বাংলা নববর্ষ বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধান জাতীয় ও সার্বজনীন উৎসব। বাংলাদেশে বসবাসকারী সকল ধর্মের মানুষের এ এক মিলন উৎসব। বাংলা সনের প্রথম মাস বৈশাখ, এই বৈশাখ মাসের প্রথম দিন যাপিত হয় বলে বাংলা নববর্ষের অপর নাম ‘পহেলা বৈশাখ। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের বাঙালিরা এই দিনে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়, ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে অতীত বছরের সকল দুঃখ-গ্লানি। সবার কামনা থাকে যেন নতুন বছরটি সুখময় ও সমৃদ্ধ হয়।
বাংলা নববর্ষের ইতিহাস এখনানে সুস্পষ্টভাবে জানা যায়নি। তবে অধিকাংশ ঐতিহাসিক ও পণ্ডিত মনে করেন মুঘল সমাট আকবর চান্দ্র হিজরি সনের সঙ্গে ভারতবর্ষের সৌর সনের সমন্বয় করে ১৫৫৬ সাল বা ৯৯২ হিজরিতে বাংলা সন চালু করেন। বাংলা সন চালু হওয়ার পর নববর্ষ উদযাপনে নানা আনুষ্ঠানিকতা যুক্ত হয়। নবাব এবং জমিদারেরা খাজনা আদায়ের উদ্দেশ্যে চালু করেন ‘পুণ্যাহ’। জমিদারি না থাকায় এখন তা লুপ্ত। পহেলা বৈশাখের দ্বিতীয় বৃহৎ অনুষ্ঠান ছিল হালখাতা। এদিনে গ্রাহকেরা দোকানিদের বাকির টাকা মিটিয়ে দিতেন।
তবে বর্তমানে বাংলা নববর্ষের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো বৈশাখী মেলা। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বৈশাখী মেলা উদযাপিত হয়। ঢাকার রমনার বটমূলে বসে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বৈশাখী মেলা। এখানে লাখো মানুষের সমাবেশ ঘটে। মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে এর আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। পুরো এলাকাজুড়ে বহুবিধ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পালিত হয়। অন্যদিকে, গ্রামাঞ্চলে যে মেলা হয় তাতে বিশেষভাবে স্থান পায় কবিগান, কীর্তন, যাত্রা, গম্ভীরা গান, পুতুল নাচ, নাগরদোলাসহ নানা আনন্দ আয়োজন। বাংলাদেশে বসবাসকারী আদিবাসীরাও তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে বর্ষবরণ করে। তাদের এই উৎসবকে বলে ‘বৈসাবি’।
বাংলা নববর্ষে পান্তা ও ইলিশ মাছ খাওয়া শহরবাসী বাঙালিদের ফ্যাশনের বিষয় হয়ে উঠেছে। বস্তুত বাংলা নববর্ষ বাঙালি সংস্কৃতির প্রধান উৎসব। এদিনে বাঙালি নিজস্ব সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে। শুধু বছরের প্রথম দিন নয়, সারা বছর ধরে যদি বাঙালি এই আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে সচেষ্ট হয় তবে বাঙালি সংস্কৃতি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংস্কৃতিতে পরিণত হবে। আর বাংলা নববর্ষ হবে সেই সমৃদ্ধ সংস্কৃতির প্রধান উৎসব।
কাল পহেলা বৈশাখে বর্ণিল উৎসবে মাতবে সারাদেশ। ভোরের প্রথম আলো রাঙিয়ে দেবে নতুন স্বপ্ন, প্রত্যাশা আর সম্ভাবনাকে। রাজধানী এবং সারাদেশ জুড়ে থাকবে বর্ষবরণের নানা আয়োজন। ‘বাংলা নববর্ষ ১৪৩১’ জাঁকজমকপূর্ণভাবে উদযাপনের লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে সরকার। দিনটি সরকারি ছুটির দিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করবে। ছায়ানট ভোরে রমনা বটমূলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করবে।
বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন যথাযোগ্য মর্যাদায় বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন করবে। বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠান আবশ্যিকভাবে জাতীয় সংগীত ও এসো হে বৈশাখ গান পরিবেশনের মাধ্যমে শুরু হবে। বাংলা নববর্ষের তাৎপর্য এবং মঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিহাস ও ইউনেস্কো কর্তৃক এটিকে বিশ্ব সংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি তুলে ধরে এদিন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও বাংলা একাডেমির উদ্যোগে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করবে। বাংলা নববর্ষে সকল কারাগার, হাসপাতাল ও শিশু পরিবারে (এতিমখানা) উন্নতমানের ঐতিহ্যবাহী বাঙালি খাবারের আয়োজন করা হবে।
এক সময় নববর্ষ পালিত হতো আর্তব উৎসব বা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে। তখন এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল কৃষির, কারণ কৃষিকাজ ছিল ঋতুনির্ভর। পরে কৃষিকাজ ও খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য মোঘল স¤্রাট আকবরের সময়ে বাংলা সন গণনার শুরু হয়। হিজরি চান্দ্রসন ও বাংলা সৌর সনের ওপর ভিত্তি করে প্রবর্তিত হয় নতুন এই বাংলা সন।
অতীতে বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব ছিল হালখাতা। এটি পুরোপুরিই একটি অর্থনৈতিক ব্যাপার। গ্রামে-গঞ্জে-নগরে ব্যবসায়ীরা নববর্ষের প্রারম্ভে তাঁদের পুরনো হিসেব-নিকাশ সম্পন্ন করে হিসেবের নতুন খাতা খুলতেন। এ উপলক্ষে তাঁরা নতুন-পুরাতন খদ্দেরদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টি বিতরণ করতেন এবং নতুনভাবে তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগসূত্র স্থাপন করতেন। চিরাচরিত এ অনুষ্ঠানটি আজও পালিত হয়।
মূলত ১৫৫৬ সালে কার্যকর হওয়া বাংলা সন প্রথমদিকে পরিচিত ছিল ফসলি সন নামে। পরে তা পরিচিত হয় বঙ্গাব্দ নামে। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে বাংলাবর্ষের ইতিহাস জড়িয়ে থাকলেও এর সঙ্গে রাজনৈতিক ইতিহাসেরও সংযোগ ঘটেছে। পাকিস্তান শাসনামলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের। আর ষাটের দশকের শেষে তা বিশেষ মাত্রা পায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনের মাধ্যমে। এসময় ঢাকায় নাগরিক পর্যায়ে ছায়ানটের উদ্যোগে সীমিত আকারে বর্ষবরণ শুরু হয়। আমাদের মহান স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে এই উৎসব নাগরিক জীবনে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে।
পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে। কালক্রমে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান এখন শুধু আনন্দ-উল্লাসের উৎসব নয়, এটি বাঙালি সংস্কৃতির একটি শক্তিশালী ধারক-বাহক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, উৎসবের পাশাপাশি স্বৈরাচার-অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদও এসেছে পহেলা বৈশাখের আয়োজনে। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বের হয় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা। যা ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো এ শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়।
একুশে সংবাদ/এসএডি
আপনার মতামত লিখুন :