বাহিরে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে, আধো-আধো কোয়াশায় ডাকা ছিল সারাটা দিন।শোভা বারান্দায়ই শুয়ে ছিল একা, আমি বাজার থেকে আগেই তরিঘরি করে চলে এসেছি বৃষ্টি হবে ভেবে।সন্ধের কালো আধার এখনো ঘ্রাস করে নেয়নি দিনের আলোটুকু।
খানিক ইচ্ছে হলো শোভাকে একটু ডাকি, নিমিষেই মনে পড়লো সারাদিন বউটার উপর অনেক ধকোল গেছে।তাই হয়তো এই অবেলায় মেয়েটা এভাবে শুয়ে আছে।অপলোক দৃষ্টিতে ক্ষানিকক্ষণ বউটার দিকে তাকিয়ে রইলাম আর ভাবলাম এই অলপো বয়সে মেয়েটা কত দায়িত্ব ঘারে নিয়ে নিছে।আমার এখনো দিব্বি মনে পড়ে যখন ক্ষেতে কাজ করতে যাইতাম তখন দেখতাম মেয়েটা এ পাড়া থেকে ও পাড়া দুই পায়ের তলায় নিরন্তর ছুটে চলেছে।হয়তো কল্পনায়ও ভাবেননি এতো তারাতারি এতো দায়িত্ব কাধে নিতে হবে।
সেই ছোট বেলায় মা চলে গেছেন সংসারে বাবাই সব আগলে রেখেছিলেন কখনো আমায় বুঝতে দেয়নি মা থাকলে হয়তো আমি এটা ওটা পেতাম।গত বছর বাবা যখন ভীষণ অসুস্থ বাবার ছোট বেলার বন্ধু মানিক চাচা কে খবর দিয়ে আনতে বললেন চাচা বাবার সেই ছোট বেলার বন্ধু।দুজোন দুজোন কে ছাড়া বাচেঁনা। যখনই দেখা হয় তাদের মুখের হাসি যেন আর সরে নাহ।সেদিন আমি প্রথম বার বাবার মুখে হাসি দেখিনি।মানিক চাচাকে জরিয়ে ধরে ঐ যে কান্না জুরলেন সেই কান্নার জানো কোন ইতি খুজে পাচ্ছিলাম নাহ।বাবার কান্না দেখে নিজেকেও ধরে রাখতে পারছিলাম নাহ।কেনো জানো দুচোখের জলে বাধঁ দিতে কষ্ট হচ্ছিল । যাহোক এক প্রকার জোড় করেই মানিক চাচাকে বাবা রাজি করালেন আমার আর শোভার বিয়ের জন্য।তখন শোভার মাত্র তেরো শেষ হবে।মানিক চাচা অনেকক্ষণ বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন কিন্তু মৃত্যু পথ যাত্রী বন্ধুর কথা কিছুতেই ফেলতে পারলেন নাহ।যে মেয়েটা পুতুল খেলার বউ বানাতে ব্যস্ত তাকে বসিয়ে দেওয়া হলো বিয়ের পিড়িতে,শোভা তখন শাড়ি পরতে পারতো নাহ।কোন রকমে শাড়ির আঁচলে নিজেকে আগা গোড়া মুড়ে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসা হলো।মনে হচ্ছিল কোন মোড়ক জাত পন্য।পরের দিন বাজারে গিয়ে আমি শোভাকে কয়েকটা জামা কিনে দিয়েছিলাম,কিন্তু বাবার শাসনে মেয়েটা সাহসই পেলো নাহ।বাধ্য হয়ে ভোরের আলো ফোটার আগেই ঘুম থেকে তুলে শাড়ি পড়িয়ে দিতাম। মাঝে মাঝে খেয়াল করলে দেখতাম মেয়েটা চলতে পারতেছে নাহ।আচ্ছা ঘরের বউ কে শাড়ি পরতেই হবে এমন কি কোথাও বিধান আছে? মেয়েটা খুব অল্প দিনেই শাড়ি টা কে আয়ত্তে নিয়ে এসেছিল।আজকাল আর আমায় তাকে নিয়ে অতোশত চিন্তা করতে হয় নাহ ।আসলেই মেয়েরা মাটির পাত্রের মতো। কখনো ভাবিনি ঐ টুকু মেয়ে সবকিছু এতো সুন্দর করে সামলে নিতে পারবে।
বাবা যতদিন ছিল কখনো মায়ের কথা মনে পরে নাই।মা নেই এই ভেবে আফসোসও হয় নাই তবে আজকাল শোভাকে দেখলে মায়ের কথা খুব মনে পড়ে।মা থাকলে হয়তো এভাবেই আগলে রাখতো আমায়।বাবার চলে যাওয়ায় তেমন একটা কষ্ট হয় নাই দিন শেষে নিজের চিন্তা মগ্ন মস্তক টা রাখার জন্য একটা বিশস্ত বুক অপেক্ষা করতো বাড়ির আঙ্গিনায়।বাড়ির কাজ শেষ করে এক ঘটি পানি নিয়ে অপেক্ষা করতো কখন আমি ফিরবো বাড়ি।মাঝে মাঝে ফিরতে দেরি হলে মাথার ঘোমটা পা অবদি নামিয়ে খুজতে বেড়িয়ে পরতো। একদিন তো তাকে চিনতেই পারিনি আমি, কেউ ডাকছে আমায়, `ওই শুনছেন " পিছন ফিরতেই ঘোমটা টা তুলতেই মুচকি হাসছে।দায়িত্ব বাড়লে কি হবে ছেলে মানুষিতো যায়নি।।
মেঝেতে বিছানো পাটিতে গা লাগাতেই নিমিষে দুচোখ বন্ধ হয়ে আসছে। কিছুতেই মেলে রাখতে পারতেছিলাম না দুচোখের পাতা। কখন যে ঘুমে বিভোর হয়ে গেলাম বুঝতেই পারিনি কখন চোখটা লেগে গেলো।খোয়াবে নাকি ভবিষ্যৎ দেখা যায়, সেদিন আমি প্রথম বার খোয়াব দেখে এতোটা ঘাবড়ে গেছিলাম।দরজার ফাঁক দিয়ে পুরো উঠান টা দেখা যাচ্ছিল। হঠাৎ আলোতে মনে হলো শোভা বৃষ্টিতে ভিজছে, এই সন্ধের বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর আসবে বলতেই শোভা আমার কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো, যেন সে কিছুই জানেনা। আমার ওপর কি আপনি রাগ করছেন?আমার নাহ বলতেই সে কপালে একটা চুমু কাটলো। ফিক ফিক করে হাসতে হাসতে ভিতরে চলে গেলো।আসলে শোভা আমায় খুব ভয় পায়,আমি তাকে বকা ঝকা করলে সে এক পাহাড় সম যন্ত্রণা বয়ে চলে সারাটি দিন।
আমাদের বিয়ের প্রথম রাতে সে আমাকে জিজ্ঞাস করে ছিল আমি কি তার গায়ে কখনো হাত তুলবো,আমি যদি তার গায়ে হাত তুলি তবে সে নাকি খুব কষ্ট পাবে।সেদিনই তার সরলতা আমায় ভীষণ ভাবে মুগ্ধ করেছিল। গ্রামের মেয়েরা অতোশত নাহ বুঝলেও সংসারটা খুব অল্প বয়সেই বুঝে।আর শোভা সংসার বলতে বুঝতো পুরুষ দ্বারা নারী নির্যাতন। কথায় কথায় ঘরের বউয়ের গায়ে হাত তোলার চিত্র তার কাছে ছিল জানো নিত্য ঘটনা।আমি প্রায়শই দেখতাম মানিক চাচা মানে আমার শশুর চাচি কে কথায় কথায় অহেতুক মার-ধোর করতেন। তখন নির্বাক অশ্রু সজল শোভাকে দেখলে মনে হতো সে যদি পারতো তবে সমাজের এই ধরণের পুরুষ নামের কীট গুলোকে সে দুপায়ে পিষে বিনাশ করে ফেলতো।আমার সাথে সে বিয়েতে সম্মতি দিয়ে ছিল কারণ নাহ হলে তার পৈশাচিক বাবা মায়ের গায়ে আবার হাত তুলতেন।।।
একুশে সংবাদ//যাবিদ
আপনার মতামত লিখুন :