গণতান্ত্রিক পুনর্গঠন এখন ভঙ্গুর অবস্থায় আছে। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত সবাই পুলিশকে ব্যবহার করেছে। বিচার বিভাগের সঙ্গে পুলিশের সমন্বয় করতে হবে। উন্নত দেশে পুলিশ জনগণের বন্ধু, আর আমাদের দেশে পুলিশকে সবাই শত্রু মনে করে। পুলিশ জনগণের সেবক না হয়ে ক্ষমতাসীনদের লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে পুলিশের সংস্কার করতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন। অন্যথায় তা ফলপ্রসু হবে না।
শনিবার (২১ ডিসেম্বর) সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত ‘গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংলাপ: আইনশৃঙ্খলা প্রসঙ্গ’ শীর্ষক আলোচনায় সভায় এসব কথা বলেন বক্তারা। রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
আলোচনা সভায় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পীস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান বলেন, কেবল পুলিশ নয়, সার্বিকভাবে কীভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ঠিক করা যায় তার ওপর নজর দিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে কমিশনের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলে কমিশনের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পুলিশকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। পুলিশের মানসিক স্বাস্থ্যে ঘাটতি আছে। বর্তমান প্রযুক্তিগুলো পুলিশকে শেখাতে হবে। জনগণেরও পুলিশকে সাহায্য করতে হবে। পুলিশের কাজের তদারকি করার ব্যবস্থা করতে হবে। পার্লামেন্টে পুলিশের কোড অব কন্ডাক্ট তৈরি করতে হবে। পর্যালোচনা প্রক্রিয়া আনতে হবে। জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল তৈরি করতে হবে। অ্যাডভোকেসি গ্রুপগুলোকে সাহায্য করতে হবে যেন ওয়াচ ডগ হিসেবে কাজ করতে পারে। জনগণকে তাদের দাবি তুলে ধরতে হবে যেন সে দাবিগুলো তারা পূরণ করতে পারে।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের পরিচালক এএসএম নাসিরুদ্দিন এলান বলেন, গত ১৫ বছরে পুলিশ যে ধরনের নির্যাতন করেছে, মানবাধিকার সংগঠনগুলো তার থেকে অনেক কম তথ্য উপাত্ত হাজির করতে পেরেছে। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পরেও এ নির্যাতন থেমে থাকেনি। অধিকারের গত তিন মাসের প্রকাশিত প্রতিবেদনে নয়জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে ছয়জন নির্যাতনে আর তিনজন গুলিতে নিহত হয়েছেন। নির্যাতনের এ প্রবণতা কিন্তু থেমে থাকেনি। এখন যে মামলাগুলো হচ্ছে, প্রত্যেকটা মামালায় আসল অপরাধীদেরকে বাদ দিয়ে ব্যাপক সংখ্যক নিরপরাধীদের আসামি করা হচ্ছে। এর মধ্যে পুলিশের বাণিজ্য করার ব্যাপক অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। অভ্যুত্থানের পরও পুলিশের এসব কর্মকাণ্ড না থামা ভালো কিছু ইঙ্গিত করে না। রাজনৈতিক দলগুলোকে এ বিষয়ে সতর্ক হতে হবে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জহির উদ্দিন স্বপন বলেন, বিগত সরকার এমন আভাস দিয়েছে যে তারা ক্ষমতায় না থাকলে অনেক মানুষ মারা যাবে। আমাদের পুলিশের সেবা নাকি পুলিশের নিয়ন্ত্রণ দরকার—এখানে কাজ করতে হবে। পুলিশের ওপর নিয়ন্ত্রণ কমাতে হবে। রাজনৈতিক সংস্কার করতে হবে যেন ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ না হয়। পুলিশের কাজ সেবা করা, এটি সব রাজনৈতিক দলগুলোকে বুঝতে হবে।
সাবেক আইজিপি এম এনামুল হক বলেন, রাজনৈতিক নেতার আদেশের বিরুদ্ধে না বলার সাহস থাকতে হবে সবার যদি তা আপনার বিবেকে বেঁধে থাকে। প্রয়োজনবোধে সাহস করতে হবে। কমিশন আগেও হয়েছে কিন্তু তার প্রয়োগ হয়নি। তার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
সাবেক বিচারপতি ইকতেদার আহমেদ বলেন, পুলিশের সংজ্ঞা ঠিক করতে হবে। বিগত সরকার তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশের জন্য কিছু বিচারককে নিয়োগ করেছিল। অতীতে এবং বর্তমান সরকার সংবিধান লঙ্ঘন করে কাজ করছে। এরকম হতে থাকলে দেশে কখনো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হতে পারবে না।
বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) সভাপতি ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, আমাদের দেশে একজন ভালো রাজনীতিবিদ দরকার। ভালো মানুষদেরকে সংসদে আসতে হবে, দেশ শাসনে আসতে হবে। খারাপ ভোটার খারাপ মানুষদেরকে ক্ষমতায় আনবে।
আরেক সাবেক আইজিপি মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, পুলিশকে আমরা হেনস্তাকারী সংস্থা হিসেবে তৈরি করেছি। পুলিশের পদোন্নতি ওপর দিকে দেয়া হয়েছে। ট্রাইবালিজম থেকে বের হতে হবে। বিচার সব জায়গায় থাকতে হবে কেবল পুলিশের ক্ষেত্রেই নয়। ক্ষমা সবার চাইতে হবে। যারা নির্দেশ দিয়েছে ও অর্থনীতি ধ্বংস করেছে তাদেরকেও ক্ষমা চাইতে হবে ও বিচারের আওতায় আনতে হবে। ইতিবাচক কর্তৃত্বভীতি থাকতে হবে। অতিরিক্ত জোর প্রয়োগ যেন কেউ আর না করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ত্রুটি হলো সুশাসনের অভাব। সংস্কার শব্দটি অনেক ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু এটি ঘৃণিত শব্দে পরিণত হয়েছে। সংস্কার চলনীয় একটি প্রক্রিয়া। আমরা সাধারণ মানুষের কথা শোনার চেষ্টা করছি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। সাধারণ জনগণ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, ব্যবসায়ীরা নিরাপদে ব্যবসা করতে পারছে না, পুলিশ মনোবল হারিয়ে ফেলেছে এবং প্রতিনিয়ত মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সিজিএসের চেয়ারম্যান মুনিরা খান বলেন, গণতান্ত্রিক পুনর্গঠন এখন ভঙ্গুর অবস্থায় আছে। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত সবাই পুলিশকে ব্যবহার করেছে। অন্যায়কারীদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। বিচার বিভাগের সঙ্গে পুলিশের সমন্বয় করতে হবে। পুলিশ একজনকে ধরে নিয়ে যায় কিন্তু পরে সে ম্যাজিস্ট্রেটকে টাকা দিয়ে বের হয়ে যায়। এমনটি যেন না হয়।
একুশে সংবাদ/বিএইচ
আপনার মতামত লিখুন :