ক্রমাগত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের প্রতিযোগিতা বাড়ায় সমুদ্র নির্ভর বিকল্প অর্থনীতির গুরুত্ব বাড়ছে বিশ্বজুড়ে। দেশের মূল ভূখণ্ডের সমান সমুদ্রসীমা মালিকানা হওয়া সত্ত্বেও সুনীল অর্থনীতির সঠিক ব্যবহার করতে পারছে না বাংলাদেশ। আর প্লাস্টিক দূষণ ও অনিয়ন্ত্রিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় প্রতিনিয়ত নষ্ট হচ্ছে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য। মহামূল্যবান প্রবালসহ অস্তিত্ব হারিয়ে হুমকির মুখে সামুদ্রিক প্রাণী।
অবারিত সৌন্দর্যের জলরাশি সঙ্গে ঢেউয়ের নূপুর। সাদা চোখে দৃশ্যমান নীলাভ জলকেলির তলদেশের সম্পদ এখন আর রূপকথার গল্প নয়। সমুদ্রের তলদেশে ঠিক কত ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদ আছে সেটি পরিমাপ করা কঠিন হলেও সমুদ্রের তলদেশ যে বিপুল সম্পদের ভাণ্ডার তা সহজেই অনুমেয়। নানা প্রজাতির মাছ আর উদ্ভিদের যোগান। সমুদ্রপথে পণ্য আমদানি-রফতানির অপার সম্ভাবনাসহ তেল-গ্যাস ও খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ থাকায় সমুদ্রকে বলা হয় সম্পদের স্বর্গরাজ্য।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, সমুদ্র তলদেশে শুধুমাত্র প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ ১৫ কোটি টন। ২০৪০ সাল নাগাদ যা দাঁড়াবে ৬০ কোটি টনে। যা সমুদ্রে বিরাজমান সম্পদের জন্য মারাত্মক হুমকি।
বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার। এই সৈকতে হাঁটতে গেলেই চোখে পড়বে প্লাস্টিক বোতল, পলিথিন, ছেঁড়া জাল ও প্লাস্টিক বর্জ্য। আর দূষণে প্রতিবছর মারা পড়ছে সামুদ্রিক কাছিম, ডলফিন ও তিমি। তবে সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। এর তলদেশে মিলছে দূষণের ভয়াবহ চিত্র। যার কারণে পানি ও প্রাকৃতিক পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতির পাশাপাশি বিলুপ্তি ঘটছে সামুদ্রিক প্রাণীর। হুমকির মুখে পড়ছে ‘ব্লু ইকোনমি’।
বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবু সাঈদ মোহাম্মদ শরীফ বলেন, ‘প্লাস্টিক দূষণ ছাড়াও সমুদ্র আরও অনেক কারণে দূষিত হয়ে থাকে। যেমন বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি থেকে যে বর্জ্যগুলো আসে সেগুলো কিন্তু পরিবেশের জন্য ঝুঁকির কারণ। এগুলো খাদ্য শৃঙ্খলে চলে আসছে বিভিন্নভাবে। আর বৈশ্বিক পরিবর্তনটাও কিন্তু বিভিন্ন দূষণের কারণেই হচ্ছে। একইসঙ্গে গ্রিন হাউজের প্রভাবের কথা বলি এক ধরণের সিএফসি বা গ্রিন হাউজ গ্যাসের জন্য হচ্ছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। ঋতুগুলো পর্যন্ত বদলে যাচ্ছে। আগে আমাদের যেই সময় বৃষ্টি হতো বৃষ্টির সময়টাও বদলে গেল। যেই দীর্ঘ সময় ধরে বর্ষাকাল থাকত সেটাও পরিবর্তন হয়ে গেছে। শীত কমে গেল, গরম বেড়ে গেল। এ সবকিছুই কিন্তু দূষণের ফল। এই যে যত্রতত্র প্লাস্টিক ফেলা হচ্ছে সেটা বিভিন্নভাবে পরিবেশের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। সেটা সেন্টমার্টিন হোক, কক্সবাজার হোক, নোয়াখালী বা হাতিয়া কিংবা সুন্দরবন হোক। এসব কিন্তু নদী-নালা ও খাল-বিলের মাধ্যমে সাগরেই যাচ্ছে। কিছু শিল্প-কলকারখানার প্লাস্টিক এবং বিভিন্ন ধরণের একক ব্যবহৃত প্লাস্টিক- এগুলোও কিন্তু সাগরেই যাচ্ছে। এগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে দুইভাবে ক্ষতি করে। প্রথমত, খাদ্য শৃঙ্খলের মধ্যে চলে যাচ্ছে, দ্বিতীয়ত সাগরের বালির সঙ্গে মিশে সাগরের পরিবেশ নষ্ট করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সাগরে স্কুবা ডাইভিং করতে গেলে অনেক সময় দেখা যায় একক ব্যবহৃত প্লাস্টিক, পলিথিন ও ক্যান এসব যে জায়গায় থাকে সেই জায়গারই ক্ষতি করছে। বালি, শৈবাল, মাছ, কাছিম ও হাঙর সবকিছুরই ক্ষতি হতেই থাকবে যতক্ষণ প্লাস্টিককে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি।’
দেশের অর্থনীতিতে বর্তমানে ব্লু ইকোনমির অবদান ৯ দশমিক ৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা মোট অর্থনীতির মাত্র ৬ শতাংশ। সমুদ্রে থাকা মূল্যবান সম্পদ উত্তোলন, মৎস্য সম্পদ আহরণ ও পর্যটনের ক্ষেত্রকে কাজে লাগিয়ে ২০৩০ সাল নাগাদ বছরে কোটি কোটি ডলার আয় করার সম্ভব বলে ধারণা গবেষকদের। এজন্য সমুদ্র অর্থনীতির ব্যাপারে সমন্বিত নীতি, পরিকল্পনা ও প্রয়োজনে আলাদা মন্ত্রণালয় করার পরামর্শ সমুদ্র গবেষকের।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ মোসলেম উদ্দিন মুন্না বলেন, ‘সামুদ্রিক শিক্ষা ও গবেষণায় বরাদ্দ এবং অগ্রাধিকার অত্যন্ত অপ্রতুল। আমাদের পরিকল্পনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী যারা আছেন তারা সমুদ্র সম্পর্কে সচেতন না। ১ লাখ ৪৭ হাজার বর্গকিলোমিটারের যে আমাদের ভূমিভিত্তিক বাংলাদেশ সেটাকে পরিচালনা করার জন্য ৪৩টিরও বেশি মন্ত্রণালয় আছে। কিন্তু আমাদের সমুদ্র এবং সমুদ্র সম্পদকে ব্যবস্থাপনার জন্য একটি মন্ত্রণালয়ও গঠন করা হয়নি। যার কারণে সমুদ্রের কোনো কর্তৃপক্ষ জাতীয়ভাবে নেই।’
ড. মুহাম্মদ মোসলেম উদ্দিন মুন্না আরও বলেন, ‘সমুদ্রে কি পরিমাণ সম্পদ কোথায় কীভাবে আছে, কতটুকু আহরণ করা যাবে এই সমীক্ষাটি এখনো করা সম্ভব হয়নি। আমাদের অর্থনৈতিক আহরণকে গুরুত্ব দিচ্ছি, কিন্তু আমাদের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্থাৎ পরিবেশ বান্ধব যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সেটার প্রতি নজর এখনো কাঙ্ক্ষিত স্তরে পৌঁছায়নি। সবস্তরের মানুষকে সমুদ্র সচেতন করার জাতীয় উদ্যোগ তথা বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসায় সমুদ্র বিজ্ঞান পড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি বলে বাংলাদেশের সমুদ্র সম্পদকে যথাযথভাবে কাজে লাগেতে পারছে না। সব তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে একটা খুবই উন্নত সামুদ্রিক বিশেষ পরিকল্পনা করতে হবে। যার মাধ্যমে সমুদ্রটাকে বিভিন্ন কাজের জন্য, যেমন যে এলাকাটা যে কাজের জন্য যথোপযুক্ত তাকে সেটার জন্য বরাদ্দ করতে হবে। সুতরাং এই কাজগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যে যদি করতে পারি তাহলে আমরা সমুদ্র সম্পদকে কাজে লাগিয়ে কাঙ্ক্ষিত সফলতা অর্জন করতে পারব।’
তবে, বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. তৌহিদা রশীদ বলেন, ‘সুনীল অর্থনীতির অপার সম্ভাবনাকে কাজ লাগাতে নির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে কাজ করা হচ্ছে। আমরা আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের এই গবেষণাগুলো প্রত্যেকটা অর্থনৈতিক অবদানের জন্য করা হচ্ছে। নবায়নযোগ্য শক্তি যদি আমরা তৈরি করতে পারি নিশ্চয়ই সেটাও একটা অবদান হবে। এই যে আমদের সী-উইড বা সামুদ্রিক শৈবাল নিয়ে এতো গবেষণা হচ্ছে সেটা যখন বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার হবে সেখানেও আমাদের অবদান হবে। আমরা এভাবে গবেষণাগুলো করে করেই অবদানের দিকে যাচ্ছি। বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটকে তৈরিই করা হয়েছে এই আদেশ দিয়ে, যেন1 আমরা সমুদ্র থেকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারি।’
গবেষকরা বলছেন, বিশ্বে সমুদ্রকে কেন্দ্র করে যে বাণিজ্য হয় তার বাজার মূল্য বছরে প্রায় ৩ থেকে ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। এছাড়া পৃথিবীর ৩০ ভাগ গ্যাস ও জ্বালানি তেল সরবরাহ ছাড়াও আমদানি-রফতানির ৬০ ভাগ হয়ে থাকে সমুদ্রপথে। বৈশ্বিক এই পরিসংখ্যানে নাম লেখাতে চায় বাংলাদেশও। কারণ বাংলাদেশের মূল ভূ-খণ্ডের বাইরেও প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার ৮৮৩ বর্গ কিলোমিটারের বিশাল সমুদ্রসীমা রয়েছে। আর এই সমুদ্রের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ব্লু ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতির বিপুল সম্ভাবনা।
একুশে সংবাদ/স.ট.প্র/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :