দিবসকেন্দ্রিক ব্যবসা–বাণিজ্য সারা পৃথিবীতেই শনৈ শনৈ বাড়ছে। দশ থেকে পনেরো বছর আগেও কল্পনা করা যেত না, মা দিবস, বাবা দিবস, বন্ধু দিবস কিংবা ভালোবাসা দিবসে এত বেচাবিক্রি হবে। বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটি বলছে, এ বছর ভালোবাসা দিবসে ঢাকাতে শুধু ফুলই বিক্রি হয়েছে ১২০ কোটি টাকার। এ ছাড়া অন্যান্য উপহার সামগ্রী তো আছেই। সব মিলিয়ে ভালোবাসা দিবসের ব্যবসার আকার প্রায় হাজার কোটি ছুঁয়েছে।
ভালোবাসা দিবসের পরেই সম্ভবত ব্যবসার দিক থেকে এগিয়ে আছে মা দিবস। গত কয়েক বছর ধরে দেশে মা দিবসের উদযাপন চোখে পড়ার মতো। ছেলে–মেয়েরা শুধু মায়ের সঙ্গে সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্টই দেন না, মা’কে নানা ধরনের উপহারও দেন। কেউ কেউ মা’কে নিয়ে মায়ের পছন্দের কোনো জায়গায় ঘুরতে যান অথবা মাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে খেতে যান। তবে মা দিবসের ব্যবসার আকার ঠিক কতো বড়, তা নিয়ে দেশে সম্ভবত এখনো কোনো গবেষণা হয়নি। তাই মা দিবসের ব্যবসার সুনির্দিষ্ট আকার জানা যায় না।
দেশের খবর জানা না গেলেও আমেরিকার মা দিবসের ব্যবসার খবর অবশ্য ভালোভাবেই জানা যায়। দেশটির ন্যাশনাল রিটেইল ফেডারেশন (এনআরএফ) বলছে, প্রতি বছরই মা দিবসে ব্যবসার পরিমাণ বাড়ছে। ২০১৮ সালে মা দিবসে বেচাবিক্রি হয়েছিল ২৩ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারের। এরপর প্রতি বছরই একটু একটু করে বেড়েছে। এ বছর মা দিবসে ২৫ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা হবে বলে অনুমান করছে এনআরএফ।
এনআরএফের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ম্যাথিউ শাই বলেন, ‘প্রায় ৮৪ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মার্কিনী মা দিবস উদযাপন করেন। মা দিবসে মাকে উপহার দেওয়ার জন্য তাঁরা গড়ে ২৭৪ ডলার ব্যয় করেন।’
তবে মা দিবসের তুলনায় বাবা দিবসে বেচাবিক্রি একটু কম হয়। অর্থাৎ, জীবনের নানাক্ষেত্রে আমাদের মায়েরা পিছিয়ে থাকলেও দিবসকেন্দ্রিক ব্যবসাতে দেখা যাচ্ছে, মায়েরা এগিয়ে আছেন বাবাদের তুলনায়।
জার্মানভিত্তিক উপাত্ত বিশ্লেষণী প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিসটা বলছে, ২০২৩ সালে আমেরিকায় একজন মানুষ মা দিবসে ব্যয় করেছে ২৭৪ ডলার। আর বাবা দিবসে ব্যয় করেছে ১৯৬ ডলার। তার আগের বছর এই অনুপাতটি ছিল ২৪৫ ডলার ও ১৭২ ডলার। এভাবে পেছনে গিয়ে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দেখা গেছে, প্রতি বছরই মা দিবসে বরাদ্দ ছিল বেশি, আর বাবা দিবসে কম।
মা দিবসের ব্যবসার আকার বড় হওয়ার পেছনে মায়েদের দেওয়া উপহার সামগ্রীর বৈচিত্র্য দায়ী বলে মনে করে এনআরএফ। সংস্থাটি বলছে, মা দিবসে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় জুয়েলারি সামগ্রী। গত বছর মা দিবসে শুধু গয়না বিক্রি হয়েছে ৭ বিলিয়ন ডলারের। এরপর মা’কে নিয়ে বিশেষ কোনো জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার পেছনে মার্কিনিরা ব্যয় করেছে ৬ বিলিয়ন ডলার। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ইলেকট্রনিক সামগ্রী, এ খাতে ব্যয় সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া গত বছর মা দিবসে ফুল বিক্রি হয়েছে ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের এবং কার্ড বিক্রি হয়েছে ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারের।
বাবা দিবসে জুয়েলারি সামগ্রী বিক্রি হয় না বললেই চলে। তাই বাবা দিবসের ব্যবসার আকার মা দিবসের চেয়ে ছোট বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
আমাদের দেশেও খেয়াল করলে দেখা যাবে, মা দিবসে যতটা রান্নাঘরের সামগ্রী বিক্রি হয়, বাবা দিবসে তা হয় না। মায়েদের জন্য যত কসমেটিকস সামগ্রী বিক্রি হয়, বাবাদের জন্য তা হয় না। এসব কারণে মা দিবসের ব্যবসা বাবা দিবসের চেয়ে এগিয়ে আছে বলে মনে করেন বাজার বিশ্লেষকেরা।
মার্কিন রিটেইল প্রতিষ্ঠান ডিল নিউজ একবার মা দিবস ও বাবা দিবসের বেচাকেনা নিয়ে জরিপ চালিয়েছিল। সেই জরিপে দেখা গেছে, ৪৬ শতাংশ মার্কিনি মা দিবসে কোনো না কোনো উপহার কিনে থাকে। অন্যদিকে বাবা দিবসে উপহার কিনে থাকে মাত্র ৩০ শতাংশ মার্কিনি।
বদলে যাচ্ছে উপহারের ধরন
এক দশক আগেও কেউ মা’কে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, নোটপ্যাড ও স্মার্টফোন কিনে দিতেন না। এখন এসব পণ্য কিনে দিতে দেখা যাচ্ছে। গত এক দশকে বিশ্বজুড়ে প্রযুক্তি পণ্যের বিপুল বিস্ফোরণই এর পেছনে কারণ। এ ছাড়া গত কয়েক বছর ধরে মা দিবসে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে বিভিন্ন পণ্যের ওপর ছাড় দিতে দেখা যাচ্ছে। ফলে আইপ্যাড, আইপড, হেডফোন, স্মার্টওয়াচ—এসব পণ্য এখন সন্তানেরা মা’কে উপহার দিচ্ছেন।
বিশ্বায়নের দরজা দিয়ে পশ্চিমা অনেক সংস্কৃতিই আমাদের দেশে প্রবেশ করেছে। এসব দিবসও তেমন সংস্কৃতি। বলার অপেক্ষা রাখে না, পশ্চিমা সংস্কৃতি দ্বারা আমরা নানাভাবেই প্রভাবিত। ফলে পশ্চিমাদের এসব উপহারের সংস্কৃতিও আমরা ধীরে ধীরে আত্তীকরণ করে ফেলেছি। এ কারণে আমরা যারা দশ বছর আগে কল্পনাও করিনি মা’কে কিন্ডল উপহার দেওয়ার কথা, তারাই এখন হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের বদলে কিন্ডল উপহার দিচ্ছি।
সুতরাং সময় যত বাড়বে, ততই জনপ্রিয়তাও বাড়বে এসব দিবসের। আর এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়বে দিবসকেন্দ্রিক ব্যবসাও।
একুশে সংবাদ/আ.ট.প্র/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :