সংবিধান সংস্কার কমিশন ২৫ বছরের পরিবর্তে ২১ বছরেই নির্বাচন করার প্রস্তাবনা, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ গঠন, প্রধানমন্ত্রী পদে দুই মেয়াদের বেশি থাকবেন না এমন বিধান এবং এককেন্দ্রিক ক্ষমতা ঠেকানোর জন্য নানা প্রস্তাবনা দিচ্ছে। চলতি মাসের মাঝামাঝিতে এসব প্রস্তাব প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেওয়া হবে। তারা স্বৈরাচারের পক্ষে থাকা ৭০ অনুচ্ছেদসহ বিতর্কিত ধারাগুলো বাতিলের প্রস্তাবও দিচ্ছে। তবে কাগজ-কলমে এসব সংস্কার বাস্তবায়িত করতে রাজনৈতিক ঐক্যের ওপর জোর দিচ্ছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞরা।
স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন সরকার ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে বারবার সংবিধানকে পরিবর্তন করেছে। সংসদীয় ব্যবস্থা পরিবর্তন করে একদলীয় শাসন বা সামরিক শাসনকে বৈধতা দিতে সংবিধানকে ব্যবহার করা হয়েছে। সর্বশেষ ১৬ বছরে শেখ হাসিনা সরকার স্বৈরতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে পঞ্চদশ সংশোধনীসহ বেশ কয়েকটি পরিবর্তন করেছে। সবমিলিয়ে ১৯৭২ সালের সংবিধানে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ১৭ বার পরিবর্তন আনা হয়েছে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালানোর পর সংবিধান পরিবর্তনের দাবি ওঠে। এই প্রসঙ্গে পুনর্লিখন না সংস্কার—এ বিষয়ে বিভিন্ন শিবিরে মতভেদ দেখা দেয়। ৬ অক্টোবর গঠন করা হয় সংবিধান সংস্কার কমিশন। কমিশনের সদস্যরা তিন মাসব্যাপী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং নাগরিকদের মতামত সংগ্রহ করেছেন।
কমিশন প্রধান ড. আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, বিভিন্ন পক্ষের প্রস্তাবনা এবং ১২০টি দেশের সংবিধান পর্যালোচনা করে সংস্কার প্রস্তাবনা প্রস্তুত করা হয়েছে। তিনি বলেন, পুনর্লিখন না হলেও কার্যকর সংস্কারের মাধ্যমে জন-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের আশা করা হচ্ছে।
গণমাধ্যমে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে ড. আলী রীয়াজ বলেন, "গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে হবে এবং জবাবদিহির ব্যবস্থা করতে হবে। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে অংশীজনদের একটি বড় অংশ তাদের মতামত জানিয়েছেন। আমরা তাদের আকাঙ্ক্ষা ও চিন্তাগুলোকে সমন্বয় করার চেষ্টা করছি।"
একনায়কতন্ত্র ঠেকাতে ক্ষমতার ভারসাম্য আনার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে কমিশন। সেই উদ্দেশ্যে, ড. আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, তারা দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ ব্যবস্থার প্রবর্তন, প্রধানমন্ত্রী পদে দুই মেয়াদের বেশি না থাকার বিধান এবং রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনার প্রস্তাবনা নিয়ে কাজ করছেন।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, অনেক ধরনের মতামতের প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে, এবং তাই আমরা এটাকে ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করেছি। তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রীর পদে একটি কার্যকর জবাবদিহি ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে।
তরুণদের দেশ গঠনের সুযোগ দিতে সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের বয়স ৪ বছর কমিয়ে ২১ করা হচ্ছে। এছাড়াও, সংবিধানের বিভিন্ন বিতর্কিত ধারা পরিবর্তনের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা রাখা হচ্ছে।
আলী রীয়াজ বলেন, সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য বর্তমানে ২৫ বছর বয়স নির্ধারিত রয়েছে, যা আমরা কমিয়ে ২১ বছর করার প্রস্তাব বিবেচনা করেছি। তিনি আরও বলেন, ১৯৭২ সাল থেকে সংবিধানে যেসব ১৭টি সংশোধন করা হয়েছে, সেগুলোর লক্ষ্য এবং তাদের ফলাফলকে বিবেচনায় নিয়ে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এদিকে এসব সংস্কার প্রস্তাবনাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও, তা কার্যকর হওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ আহসানুল করিম। তিনি বলেন, এসব সংস্কারের সফল বাস্তবায়ন রাজনৈতিক ঐক্যের ওপর নির্ভরশীল।
আহসানুল করিম বলেন, কী সংস্কার হবে, সেটা প্রতিটি দলকে একমত হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। জনগণের স্বার্থে প্রতিটি দলকে এমনভাবে একমত হতে হবে, যাতে সংস্কারের বিষয়ে পরবর্তী যে সরকারই আসুক, তারা যেন সেই সংস্কারের জন্য দায়বদ্ধ থাকে।
প্রস্তাবনা শেষে সব অংশীজনের মতামত গ্রহণ করে চূড়ান্ত সংস্কার প্রস্তাবনা তৈরি করবে অন্তর্বর্তী সরকার।
একুশে সংবাদ/স.ট/এনএস
একুশে সংবাদের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
আপনার মতামত লিখুন :