুলগীতির শিল্পী মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। কল্যাণ কুমার চন্দ আরো জানান, মুখার্জিদের বাড়িতে জলসাঘর ছিল। সে জলসাঘরে প্রতিনিয়তই মুখার্জিরা ছাড়া এলাকায় যারা গানবাজনা করতেন সেসব লোকজন আসতেন। তিনি এসব কথা তার বাবা ও এলাকার প্রবীণদের কাছ থেকে জানতে পেরেছেন। 

২০২৪ সালের ৪ ডিসেম্বর সাংবাদিক ও লেখক শাহ আলম ডাকুয়া, লেখক ও গবেষক মোয়াজ্জেম হোসেন, উজিরপুরের স্থানীয় সাংবাদিক, প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও উজিরপুর সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আব্দুর রহিম সরদার ও সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুর রহমান মাসুম মুখার্জিদের বসতভিটার সন্ধানে উজিরপুর লঞ্চঘাট এলাকায় যান।

তারাও ওই এলাকার লোকজনের কথা বলে নিশ্চিত হন পুরনো উজিরপুর থানা ভবনের পূর্ব দিকে একটু দূরে মুখার্জিদের বাড়ি ছিল। এবং তখন (১৯৫০ সালের দিকে) সন্ধ্যা নদী একবারে কোলঘেষেই মুখার্জিদের বাড়ি বা ‘গানের বাড়ি’র অবস্থান ছিল।

মুখার্জিদের পরিবার :

মুখার্জি বা মুখোপাধ্যায়দের মধ্যে যার নাম প্রথম আসে তিনি হলেন গজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। এই মুখুজ্যেদের বাড়িতে ছিল রমরমা অবস্থা। গজেন্দ্রনাথের স্বজন, বাড়ির অন্য লোকজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের নিত্যদিনের আড্ডার স্থান ছিল গানের বাড়ি।

পূজা-পার্বণের অনুষ্ঠান ছাড়াও কীর্তন, রয়ানি, নাটক, জারি-সারি গান লেগেই থাকতো। মুখুজ্যেদের বাড়ির নাটমণ্ডপে চলতো বিভিন্ন ধর্মীয় পার্বণ অনুযায়ী নাটকও। জলসাঘরে চলতো বিভিন্ন ধরনের গান। গজেন্দ্রনাথের ১০ ছেলের মধ্যে-রত্নেশ্বর মুখোপাধ্যায়, সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়, সত্যেশ্বর মুখোপাধ্যায়, অতুলচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কর্মকাণ্ড ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে।

রত্নেশ্বর মুখোপাধ্যায়, সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায় ছিলেন উপমহাদেশে পরিচিত সংগীত ব্যক্তিত্ব। অতুলচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ছিলেন আর্কিটেকচার ইঞ্জিনিয়ার। এই আর্কিটেকচার ইঞ্জিনিয়ার অতুল বাবুরই ছেলে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় উপমহাদেশের বাংলা আধুনিক গান ও নজরুল সংগীতের কিংবদন্তি। অতুল বাবুর ছেলে মানবেন্দ্র একাধারে সুরকার, গীতিকার, শিল্পী, সংগীত পরিচালক, সিনেমার গানে প্লেব্যাক শিল্পী। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মেয়ে মানসী মুখোপাধ্যায় বর্তমানে ভারতীয় সংগীতে এক অনন্য নাম। এই পরিবারের আরেক বংশধর নজরুল গানের শিল্পী মুনতারিন মহল। মুনতারিন মহল বাংলাদেশের প্রায় চ্যানেলেই নজরুল সংগীত পরিবেশন করেছেন।

মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মেয়ে মানসী মুখোপাধ্যায়

ভারতীয় আনন্দবাজারে মানবেন্দ্র :
মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় কলকাতায় থাকলেও নাড়ির টানে প্রায়ই চলে আসতেন গ্রামের বাড়ি বাংলাদেশের বরিশালের উজিরপুরে। সে সময় কলকাতা থেকে বরিশাল আসা ছিল সময় ও কষ্টের বিষয়। এখনকার (২০২৫) মতো যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়নি তখন।

কলকাতা থেকে তখন বাংলাদেশে ৩টি ট্রেন সার্ভিস চালু ছিল। ‘ইস্ট বেঙ্গল এক্সপ্রেস’- শিয়ালদহ থেকে গোয়ালন্দঘাট পর্যন্ত, ভায়া গেদে ও দর্শনা। ‘ইস্ট বেঙ্গল মেল’- শিয়ালদহ থেকে পার্বতীপুর পর্যন্ত, ভায়া গেদে ও দর্শনা। এবং‘বরিশাল এক্সপ্রেস’- শিয়ালদহ থেকে খুলনা পর্যন্ত, ভায়া পেট্রাপোল-বেনাপোল।

Manabendra Mukhopadhyay : নজরুল স্বয়ং গান শিখিয়েছিলেন মানবেন্দ্রকে, রইল  শিল্পীর কিছু অজানা গল্প - Manabendra Mukhopadhyay Learnt Nazrul Geeti From  Kazi Nazrul Islam And Some Of His Unknown ...

বরিশাল এক্সপ্রেসেই মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় কলকাতা থেকে খুলনা আসতেন। খুলনা থেকে স্টিমার যোগে ঝালকাঠি নেমে সেখান থেকে উজিরপুরে আসতেন। ঝালকাঠি থেকে উজিরপুরের দূরত্ব বেশি নয়। ওই আমলে ঝালকাঠি থেকে ছোট ছোট ট্রলার, নৌকা উজিরপুর বন্দরের বাদামতলায় সন্ধ্যার ঘাটে ভিড়তো।  বরিশাল এক্সপ্রেস ১৮৮৪ সালে চালু হয়। ট্রেনটি ভারতের কলকাতা শহরের সাথে বাংলাদেশের খুলনা শহরকে সংযুক্ত করত। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় এই রেলওয়ে সংযোগটি বন্ধ হয়ে যায়। 

মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নাড়ির টানে গ্রামের বাড়ি উজিরপুরে আসা-যাওয়ার বিষয়ে ভারতীয় লেখক দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায় তার এক প্রবন্ধে বিস্তারিত বলেন। দেবশঙ্করের ‘আমি এত যে তোমায় ভালবেসেছি’ লেখাটি ‘আনন্দবাজার অনলাইন’ ৬ জানুয়ারি-২০২৫ সালে প্রকাশ করে। যার কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করা হলো- 

‘ছোট থেকে এত রকমের গানের মধ্যে দিয়ে গেছেন যে, পরে সেই ভিন্নতার রেশ পড়েছে তাঁর সুরের গড়নেও। ঠাকুরদা গজেন্দ্রনাথ (মানবেন্দ্রর দাদা) ছিলেন অসম্ভব সঙ্গীতরসিক মানুষ। রজনীকান্ত সেনের সঙ্গে একই মেসে থাকতেন। নিজে ভক্তিগীতি, হরিনামের গান গাইতেন। রজনীকান্ত গান লিখে গজেন্দ্রনাথকে দেখাতেন।

বরিশালের উজিরপুরে ওঁদের যে দেশের বাড়ি, তার চণ্ডীমণ্ডপে গান লেগেই থাকত। রাধাকৃষ্ণের লীলাকীর্তন, রয়ানী গান, মনসামঙ্গলের আসর। মাঝিমাল্লারাও গান গাইত। সারিন্দা বাজিয়ে। সারিজারি ভাটিয়ালি। ‘আর কত দিন রইব দয়াল/নেবানি আমায়’। নমঃশুদ্র মাঝিরা গাইতো হরে নামসংকীর্তন।

মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের বসতবাড়ীর এলাকায় লেখক

বাবা অতুলচন্দ্র গানবাজনা না করলেও, তারই উৎসাহে দুই কাকা রত্নেশ্বর আর সিদ্ধেশ্বর গানচর্চা করতেন। ওরাই ছিলেন ‘মুখুজ্জে পরিবার’-এ কীর্তন, ধ্রুপদী গানের বাহক। কাকাদের সঙ্গে হরির লুটের আসরে রূপানুরাগ, মান, মাথুর গাইতে যেতেন ও-বাড়ির পল্টন (মানবেন্দ্রর ডাক নাম)।

কালীঘাটে জন্মেছেন, কিন্তু দেশের টান, তার সুর আমৃত্যু ভোলেননি। বলতেন, ‘‘একটু যখন বড় হইলাম, দ্যাশের জন্য মন ক্যামন করলেই তখনকার বরিশাল এক্সপ্রেসে চাইপ্যা খুলনা হইয়া স্টিমারে ঝালকাঠি দিয়া দ্যাশের বাড়ি যাইতাম।’’ (মানবেন্দ্রর বক্তব্য) একদিকে এই মায়াটান, অন্য দিকে বাড়িতে (কোলকাতা) ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, বড়ে গোলাম আলিদের আনাগোনা। জ্ঞানপ্রকাশের ডিক্সন লেনের বাড়িতে যাতায়াত, বেগম আখতার কলকাতায় এলেই হত্যে দেওয়া, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, ওস্তাদ আলি আকবর খান, পণ্ডিত চিন্ময় লাহিড়ীর সংস্পর্শে আসা, সেতারবাদক নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে নিবিড় বন্ধুতায় সব মিলিয়ে সুরের রামধনুতে যাঁর চলাচল, তাঁর রঙের খেলা যে বহুগামী হবে এ আর বিচিত্র কী!

কাকা রত্নেশ্বর ছিলেন কাজী নজরুল ইসলামের বন্ধু। কিশোর মানবেন্দ্রর কীর্তনে মুগ্ধ হয়ে নজরুল নিজে দু’টি গান শিখিয়ে দিয়েছিলেন- ‘সখী সাজায়ে রাখ লো পুষ্পবাসর’ আর ‘হে মাধব হে মাধব’। সেই নজরুলকে এক সময় বাঙালি যেন ভুলতে বসল! এই বিস্মরণ ক্রমে অসহ্য হয়ে উঠছিল মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের। ঠিক করেছিলেন যেখানেই অনুষ্ঠানে যাবেন, নজরুলের গান গাইবেন।

মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কাছে তবলা শিখতে যেতেন অরুণ কুমার ওরফে উত্তম কুমার  - জিয়ো বাংলা
উত্তম কুমার ও মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়

এ দিকে সবাই তখন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ফিল্মি গান, আধুনিক গান শুনতে চায়। পরে অনুষ্ঠানে গিয়ে ঝামেলায় জড়িয়েছেন। উঠে চলেও এসেছেন। তবু ছাড়েননি নজরুলের গান! গ্রামোফোন কোম্পানিতে রেকর্ডিং অফিসার হয়ে এলেন সন্তোষকুমার সেনগুপ্ত। ডেকে পাঠালেন মানবেন্দ্রকে। নজরুলের প্রতি অবজ্ঞা তাঁকেও বিঁধছিল। ‘বেস্ট লভ সঙ্গস অব নজরুল’ এলপি করবেন তিনি। তাতে দুটি গান গাইলেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়- ‘এত জল ও কাজল চোখে’ আর ‘বউ কথা কও’। এত বিক্রি হল যে কোম্পানি স্পেশাল ইপি করতে ডাকলেন। লেবেলে লেখা হল ‘নজরুল গীতি’। সেই প্রথম বার। আগে লেখা থাকত ‘সঙ্গস অব কাজী নজরুল’।

এর পর আবার ডাক। অত গান কোথায় পাবেন নজরুলের! বিস্তর গান লিখেছেন কবি, কিন্তু তার হদিশ কোথায়? শেষ জীবনে নজরুল তখন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। সে সময়ের কথা বলতে গিয়ে মানবেন্দ্র এক জায়গায় বলেছিলেন, ‘‘৭১ সালে বঙ্গবন্ধু (মুজিবর রহমান) এলেন বাংলায়। সে বার ক্রিস্টোফার রোডে গাইতে গেলাম কবির জন্মদিনে। রাধাকান্ত নন্দীকে নিয়ে। সেজেগুজে বসে আছেন নীরব কবি। কী ট্র্যাজিক সেই নীরবতা! ‘কুহু কুহু কুহু কোয়েলিয়া’ দিয়ে শুরু করে কত গান গেয়েছিলাম। কবির দু’চোখে জলের ধারা। কোনও কথা নেই মুখে।’’ শেষমেশ ঈশ্বরের পাঠানো দূতের মতো মানবেন্দ্রর গানজীবনে এলেন বিমান মুখোপাধ্যায়। অসংখ্য নজরুলের গানের ভাঁড়ার নিয়ে। নজরুল ভুলে যাওয়া বাঙালিকে ধাক্কা দিয়ে হুঁশে ফেরালেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। (আনন্দবাজার অনলাইন, নিবন্ধের নাম: ‘আমি এত যে তোমায় ভালবেসেছি’, ৬ জানুয়ারি, ২০২৫ সাল)

মানবেন্দ্রর কাজ:

নজরুল সংগীতে তার অবদান ও তার গান রেকর্ডিংয়ের সময়ই ‘নজরুলগীতি’ হিসেবে নজরুলের গান প্রসিদ্ধি লাভ করে। মানবেন্দ্রর আগে নজরুলের গানকে গীতি হিসেবে বলা হতো না বলা হতো ‘সংগস অব নজরুল’। ‘নজরুলগীতি’ শব্দ মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের জন্য উপমহাদেশে পরিচিতি লাভ করে।  

মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে একটি শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। মানবেন্দ্র তার স্বতন্ত্র কণ্ঠে শ্রোতাদের কাছে তাৎক্ষণিক হিট হয়েছিলেন। সেই সময়ে বাংলা আধুনিক গানের জগতে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, মান্না দে, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, অখিলবন্ধু ঘোষ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো কয়েকজন অসামান্য শিল্পীর উপস্থিতি ছিল। তিনি তার কাকা রত্নেশ্বর মুখার্জির (সঙ্গীত রত্নাকর, সঙ্গীত আচার্য, সঙ্গীত প্রভাকর) থেকে তার সঙ্গীত তালিম শুরু করেছিলেন। কাকা সিদ্ধেশ্বর মুখার্জি এবং রত্নেশ্বর মুখার্জির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিনে।

মানবেন্দ্র ১৯৫৩ সালে তার প্রথম মৌলিক ডিস্কের মাধ্যমে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছিলেন। তিনি এইচএমভির সাথে যৌথভাবে ‘ফিরে দেখো না’ এবং ‘জানি না তুমি কোথায়’ নামে তার দুটি রেকর্ড প্রকাশ করেছিলেন। গানের কথা লিখেছেন কাকা সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়। এটি কীর্তন আন্দাজের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল এবং মানবেন্দ্রকে শৈশব থেকেই কীর্তন, ভজন এবং ভক্তিগীতির প্রতি প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। তার চাচারা প্রশিক্ষিত শাস্ত্রীয় বিশেষজ্ঞ ছিলেন এবং মূলত তাদের প্রভাবের কারণে তিনি সঙ্গীত জগতে আসেন। রোমান্টিক ‘আমি এত যে তোমায় ভালবেসেছি’ (গীতিকার শ্যামল গুপ্ত) ‘এমনি করে পড়বে মনে’ (গীতিকার- শ্যামল গুপ্ত) এবং আধা ক্লাসিক্যালি ‘ঘুমায় না সহেলি গো’সহ তার বেশ কয়েকটি গান মানুষের অন্তরে দাগ কাটে। অল্প সময়ের মধ্যে, মানবেন্দ্র বাংলার তৎকালীন নেতৃস্থানীয় সঙ্গীত রচয়িতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। যথা- সলিল চৌধুরী, সুধীন দাশগুপ্ত, রবিন চ্যাটার্জি, অনোল চ্যাটার্জি, নচিকেতা ঘোষ, প্রবীর মজুমদার, জ্ঞান প্রকাশ ঘোষ, অভিজিৎ ব্যানার্জি এবং অন্যদের। 

কাজী নজরুল ইসলামের গানে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ও ছিলেন বড় পণ্ডিত। নজরুলের গানের ক্ষেত্রে প্রবল উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা পেয়েছেন আঙ্গুরবালা দেবী, ইন্দুবালা দেবীর কাছ থেকে। যারা ১৯২৯-১৯৪২ সালে কাজীদার কাছ থেকে সরাসরি নজরুলের গানের শিক্ষা লাভ করেছিলেন। মানবেন্দ্রই প্রথম মানুষ, যিনি গত শতাব্দীর ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে নজরুলের গানের ডিস্ক রেকর্ডে ‘নজরুলগীতি’ হিসেবে কোড করেছিলেন। অনেক নজরুলগীতি তার কণ্ঠে মুগ্ধ করে এবং বাংলার পাশাপাশি ভারতীয়দেরও মুগ্ধ করে। যেমন- ‘বাগিছায় বুলবুলি তুমি’, ‘মুসাফির মোছ রে আঁখি জল’, ‘আকুল হোলি কেনো’, ‘বৃথা তুমি কাহার পানে’, ‘আমার নয়নে’, ‘অরুণকান্তি কে গো’ ইত্যাদি। নজরুলগীতিকে কেন্দ্র করে একটি বিশাল প্রচেষ্টা অর্জিত হয়েছিল মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের। যা তাকে একটি প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

এই স্কুলেই মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় লেখাপড়া করেন 

ব্যক্তিগত জীবন:

বেলা মুখোপাধ্যায় মানবেন্দ্রর স্ত্রী ছিলেন। মানবেন্দ্র-বেলা দম্পতির কন্যা মানসী মুখোপাধ্যায়। মানসী মুখোপাধ্যায়ও ভারতের প্রতিষ্ঠিত গায়িকা। মানসী ১৯৬৬ সালে কোলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের পরম বন্ধু ছিলেন গীতিকার, সুরকার ও সংগীতশিল্পী শ্যামল গুপ্ত। শ্যামল গুপ্তের স্ত্রী ছিলেন আরেক সংগীত লিজেন্ড সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। পাশাপাশি থাকা এই দুই পরিবারের মধ্যে পরম সখ্যতা। 

২০২৫ সালের ডিজিটাল যুগে ইউটিউব খুললে সিদ্ধেশ্বর, মানবেন্দ্র, মানসী মুখোপাধ্যায়ের অসংখ্য গান আমাদের মোহিত করে, আন্দোলিত করে। আমরা আরো গর্বিত হই, পুলকিত হই এই ভেবে যে, উপমহাদেশের এ গুণীশিল্পীরা এই উজিরপুরের সন্তান ছিলেন। আমাদের মাটির সন্তান। এ মুখার্জি পরিবার আমাদের গর্বের পরিবার।

তথ্যসূত্র : 

‘আমরা উজিরপুরের সন্তান (আউস)’ ম্যাসেঞ্জার গ্রুপের অনেকের সাহায্য, উৎসাহ, তথ্য ও ছবি দিয়ে সহযোগিতা ছাড়া এ লেখাটি সম্পন্ন করা সম্ভব ছিল না। সহযোগিতা করেছেন সাংবাদিক ও সঙ্গীতশিল্পী উত্তমকুমার রায় (ঢাকা)। মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বাচ্চু ফকির (লেখক-গবেষক, উজিরপুর), উজিরপুরের সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আ. রহিম ও সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুর রহমান মাসুম, সাংবাদিক কল্যাণ কুমার চন্দ্র, প্রভাষক রতন কুমার চ্যাটার্জি (উজিরপুর, বরিশাল), আনন্দবাজার পত্রিকা।

একুশে সংবাদ/ এস কে

Link copied!