১৫ আগস্ট ইতিহাসের কলঙ্কিত কালো দিন। আজ থেকে ৪৮ বছর আগে ১৯৭৫ সালের এই দিনেই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবারের ১৮ জন সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এদিন দেশের বাইরে থাকায় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা প্রাণে বেঁচে যান।
স্বামী ড: এম. এ. ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে জার্মানির বনে থাকাবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার খবর প্রথম জানতে পারেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। মর্মান্তিক ঘটনাটি শোনা মাত্র শেখ হাসিনা জার্মানি নিযুক্ত রাষ্টদূতকে জিজ্ঞেস করেন, কেউ কি বেঁচে নেই? উত্তরে মাথা নাড়েন রাষ্ট্রদূত। সরাসরি দেশে আসতে না পারায় শেখ হাসিনা পুরো ঘটনাটি জানতে পারেন আরো পরে, ভারতে আসার প্লেনে উঠে খবরের কাগজ পড়ে। বঙ্গবন্ধু দুই কন্যার সঙ্গে কথা বলে ‘১৫ আগস্ট ১৯৭৫’ গ্রন্থে এ তথ্য লিখেছেন প্রয়াত সাংবাদিক বেবী মওদুদ।
শেখ হাসিনার সঙ্গে যৌথ সম্পাদনায় বেবী মওদুদের লেখা ১৯৯৬ সালের ১৫ আগস্ট প্রকাশিত এক গ্রন্থে সে সময়ের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে। ওই গ্রন্থের তথ্যানুযায়ী, ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানাকে সান্ত্বনা দেয়ার মতোও কেউ ছিল না। তারা দুই বোন নিজেদের জড়িয়ে ধরেই কেঁদেছেন। বেবী মওদুদ তার লেখায় বলেছেন, ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সময় শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দুই বোন পশ্চিম জার্মানিতে ছিলেন। শেখ হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়া তখন একটি উচ্চতর বৃত্তি নিয়ে পড়তে গিয়েছিলেন পশ্চিম জার্মানিতে। ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা হোসেন পুতুল ও ছোট বোন উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী শেখ রেহানাকে নিয়ে শেখ হাসিনা ৩০ জুলাই সেখানে যান। কিন্তু বিমানবন্দরে যাওয়ার আগেই শেখ হাসিনা বাবার নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলেছিলেন। তার মা ফজিলাতুননেছা মুজিব তখন তাকে বিদায় জানাতে গিয়ে কেঁদেছিলেন খুব। মাকে ওভাবে কাঁদতে দেখে শেখ হাসিনা তখন বলেছিলেন, তুমি এভাবে কাঁদলে আমি যেতে পারব না মা। মায়ের সে কান্নার স্মৃতি এখনও দুই বোনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে।
তিনি লিখেছেন, ব্রাসেলসে বেড়াতে গিয়ে হত্যাকাণ্ডের দুই দিন আগে ১৩ আগস্ট বাবার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন শেখ রেহানা। বলেন ঢাকায় ফিরতে চান। বঙ্গবন্ধু তাকে বলেছিলেন, দেশে ফেরার বিষয়ে রাষ্ট্রদূতকে সব ব্যবস্থা নিতে বলবেন তিনি। এরপরই ১৫ আগস্ট তাদের বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া নির্মম হত্যাকাণ্ডের খবর জানান জার্মান রাষ্ট্রদূত।
তখন দূতাবাস থেকে ড. ওয়াজেদ মিয়াকে বলা হয় অবিলম্বে বনে ফিরতে। বনে ফিরে শেখ হাসিনাকে জানানো হয়, বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে। জবাবে শেখ হাসিনা শুধু বলেন, কেউ কি বেঁচে নেই? পরে তারা ভারতে আসার সময়ে প্লেনে খবরের কাগজ পড়ে সব জানতে পারেন। জানতে পারেন কে কীভাবে নিহত হয়েছেন। বাবা-মা-ভাই হারা দুই বোন একজন আরেক জনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছেন। তাদের সান্ত্বনা দেয়ারও কেউ ছিল না।
বেবী মওদুদ লিখেছেন, ঢাকা রেডিও থেকে তখন শুধু বঙ্গবন্ধুবিরোধী কথা ও গান প্রচার করা হতো। খান আতাউর রহমান ওইসব গানের রচয়িতা ও সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন। দেশজুড়ে সব মানুষকে শুধু কাজ করার কথা বলা হতো। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউস্থ বড় রাস্তার মোড়ে দীর্ঘদিন ট্যাংক ও সৈন্য মোতায়েন ছিল। কারফিউ জারি হতো সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত। শোকাহত বাঙালির জাতীয়তাবাদ, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, মুক্তিযুদ্ধের বীরত্ব গাথা একে একে বিনষ্ট হতে থাকল।
একুশে সংবাদ/এপি
আপনার মতামত লিখুন :