AB Bank
ঢাকা শনিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৬ পৌষ ১৪৩১

সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

Ekushey Sangbad
ekusheysangbad QR Code
BBS Cables
Janata Bank
  1. জাতীয়
  2. রাজনীতি
  3. সারাবাংলা
  4. আন্তর্জাতিক
  5. অর্থ-বাণিজ্য
  6. খেলাধুলা
  7. বিনোদন
  8. শিক্ষা
  9. তথ্য-প্রযুক্তি
  10. অপরাধ
  11. প্রবাস
  12. রাজধানী

বাংলাদেশের হিন্দুদের সুরক্ষায় ভারত আসলে কী ভাবছে


Ekushey Sangbad
একুশে সংবাদ অনলাইন ডেস্ক
০১:০৪ পিএম, ২১ ডিসেম্বর, ২০২৪
বাংলাদেশের হিন্দুদের সুরক্ষায় ভারত আসলে কী ভাবছে

বাংলাদেশে শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে গত সাড়ে চার মাসে দিল্লির পক্ষ থেকে বাংলাদেশের নতুন সরকারকে বারবার যে কথাটা সবচেয়ে জোর দিয়ে বলা হয়েছে তা হল সে দেশে হিন্দু ও অন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন যে কোনওভাবে হোক বন্ধ করতেই হবে! প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একথা প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে একাধিকবার বলেছেন– টেলিফোনে ও টুইটারে। দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র সচিবদের যখন নিউ ইয়র্কে বা ঢাকা‍য় দেখা হয়েছে, তখনও ভারত এই প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছে। বাংলাদেশের হিন্দুদের নিয়ে ভারত সরকার তাদের বক্তব্য জানিয়েছে দেশের পার্লামেন্টেও।

বস্তুত গত কয়েক মাসে বোধহয় এমন একটি সপ্তাহও ছিল না, যখন ভারত সরকারের কোনও না কোনও পর্যায় থেকে এই ইস্যুতে কোনও বিবৃতি জারি করা হয়নি। এর পাশাপাশি ভারতের সংবাদমাধ্যমে ও টিভি চ্যানেলগুলোতে বাংলাদেশে হিন্দুদের দুর্দশা নিয়ে রিপোর্ট, আলোচনা ও তর্কবিতর্ক চলছে লাগাতার। বাংলাদেশ সরকার যদিও এর বেশির ভাগটাই অতিরঞ্জন বা ফেক নিউজ বলে নাকচ করে দিয়েছে। ভারতের ভেতরে কিন্তু এই সব খবর রীতিমতো সাড়া ফেলেছে।

ভারতের প্রধান শাসক দল বিজেপি ও প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস, উভয়েই একটি কোনও বিশেষ ইস্যুতে একই দাবিতে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে – সম্প্রতি এমন বিরল দৃশ্যেরও সাক্ষী থেকেছে ভারতের পার্লামেন্ট। দাবিটি, বলাই বাহুল্য – বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে যখন বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ভারত সফরে এসেছিল, তখন বহু সংগঠন বলেছিল সে দেশে হিন্দুদের ওপর নির্যাতন চলতে থাকলে ভারতের উচিত সিরিজ বয়কট করা! পাকিস্তানকে নিয়ে এমন কথা বহুদিন ধরে চললেও বাংলাদেশকে নিয়ে এই ধরনের হুঁশিয়ারি ছিল ভারতে প্রথম!

বাংলাদেশ থেকে নির্যাতিত হয়ে পালিয়ে আসা হিন্দুদের জন্য সীমান্ত খুলে দেওয়া হোক, এমনও আহ্বান জানিয়েছে ভারতের বিভিন্ন সংগঠন ও গোষ্ঠী।  শ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারীও সেই দাবি সমর্থন করেছেন, তার নেতৃত্বে দল বাংলাদেশ সীমান্তে অবরোধ কর্মসূচিও পালন করেছে। ভারতে কেউ কেউ আবার বলছেন, ২০১৫ তে নেপালের নতুন সংবিধান ভারতের পছন্দ না-হওয়ার পর যেমন ভারতের প্রচ্ছন্ন সমর্থনে নেপালের বিরুদ্ধে প্রায় ছ‍‍`মাস ধরে অর্থনৈতিক অবরোধ চালানো হয়েছিল, বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই ধরনের ‘দাওয়াই’ প্রয়োগ করা যেতে পারে।

তাতে আবার পাল্টা যুক্তিও আসছে– বাংলাদেশ নেপালের মতো স্থলবেষ্টিত দেশ নয়, কাজেই ভারত থেকে পণ্য না এলেও তারা সমুদ্রপথে বাইরে থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনাতেই পারবে। হয়তো তাতে দাম বেশি পড়বে, কিন্তু বাংলাদেশ না খেয়ে মরবে না! এই পটভূমিতে একটা জিনিস পরিষ্কার – বাংলাদেশে হিন্দুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য কী বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে সে বিষয়টা ভারতকে ভাবাচ্ছে।


সরকার বা নীতিনির্ধারকদের যেমন, তেমনি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষকেও। তবে রাজনীতির ভাষণে, জনসভায় বা এমন কী সরকারি বিবৃতিতেও হয়তো অনেক দাবিই জানানো যায়, অনেক কথাই বলা যায়। কিন্তু তার কতটা সত্যিই বাস্তবে প্রয়োগ করা সম্ভব? অন্যভাবে বললে, বাংলাদেশের হিন্দুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য ভারতের পক্ষে কতটুকু নেহাত কথার কথা, আর কতটুকু কী আসলেই করা সম্ভব? বিবিসি বাংলাও ঠিক এই প্রশ্নটাই রেখেছিল ভারতের একজন সাবেক কূটনীতিবিদ, একজন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, একজন প্রবীণ অ্যাকাডেমিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একজন শীর্ষস্থানীয় গবেষকের কাছে। সেই প্রশ্নের জবাবে তাদের প্রত্যেকের বক্তব্যের সারাংশই তুলে ধরা হল এই প্রতিবেদনে।

‘কূটনৈতিক পথে সমাধান খোঁজাই একমাত্র রাস্তা’

মাত্র বছর চারেক আগেও বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার ছিলেন রীভা গাঙ্গুলি দাশ। ভারতের এই সাবেক শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিবিদ ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাংস্কৃতিক শাখা আইসিসিআরের মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব সামলেছেন। কেরিয়ারে একাধিকবার ঢাকায় নিযুক্ত ছিলেন, বাংলাদেশ এখনও তার গবেষণা ও আগ্রহের ক্ষেত্র। তিনি মনে করেন, ভারতকে এই সংকটের সমাধান খুঁজতে হবে একমাত্র কূটনৈতিক পথেই!

বিবিসি বাংলাকে রীভা গাঙ্গুলি দাশ বলছিলেন, ‘বাংলাদেশে এই পরিস্থিতি নতুন নয়। ২০০১ সালের অক্টোবরে শেখ হাসিনা সরকার ভোটে হারার পরই বাংলাদেশজুড়ে যে ধরনের হিন্দু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছিল, তার ব্যাপকতা ও সহিংসতার মাত্রা ছিল এবারের চেয়েও অনেক বেশি। আমি তখন ঢাকার ভারতীয় দূতাবাসেই পোস্টেড, মনে আছে, তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী তার অত্যন্ত আস্থাভাজন নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রজেশ মিশ্রকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন।’

‘ব্রজেশ মিশ্র সে বার খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকারকে বেশ কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে যান – যে ভারতের পক্ষে এটা চুপচাপ বসে দেখা কিছুতেই সম্ভব নয়। আরও কী বলেছিলেন আমি জানি না, তবে পরিস্থিতিতে কিন্তু তারপরই দ্রুত উন্নতি হয়েছিল!’

২০০১ আর ২০২৪ এর পরিস্থিতি অবশ্যই এক নয়। ভারত ও বাংলাদেশেও তখনকার আর এখনকার সরকারের চরিত্রে অনেক ফারাক। কিন্তু এই মুহুর্তে কীভাবে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কথা বলে সে দেশের হিন্দুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাবে, তা ভারতকেই ভেবে বের করতে হবে বলে মিজ দাশের অভিমত।

‘আসলে একটা জিনিস আমাদের বুঝতে হবে, বাংলাদেশের হিন্দুরা নির্যাতিত হয়ে যদি ভারতে চলে আসারও চেষ্টা করেন, ভারতের পক্ষে আজ তাদের আর আশ্রয় দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ সংখ্যাটা তো দু-পাঁচ শ নয়, লক্ষ লক্ষ! সুতরাং বাংলাদেশের মাটিতেই তাদের রাখতে হবে। আর সেখানেই তাদের জীবন-সম্পত্তি সুরক্ষিত করতে হবে। এটা ভারতের জন্য অবশ্যই খুব বড় চ্যালেঞ্জ!’

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বছরকয়েক আগেও বাংলাদেশের কোনও প্রান্তে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার বা মন্দিরে হামলার কোনও ঘটনা ঘটলেই ঢাকার ভারতীয় দূ‍তাবাস থেকে রাষ্ট্রদূত বা অন্য কর্মকর্তারা সেখানে ছুটে যেতেন – এই বার্তা দিতে যে তাদের বিপদের মুহূর্তে ভারত পাশে আছে। তবে ক্রমশ ভারতের পক্ষ থেকে নির্যাতিত হিন্দুদের এটাও বোঝানো হতে থাকে যে হামলা হলেই কোনও মতে জমিবাড়ি বেচে ‘ইন্ডিয়া চলে যাওয়া’টা কোনও সমাধান নয়। বাংলাদেশই তাদের দেশ। তাই নাগরিক হিসেবে পূর্ণ অধিকারে তাদের সেখানেই থেকে যাওয়ার চেষ্টা করা উচিত। বর্তমান সংকটেও ভারতের সেই অবস্থানের কোনও পরিবর্তন হয়নি বলাই বাহুল্য!

রীভা গাঙ্গুলি দাশের মতে, বাংলাদেশের হিন্দুরা যাতে সে দেশে থেকেই সুরক্ষিত বোধ করতে পারেন এবং ভারতের পানে পাড়ি না দেন। দিল্লির নিজের স্বার্থেও সেটা নিশ্চিত করা দরকার, এবং সেটা করতে হবে কূটনীতির রাস্তাতেই!

‘দরকারে বাংলাদেশের জন্য আকাশসীমা বন্ধ করা হোক’

তথাগত রায় পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সাবেক সভাপতি, সদস্য ছিলেন দলের জাতীয় কর্মসমিতিরও। নরেন্দ্র মোদী সরকারের আমলে উত্তর-পূর্ব ভারতে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী একাধিক রাজ্যে রাজ্যপালের দায়িত্বও পালন করেছেন। বাংলাদেশে হিন্দুদের দুর্দশা নিয়ে বহুদিন ধরে লেখালেখি করছেন আরএসএসের ঘনিষ্ঠ এই রাজনীতিক ।

প্রবীণ এই রাজনীতিবিদ বিশ্বাস করেন, হিন্দু নির্যাতনের প্রশ্নে বাংলাদেশ সরকারকে চাপ দেওয়ার জন্য ভারতের সামনে আসলে অনেক রাস্তাই খোলা আছে। তবে সেগুলো সব একবারে প্রয়োগ করার দরকার নেই। ধাপে ধাপে পরিস্থিতি বুঝে পর্যায়ক্রমিকভাবে সেগুলো পরখ করে দেখা যেতে পারে।

তথাগত রায় বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘প্রথমত, বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ডাউনগ্রেড করা যেতে পারে। ধরা যাক হাইকমিশনারকে প্রত্যাহার করে আমরা সম্পর্কটা ‘স্কেল ডাউন’ করলাম। ঠিক যেমনটা শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ইস্যুতে কানাডার সঙ্গেও করা হয়েছে। এতে একটা খুব কড়া বার্তা যাবে যে হিন্দু নির্যাতনের প্রশ্নে ভারত কোনও ধরনের আপস করবে না।’

এতেও যদি কোনও কাজ না হয়, তাহলে একে একে বেশ কিছু অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন তিনি, যা সরাসরি বাংলাদেশের স্বার্থে আঘাত করবে।

‘যেমন ধরুন, বাংলাদেশের জন্য ভারতের এয়ারস্পেস বা আকাশসীমা রেস্ট্রিক্ট করে দেওয়া হল। তাতে মধ্যপ্রাচ্য বা ইউরোপের জন্য বাংলাদেশের গেটওয়ে-টাই বন্ধ হয়ে যাবে। তাদের রপ্তানি বাণিজ্য তছনছ হয়ে যাবে। সব বিদেশি এয়ারলাইনও তখন বাংলাদেশ থেকে পাততাড়ি গোটাতে বাধ্য হবে। একইভাবে বাংলাদেশগামী জাহাজের জন্য ভারতের সমুদ্রসীমাও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে।’

‘বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে তৈরি পোশাক খাত থেকে। এখন যদি ভারত সেই গারমেন্ট তৈরির কাঁচামাল বা ইয়ার্নের রফতানিই বন্ধ করে দেয়, তারা গভীর সমস্যায় পড়বে। একই ভাবে আলু-পেঁয়াজ-চাল-ডিমের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের রপ্তানিও নিষিদ্ধ করা হলে তাদের অনেক বেশি দামে অন্য জায়গা থেকে কিনতে হবে।’

বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদ আরো বলেন, ‘কিছুতেই কিছু কাজ না হলে এখন এই শীতের শুষ্ক মৌশুমে অভিন্ন নদীগুলোর জলও আটকে দেওয়ার কথা ভাবা যেতে পারে। কিংবা বর্ষার সময় সব লকগেট খুলে দেওয়ার কথা! ঘরের পাশে হিন্দুরা নির্যাতিত হলে ভারতের তো আন্তর্জাতিক চুক্তির মর্যাদা দেওয়ার দায় থাকে না!’

পাশাপাশি তিনি আরও বলছেন, ‘ভারতের উচিত হবে দেশের ভেতরে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী ও রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জোরালো অভিযান শুরু করে তাদের ব্যাপক হারে সীমান্তের অন্য পারে পুশব্যাক করা – যাতে বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ বাড়ানো যায়।’

কিন্তু এই ধরনের চরম পদক্ষেপ নিলে ভারতকেও তো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কড়া ‘ব্যাকল্যাশ’ বা বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়তে হবে?

জবাবে তথাগত রায় বলেন, ‘এখন অ্যাপার্থাইডের জন্য সারা বিশ্ব যদি একযোগে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে, তাহলে ঠিকমতো বিশ্ব জনমত তৈরি করতে পারলে ও কার্যকরি কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে পারলে বাংলাদেশের বিরুদ্ধেও দুনিয়াকে একজোট করা সম্ভব!’

‘চাপটা আসতে হবে ভারতের বাইরে থেকে’

দিল্লির জহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটি (জেএনইউ), আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় অ্যাট আর্বানা-শ্যাম্পেন এবং মালয়েশিয়ার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ছিলেন বলদাস ঘোষাল। বর্তমানে তিনি থিঙ্কট্যাঙ্ক তিলোত্তমা ফাউন্ডেশনের গবেষণা প্রধান। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতির সুপরিচিত এই বিষেশজ্ঞ বাংলাদেশকে পর্যবেক্ষণ করছেন বিগত বহু বহু বছর ধরে, তার নিজের শৈশব ও কৈশোরও কেটেছে পূর্ব পাকিস্তানেই।

অধ্যাপক ঘোষাল সোজাসুজি বলছেন, ‘হিন্দু নির্যাতনের ইস্যুটা অ্যাড্রেস করার জন্য ভারতের সামনে সত্যি বলতে বাস্তবসম্মত অপশন খুবই কম – কারণ ‘বাংলাদেশ ইজ আ টোট্যালি ডিফারেন্ট বলগেম! আসলে বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর নিপীড়ন অত্যাচারের ঘটনা নতুন কিছু নয়। বহু বহু বছর ধরে ঘটে আসছে আর তার পেছনে গভীর আর্থসামসাজিক ও ঐতিহাসিক কারণও নিহিত আছে। এমন নয় যে ৫ অগাস্টের পর আচমকা এই জিনিস শুরু হলো। এখন বাইরে থেকে ভারত যদি চাপ দিয়ে এটা বন্ধ করতে চায় কিংবা কড়া শাস্তি দিয়ে ও বাংলাদেশকে ভয় দেখিয়ে এটা বন্ধ করার চেষ্টা করে। তাতে হয়তো হিতে বিপরীতও হতে পারে।

বিবিসিকে বলদাস ঘোষাল বলেন, ‘মানে তখন হয়তো দেখা গেল বাংলাদেশকে শিক্ষা দিতে দিয়ে সে দেশে হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের মাত্রাটাই বেড়ে গেল। ফলে আমি মনে করি এভাবে কোনও সমাধান বেরোবে না।’

তাহলে কি ভারত সরকারের কড়া বিবৃতি দেওয়া ছাড়া এ ব্যাপারে আসলেই কিছু করার নেই? ‘না, তা নয়। তবে বিষয়টা যেহেতু খুবই স্পর্শকাতর, আর আমরা সেনা পাঠিয়েও কাউকে সিধে করতে পারছি না তাই খুব সাবধানে পা ফেলে এই সমস্যার নিষ্পত্তির চেষ্টা চালাতে হবে।’

কীভাবে ভারত সরকার এই লক্ষ্যে এগোতে পারে, তার দুটো নির্দিষ্ট উদাহরণও দিচ্ছেন অধ্যাপক ঘোষাল।

‘যেমন ধরুন প্রথমত ভারত নিজেরা সরাসরি চাপ না দিয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্বে তাদের মিত্রদের দিয়ে বাংলাদেশের ওপর চাপ প্রয়োগ করাতে পারে, যাতে সেখানে হিন্দু নির্যাতন বন্ধ হয়। পশ্চিমারা বা জাপানের কাছ থেকে এ ব্যাপারে চাপ এলে বাংলাদেশ নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হবে।’

‘আর এর জন্য আগামী ২০ শে জানুয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দায়িত্ব গ্রহণ করা অবধি অপেক্ষা করাটাই সমীচীন। আশা করা যায়, ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সিতে বাংলাদেশ প্রশ্নে আমেরিকার অবস্থান ভারতের মতের সঙ্গে অনেক বেশি মিলবে। আর সেটা কাজে লাগিয়েই দিল্লির উচিত হবে, ওয়াশিংটনকে দিয়েই ঢাকার ওপর চাপ দেওয়া!’

‘দ্বিতীয় পদক্ষেপটা হওয়া উচিত ভারতের অভ্যন্তরে এই প্রশ্নটায় একটা রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে তোলা।’

বলদাস ঘোষাল বলেন, ‘মানে বাংলাদেশে হিন্দুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে কীভাবে এগোনো দরকার, নরেন্দ্র মোদী সরকার তা নিয়ে আলোচনা করতে সর্বদলীয় বৈঠক ডাকতে পারে। শাসক জোটের শরিক ও বিরোধীদের সঙ্গে পরামর্শ করে একটা সুচিন্তিত স্ট্র্যাটেজি নির্ধারণ করতে পারে। যাতে ভারতের সব রাজনৈতিক শক্তি একমত হবে।’

তিনি যুক্তি দিচ্ছেন, ভারতের ভেতরে এই প্রশ্নটায় একটা বলিষ্ঠ ‍‍`কনসেনসাস‍‍` আছে, এটা দেখানো গেলে বাংলাদেশও ভারতের উদ্বেগকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য হবে।

‘ভারত যে ইসরায়েল নয়, এটা বুঝতে হবে’

স্ম্রুতি এস পট্টনায়ক দিল্লির প্রথম সারির স্ট্র্যাটেজিক থিঙ্কট্যাঙ্ক মনোহর পারিকর আইডিএসএ-র সিনিয়র ফেলো, তার গবেষণার ক্ষেত্র দক্ষিণ এশিয়া এবং এই অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক। কাজের সূত্রে তিনি ঘন ঘন বাংলাদেশেও যান। ভারত সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়েও তার নিয়মিত যোগাযোগ আছে।

ড. পট্টনায়কের পরিষ্কার কথা – এই সঙ্কটের সমাধান খুঁজতে হবে নীরবে ও চোখের আড়ালে, মিডিয়াতে ঢাকঢোল পেটালে তাতে অযথাই আরও জলঘোলা হবে।

বলদাস ঘোষাল বলেন, ‘আসলে ভারত যদি বাংলাদেশে হিন্দুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে চায়, ‍‍`পাবলিক ডিপ্লোম্যাসি‍‍` করে তাতে কোনও লাভ হবে না। মানে বলতে চাইছি মিডিয়াতে ফলাও করে বিবৃতি দিয়ে বা প্রকাশ্যে কড়া সমালোচনা করে কাজের কাজ হবে না। বরং ভারতকে যা করার তা চুপচাপ করতে হবে পর্দার আড়ালে।’

কিন্তু তিনি সেই সঙ্গে এটাও বিশ্বাস করেন, আসলে ভারত নিজেদের সারা দুনিয়ার হিন্দুদের ‍‍`রক্ষাকর্তা‍‍` বলে ঘোষণা করেই পরিস্থিতিটাকে আরও জটিল করে তুলেছে। বাংলাদেশের নির্যাতিত হিন্দুদেরও ভারতের ওপর এক ধরনের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে, যা পূরণ করা খুবই কঠিন।

প্রসঙ্গত, এটাও মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে ৫ অগাস্টের অব্যবহিত পর বাংলাদেশের শত শত বাংলাদেশি যখন ভারত সীমান্তের বিভিন্ন জায়গায় এসে জড়ো হয়েছিলেন বা ‍‍`জয় শ্রীরাম‍‍` ধ্বনি দিয়ে আশ্রয় চেয়েছিলেন – তখন কিন্তু ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ তাদের ফিরিয়ে দিয়েছিল।

‘সোজা কথা সোজা বলাই ভাল। ইসরায়েল যেভাবে সারা পৃথিবীর নির্যাতিত ইহুদীদের আশ্রয় দেওয়ার নীতি নিয়ে চলে, দরকারে ভিন দেশ থেকে ইভ্যাকুয়েট করেও নিয়ে আসে – ভারতের পক্ষে চাইলেও সারা দুনিয়ার হিন্দুদের এভাবে উদ্ধার করে আনা সম্ভব নয়! আপনি বলতে পারেন ভারতের বর্তমান সরকারই তো বাংলাদেশের নিপীড়িত হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার আইন এনেছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে সেখানেও কিন্তু একটা কাট-অফ ডেট আছে – ২০১৪র ৩১শে ডিসেম্বর।’

বিবিসি বাংলাকে স্ম্রুতি এস পট্টনায়ক বলেন, ‘ফলে আজ যারা বাংলাদেশে নির্যাতিত হচ্ছেন তাদের কিন্তু আর এখন ভারতে এসে নতুন করে নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ নেই। এই বাস্তবতা মাথায় রেখেই আমাদের একটা সমাধানের রাস্তা বের করতে হবে।’

ভারত যাতে বাংলাদেশের হিন্দুদের ‍‍`মুখপাত্র‍‍` হিসেবে নিজেদের তুলে না-ধরে, সে ব্যাপারেও দিল্লির সতর্ক থাকা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ দিয়ে ড. পট্টনায়ক বলছিলেন, ‘যেমন ধরুন বাংলাদেশে ইসকনের হয়েও আমরা বিবৃতি দিচ্ছি। অথচ ইসকন বা ‍‍`ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেস‍‍` তো একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন। পশ্চিমের বহু দেশেই তাদের খুব ভাল প্রভাব আছে। তো ইসকনের হয়ে ব্যাট করার কাজটা তো ভারত তো তাদের ওপরেও ছেড়ে দিলে পারে?’

তার মতে, এটা করলে লাভ হবে একটাই – মিডিয়াতে দু‍‍`পক্ষের তোপ দাগা কিংবা বিবৃতি ও পাল্টা বিবৃতির বাইরে হিন্দুদের সুরক্ষার জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার হয়তো একটা অবকাশ তৈরি হবে।

ভারত যদি বাইরে ইস্যুটা নিয়ে সংযত প্রতিক্রিয়া দেখায় এবং ভেতরে ভেতরে বাংলাদেশ সরকারের ওপর কড়া চাপ বজায় রাখে – তাহলে সে দেশের পুলিশ-প্রশাসনকেও ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করা যাবে বলে তিনি মনে করছেন।

আসলে ভারতের জন্য এই সমস্যাটা অত্যন্ত জটিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই – এর প্রতিকারের জন্য নানা মহল থেকে নানা ধরনের পরামর্শও আসছে। কিন্তু দিল্লি ঠিক কোন পথে এগিয়ে বাংলাদেশের হিন্দুদের জানমাল সুরক্ষিত করার কথা ভাবছে। বলা যেতেই পারে তার কোনও স্পষ্ট আভাস এখনও পাওয়া যায়নি।

 

একুশে সংবা/কা ক/বিএইচ

Link copied!