জনতা ব্যাংকের গোডাউনকিপার হিসেবে ১৯৮৭ সালে যোগ দেন মো. এনায়েত উল্লাহ। ২০১০ সালে পদোন্নতি পেয়ে হন ব্যাংকটির অফিসার। ২০১৬ সালে তাকে সিনিয়র অফিসার পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। বর্তমানে তিনি অবসরোত্তর (পিআরএল) ছুটিতে আছেন।
এ সময়ের মধ্যে রাজধানীর সবুজবাগ এলাকার একটি ভবনে ১৬টি ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছিলেন তিনি। এ ছাড়া ঢাকার বিভিন্ন স্থানে তার নামে নয়টি প্লট কেনার তথ্য পাওয়া যায়। সম্পত্তি কিনতে বিভিন্ন সময় স্বল্প মেয়াদি ব্যাংক ঋণও দেখিয়েছেন তিনি। বিভিন্ন ব্যাংকের একাধিক অ্যাকাউন্টে তার অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্যও মিলেছে। আর্থিক কোম্পানিতে স্ত্রী, ছেলে ও মেয়ের নামে কোটি টাকার বেশি অর্থ বিনিয়োগের তথ্যও পাওয়া গেছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এক অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
সূত্র জানায়, ব্যাংকে চাকরি করলেও এনায়েত উল্লাহ বাইরে নিজেকে ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দিতেন। চাকরিকালে ২০০৩ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে রাজধানীর সবুজবাগে সাড়ে আট কাঠা জমি কেনেন তিনি। এর পর একটি ডেভেলপার কোম্পানির মাধ্যমে সেই জমিতে নয়তলা ভবন নির্মাণ করে তিনি ১৬টি ফ্ল্যাট পান।
এর মধ্যে পরে ১৪টি ফ্ল্যাট তিনি বিক্রি করে দেন। বাকি দুটি ফ্ল্যাট একসঙ্গে করে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন।জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা এনায়েত উল্লাহ নিজের নামে রাজধানীর নন্দীপাড়ায় ২০০৮ সালে ৬ শতাংশ জমি কেনেন। ২০০৯ সালে একই এলাকায় সাড়ে ৪ শতাংশ আরেকটি জমি কেনেন। একই বছর বাড্ডার সাতারকুল এলাকায় ৯ শতাংশ, ২০১০ সালে একই এলাকায় ৫ শতাংশ, ২০০৯ সালে নন্দীপাড়ায় ৯ শতাংশ, উত্তরার উত্তরখান এলাকায় ২০০৯ সালে ৫ শতাংশ জমি কিনেছেন।
২০১৩ সালে রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীতে একটি মার্কেটে দোকান ও বাকুশাহ হকার্স মার্কেটে আরেকটি দোকান কেনেন। এ ছাড়া চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে নিজের এলাকায় এনায়েত উল্লাহ পৈতৃক উত্তরাধীকারসূত্রে জমি পাওয়া ছাড়াও ১৯৯২ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বেশকিছু এলাকায় জমি কিনেছেন। এসব সম্পদের কিছু অংশ বিভিন্ন সময় বিক্রি করে দেন। এনায়েত উল্লাহ ২০০২-০৩ অর্থবছরে ৩ লাখ টাকা ঋণ নেন। এক বছর পর ২০০৪-০৫ অর্থ বছরে আরও ৩ লাখ টাকা ঋণ নেন।
পরের ২০০৫-০৬ অর্থবছরে ৮ লাখ, ২০১১-১২ অর্থবছরে ১৪ লাখ, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ২৪ লাখ এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪৩ লাখ টাকা ঋণ গ্রহণ করেন। এ ছাড়া জনতা ক্যাপিটাল অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড থেকে তার বিনিয়োগ করা শেয়ারের বিপরীতে ১ কোটি ৮৩ লাখ ৮২ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণের তথ্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত তার ঋণের স্থিতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১ কোটি ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা।
এ ছাড়া গত বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত এক হিসাবে দেখা যায়, ক্যাপিটাল অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টে এনায়েত উল্লাহর স্ত্রী, ছেলে ও মেয়ের নামে বিনিয়োগের স্থিতির পরিমাণ ছিল ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। যদিও তার স্ত্রী গৃহিণী এবং ছেলে-মেয়ে পড়াশোনা করেন।
দুদক সূত্রে জানা যায়, জনতা ব্যাংকের গোডাউনকিপারের দায়িত্ব থেকে বিভিন্ন গার্মেন্টসের মালামাল বিক্রি ও সিবিএ নেতা হিসেবে প্রমোশন বাণিজ্যের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা ঘুষ গ্রহণ করেছেন এনায়েত উল্লাহ। এ বিষয়ে অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দাখিল করতে ২০২১ সালের ৩০ জুন দুদকের উপ-পরিচালক অজয় কুমার সাহাকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। গত বছরের জানুয়ারিতে এই কর্মকর্তার দাখিল করা প্রতিবেদনে এনায়েত উল্লাহর অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য পাওয়া যায়নি। এ অনুসন্ধান প্রতিবেদন গ্রহণ না করে দুদক অজয় কুমার দাসকে পুনরায় অনুসন্ধানের নির্দেশ দেয়।সেই অনুসন্ধান প্রতিবেদনে সবুজবাগে এনায়েত উল্লাহর জমিতে যে ডেভেলপার কোম্পানির মাধ্যমে ভবন নির্মাণ করা হয়, সেই কোম্পানির নাম উল্লেখ করা হয়নি।
এ ছাড়া কত সালে ভবন নির্মাণ হয়, এনায়েতের পাওয়া ১৬টি ফ্ল্যাট থেকে ১৪টি ফ্ল্যাট কার কার কাছে এবং কত টাকা বিক্রি হয়েছে তা সুস্পষ্টভাবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি। বিভিন্ন কোম্পানিতে তার চার কোটি ৫৬ লাখ ৬২ হাজার ৩৩৯ টাকা বিনিয়োগ রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হলেও অর্থের উৎস সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়নি।গত জুলাই এনায়েত উল্লাহর বিরুদ্ধে আসা অভিযোগ পুনঃঅনুসন্ধানে উপ-পরিচালক মশিউর রহমানকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছে দুদক। তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করে তার জমি কেনার উৎস, বিভিন্ন কোম্পানিতে বিনিয়োগ এবং ঋণ, যে ভূমির ওপর ভবন নির্মাণ করা হয়েছে তা কত সালে কত টাকা দিয়ে কেনা হয়েছে এবং টাকার উৎস অনুসন্ধান করতে বলা হয়েছে।
জনতা ব্যাংকের অবসরোত্তর (পিআরএল) সিনিয়র অফিসার মো. এনায়েত উল্লাহ বলেন, তার কোনো অবৈধ সম্পদ নেই। সব সম্পদ আয়কর রিটার্নে ঘোষণা করা আছে। চাকরিজীবনের আয় দিয়ে, পাশাপাশি আত্মীয়-স্বজনের সহযোগিতায় এবং ব্যাংক ঋণের টাকায় জমি কিনেছিলাম। সেখানে একটি ডেভেলপার কোম্পানির মাধ্যমে ভবন নির্মাণ করে ৫০ শতাংশ, অর্থাৎ ১৬টি ফ্ল্যাট পেয়েছি। সেগুলো বিক্রি করে কয়েকটি কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছি, আবার সেগুলোর বিপরীতে ঋণও নিয়েছি।
তিনি বলেন, এক ব্যক্তির কাছে একটি ফ্ল্যাট বিক্রি করেছিলাম, তিনি ঝামেলা সৃষ্টি করেছিলেন। ওই লোক আমার বিরুদ্ধে দুদকে মিথ্যা অভিযোগ করেছে। এর পর তারা (দুদক) দুইবার তদন্ত করেছে,কিন্তু দুইবারই আমার কোনো অবৈধ সম্পদ পায়নি। এখন তৃতীয়বারের মতো তদন্ত শুরু হয়েছে, আবারও আগের মতোই রিপোর্ট আসবে, ইনশা আল্লাহ।
দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, যেহেতু বিষয়টি অনুসন্ধানাধীন, সেহেতু অনুসন্ধান শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা সম্ভব হচ্ছে না। অনুসন্ধানে যা আসবে তা যাচাই-বাছাই শেষে আইন অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
একুশে সংবাদ/স ক
আপনার মতামত লিখুন :