মেট্রোরেল চলাচলে বিরতির সময় কমিয়ে ট্রেন ও বগি বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চলাচলের সময় বাড়ানোর ফলে যানজট এড়িয়ে দ্রুত যাতায়াতের সুযোগ পাওয়ায় ভিড় বাড়ছে মেট্রোরেলে। বিশেষ করে সকালে অফিস শুরু ও বিকালে ছুটির সময়ে ট্রেনের ভেতরে তিল ধারণের ঠাঁই থাকছে না।
মেট্রোরেল সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, প্রতিদিন গড়ে প্রায় আড়াই লাখ যাত্রী মেট্রোতে চলাচল করেন। সকালে পিক আওয়ারে প্রতিটি ট্রেনে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত যাতায়াত করেন ১৮০০ থেকে ২০০০ যাত্রী। ফলে মিরপুর-ফার্মগেট-মতিঝিল রুটে যানজট অনেকটা কমে এসেছে। তবে যাত্রীদের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় মেট্রোরেলের সময় কমিয়ে ট্রেন ও বগি বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে ১০ মিনিট পরপর যে ট্রেন চালানো হচ্ছে কয়েক মাসের মধ্যে তা কমিয়ে ৮ মিনিট পরপর করা এবং প্রতিটি ট্রেনে বগির সংখ্যা চারটি থেকে বাড়িয়ে ৬টি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
একজন কর্মকর্তা জানান, প্রকল্পের চুক্তি অনুযায়ী পরিকল্পনা ছিল ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে পিক আওয়ারে প্রতি সাড়ে তিন মিনিট পরপর মেট্রোরেল চলবে। কিন্তু যাত্রীদের চাহিদার কথা বিবেচনা করে আগেই মেট্রো চালু করা হয়েছে।
তিনি জানান, প্রয়োজনীয় চালক ও জনবল এখনও তৈরি না হওয়ায় সব ট্রেন ঢাকায় আনা হলেও তা চালানো সম্ভব হচ্ছে না। কারণ চালকদের অনেকে প্রশিক্ষণে আছেন। আপাতত টার্গেট হচ্ছে এখন প্রতি ১০ মিনিট পরপর যে ট্রেন চালানো হচ্ছে এটা কমিয়ে ৮ মিনিট পরপর করা এবং প্রতিটি ট্রেনে বগির সংখ্যা চারটি থেকে বাড়িয়ে ৬টি করা। তবে ট্রেনে ৮টি বগি করা হলে স্টেশনগুলোতে যে দরজা আছে (প্ল্যাটফর্ম স্ক্রিন ডোর) সেটা ৬টি বগির জন্য করা আছে। অবশ্য স্টেশন বানানো হয়েছে ৮টি বগির জন্য। তাই আরও দুটি বগি যুক্ত করা হলে আরও ৮টি দরজা বাড়বে তখন প্রতিটি প্ল্যাটফর্মে আরও ৮টি করে স্ক্রিন ডোর বসাতে হবে। এটা ইচ্ছা করলেই এক বা দুই সপ্তাহের মধ্যে করা সম্ভব না। কারণ ১৬টি স্টেশনে ৩২টি প্ল্যাটফর্ম রয়েছে এবং প্রতিটি প্ল্যাটফর্মে নতুন ৮টি করে স্ক্রিন ডোর বসাতে হবে।
এই কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে ২৪টি ট্রেন রেডি থাকলেও এর মধ্যে মাত্র ৭ থেকে ৮টি ট্রেন চলাচল করছে। বাকিগুলো ডিপোতে রয়েছে। তাই ট্রেনে বগি বাড়ানো এবং ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়টি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ৮ মিনিট পরপর ট্রেন চালাতে বাড়তি অপারেটর প্রয়োজন, আপাতত সে বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের কোম্পানি সচিব (যুগ্ম সচিব) মোহাম্মদ আবদুর রউফ জানিয়েছেন, যাত্রীদের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ভিড় কমাতে মেট্রো ট্রেনের চলাচলের মধ্যবর্তী সময় কমানোর পাশাপাশি নতুন বগি বাড়ানোর চিন্তা করছে কর্তৃপক্ষ। প্ল্যাটফর্মের যে সিস্টেম আছে সেখানে প্রত্যেক কোচে আরও দুটি বগি যুক্ত করা যাবে। এ ছাড়া নতুন কোচের প্রয়োজন হলে সেটাও ভাবা হবে। পাশাপাশি সার্ভে করে দেখা হবে মেট্রো ট্রেন চলাচলের মধ্যবর্তী সময় আপাতত কতটা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
গত বছরের নভেম্বরের শুরু থেকে উত্তরা ও মতিঝিলের মধ্যে মেট্রোরেল চলাচল শুরু হয়। তবে ট্রেনগুলো কেবল সকাল ৭টা ১০ মি থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত চালু ছিল। এরপর চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি চলাচলের সময় বাড়িয়ে রাত ৮টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত করা হয়। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের ২০ দশমিক ১ কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিতে এখন মাত্র ৩১ থেকে ৩৫ মিনিট সময় লাগে। আগে এই রুটে বাসযাত্রীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে বসে থাকতে হতো। তাই এখন অনেকেই বাসের পরিবর্তে মেট্রোরেলকে বেছে নিয়েছেন।
মিরপুরের বাসা থেকে পল্টনের অফিসে যাতায়াত করতে আগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে যেত গণমাধ্যমকর্মী হেমায়েত হোসেনের। এখন মেট্রোরেলের সুবাদে আধঘণ্টার মধ্যেই প্রেস ক্লাবে পৌঁছে যেতে পারেন তিনি। এই রুটে যানজট কমে যাওয়ায় বাসযাত্রীদেরও প্রতিদিনের যাতায়াতে দুর্ভোগ অনেকটা কমে এসেছে। তবে মেট্রোরেলের কারণে যাত্রীদের সুবিধা হলেও বিপাকে পড়েছেন মিরপুর-মতিঝিল ও উত্তরা-মতিঝিল রুটের বাসমালিক শ্রমিকরা। যাত্রীর অভাবে ট্রিপ কমিয়ে দিতে হচ্ছে তাদের। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সহ-সভাপতি মাহবুবুর রহমান জানান, মেট্রোরেল সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চালু হওয়ার পর মিরপুর-মতিঝিল রুটে বাসমালিকদের আয় ৫০ শতাংশ কমে গেছে। কিছু কোম্পানি লোকসানের কারণে বাসের ট্রিপ কমিয়ে দিয়েছে।
উত্তরা-মতিঝিল রুটেও বাসযাত্রী কমেছে বলে জানান তিনি। আজিমপুর-মিরপুর-১২ রুটে চলাচলকারী মিরপুর সুপার লিংক বাসের একজন চালক জানান, আগে মিরপুর থেকে আজিমপুর গেলে তার আয় হতো দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা। মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর এখন তা কমে ১৩০০ থেকে ১৪০০ টাকায় নেমে এসেছে। যাত্রী কমে যাওয়ায় মিরপুর সুপার লিংক বাস মালিকরা এই রুটে ৫০টির পরিবর্তে ৩০টি বাস চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর মতিঝিল-মিরপুর এবং মতিঝিল-উত্তরা রুটেও যানজট কমেছে। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রাইভেটকার চালক সাজ্জাদ হোসেন জানান, আগে পল্টন থেকে মিরপুর-১২ নম্বর পর্যন্ত যেতে এক থেকে দেড় ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লাগত। মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর মাত্র ৩০ থেকে ৩৫ মিনিটে চলাচল করতে পারেন। যানজট কমায় সময় বেঁচে যাওয়ার পাশাপাশি জ্বালানি খরচও কমেছে বলে জানান তিনি।
একুশে সংবাদ/বিএইচ
আপনার মতামত লিখুন :