নদীমাতৃক এ দেশে বিভিন্ন প্রকার জলধারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, যাদের মধ্যে অন্যতম হলো মৌলভীবাজার জেলার হাইল-হাওর। মোলভীবাজর জেলার হাওর এর মধ্যে অন্যতম সাগরসদৃশ বিস্তৃত সুবিশাল জলরাশির প্রান্তর শ্রীমঙ্গলের হাইল-হাওর। দেশের সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার চা অধ্যুষিত উপজেলা শ্রীমঙ্গল এবং হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলাজুড়ে বিস্তৃত এই হাইল ।-হাওর। ১৪টি বিল এবং পানি নিষ্কাশনের ১৩টি নালা সহ এই হাওরটির মোট আয়তন এই হাওরটির মোট আয়তন ১০ হাজার হেক্টর; যার ৪ হাজার হেক্টর প্লাবন ভূমি, ৪ হাজার ৫১৭ হেক্টর হাওর, ১ হাজার ৪০০ হেক্টর বিল, ৪০ হেক্টর খাল এবং ৫০ হেক্টর নদী।
দেশি-বিদেশী বিভিন্ন প্রজাতির পাখির বিচরণ ছাড়াও আরও অনেক বিরল বিপন্ন প্রাণীসহ উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য দেশ-বিদেশে অতি সু পরিচিত এই হাইল-হাওর।মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলায় অবস্থিত মৎস অভয়াশ্রমখ্যাত বাইক্কাবিলসহ মোট ১৩১টি বিল ছিল এই হাইল-হাওরে । কথিত আছে একসময় ‘৩৫২ ছড়ার অস্তিত্ব ছিল এই হাইল হাওরে। কিন্তু ভূমি দখল করে গণহারে মাছের খামার ও ভরাটসহ বিভিন্ন কারণে সুপরিচিত এই হাইল হাওর এখন বিলীনের পথে। হাওরের ছোট-বড় মিলিয়ে ১৩১ টি বিলের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। ৩০টি বিলের কোনো হদিস নেই। এছাড়া ৩৫২ ছড়ার হাইল হাওরের দুই-তৃতীয়াংশ ছড়া (খালের মতো পানিপ্রবাহ) হারিয়ে গেছে।
সরকারি হিসাবে হাইল হাওরের আয়তন ১৪ হাজার হেক্টর। কিন্তু বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-এর কর্মীরা বলছেন, বর্তমানে এই হাওরের প্রকৃত আয়তন ৭ হাজার হেক্টরেরও কম। সরকারের মৎস্য বিভাগের পরিসংখ্যানমতে ২০১৪ সালে হাইল হাওরে বাণিজ্যিক মাছ চাষের জন্য তৈরি পুকুরের আয়তন ছিল ৮৬৩ হেক্টর। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৩শ হেক্টরে। তবে স্থানীয়রা বলছেন, বাস্তবে বাণিজ্যিক মাছ চাষের পুকুরের মোট আয়তন ৩ হাজার হেক্টর হবে। মাছের অভয়াশ্রম হিসেবে পরিচিত এই হাইল হাওরের সরকারি হিসাবে যে মোট আয়তন ১৪ হাজার হেক্টর, তার মধ্যে শ্রীমঙ্গলে পড়েছে ১০ হাজার হেক্টর। বাকি ৪ হাজার হেক্টর মৌলভীবাজার সদর উপজেলায়।সরেজমিনে ঘুরে ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৮০ সালের পর থেকে বাণিজ্যিক মাছের খামার গড়ে উঠতে থাকে হাইল হাওরে।
তবে ২০০০ সালের পর থেকে এর ব্যাপকতা বাড়ে। হাইল হাওরে বাণ্যিজিক মাছ চাষ শুরুর পর থেকে মৎস্য খামারিরা গড়ে তুলছেন বিশাল বিশাল পুকুর। অভিযোগ আছে, কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই একের পর এক মৎস্য প্রকল্প গড়ে তুলছেন প্রভাবশালীরা। খাসজমি দখল কিংবা ভূমিহীনদের নামে সরকারের বন্দোবস্ত দেওয়া জমি বিভিন্ন কৌশলে আয়ত্তে নিয়ে প্রভাবশালীরা গড়ে তুলছেন মৎস্য প্রকল্প। শস্য ও মৎস্যভা-ার খ্যাত হাইল হাওর। প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য ও জীবন-জীবিকার বিবেচনায় স্থানীয়দের কাছে গুরুত্বপূর্ণ এই জলাভূমি এখন মৎস্য খামারিদের দখলে। অবৈধ দখল ও অপরিকল্পিত পুকুর খননে হাওর হারাচ্ছে তার অস্তিত্ব, ধ্বংস হচ্ছে দেশীয় মাছের প্রজনন ক্ষেত্র, জীববৈচিত্র্য পড়ছে হুমকির মুখে। পরিবেশবাদীরা বলছেন, অতি দ্রুত পরিকল্পিত উদ্যোগ না নিলে এই হাওর বিলীন হওয়া শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র।ক্রমশই সংকুচিত হয়ে পড়ছে দেশীয় মাছের অভয়াশ্রম হাইল হাওরের বিলগুলো। চিরদিনের জন্য বিলীন হয়ে যাচ্ছে একের পর এক বিল এবং দেশীয় প্রজাতির মাছ। একই সঙ্গে বেকার হচ্ছে মৎস্যজীবীরা।হাইল-হাওরের উপর জীবিকা নির্বাহ করা মৎসজীবি সম্প্রদায়ের লোকজন জানান চইড়া বিল এখন আর নেই। সেখানে প্রভাবশালীরা দখলে নিয়ে গড়ে তুলেছেন কৃত্তিম মৎস ফিশারি (হাইব্রিড মাছের খামার)।হাইল হাওরের একটি বিলের নাম চইড়া বিল। এই বিলের ৯০ ভাগ জমির ওপর গড়ে উঠেছে প্রভাবশালীদের বিশাল বাণিজ্যিক মাছের খামার।সরেজমিন অনুসন্ধান এবং স্থানীয় ময়হ্যজীবীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে ,দখলদাররা ভূমিহীনদের নামে লিজ দেয়া জমিগুলো অল্প দামে কিনে বাকি ৯০ ভাগ সরকারি খাস জমিই ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে অবৈধভাবে দখল করে গড়ে তুলেছেন বাণিজ্যিক মাছের খামার।’
অনুসন্ধানে আরো দেখা গেছে ,সম্পূর্ণ অবৈধ পন্থায় অতীতে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রভাব খাটিয়ে সরকারি জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা হয়েছে। অবৈধভাবে হাওরের জমির শ্রেণী পরিবর্তন করে বাণিজ্যিক ফিশারি করার কারণে দিন দিন হাওর সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে । এর ফলে এই বিলে থাকা দেশীয় মাছের বংশ তো শেষ হয়েছেই, সাথে সাথে এই বিলে পাওয়া যেত বিভিন্ন প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ। যা এই এলাকার কৃষকরা গবাদি পশুর খাবার হিসেবে সংগ্রহ করতেন। কিন্তু এসব এখন আর তেমন একটা পাওয়া যায় না বললেই চলে।’ এই চিত্র শুধু চইড়া বিলে নয়, হাওরের অধিকাংশ বিলই এখন বাণিজ্যিক মৎস ফিশারি। এই খাস জমির বেশ কিছু অংশ সরকার ভূমিহীনদের নাম দিয়েছেন। কিন্তু ভূমিহীনরা সেখানে যেতেই পারে না। বরং দখলবাজ সুবিধাবাদীর দল সামান্য টাকায় ভূমিহীনের খাসজমি লীজের সেই কাগজ সংগ্রহ করে, তাদের সাথে দেখা করে কৌশলে তাদের কাছ থেকে জমিগুলো নিয়ে নেয়। পরে খাস জমিগুলো ও তারা কৌশলে তাদের আয়ত্তে নিয়ে বাণিজ্যিক ফিশারি গড়ে তুলেছে ।’
এই হাওরের হাজার হাজার একর বিলের জমি দখল করে ফিশারি করেছেন প্রভাবশালী একটি চক্র।’রাজনৈতিক নেতাদেরপৃষ্টপোষকতায় দিনের পর দিন হাইল -হাওর গিলে খাচ্ছে তারা।’ফলে হুমকির মুখে পড়ছে হাইল-হাওর, জীববৈচিত্র্য ।’
মৎস ও প্রাণী সম্পদ অফিসের তথ্য বলছে , হাইল হাওরের আয়তন ১৪ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে শ্রীমঙ্গল উপজেলায় পড়েছে ১০ হাজার হেক্টর। এর ভেতরে বিল রয়েছে ৫৯টি, যার মধ্যে ২০ একরের নিচে ৩৯টি এবং ২০টি ২০ একরের ওপরে। যা থেকে উপজেলার মাছের চাহিদা পূরণ হয়ে থাকে। এই বিলগুলো হাওরের চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। অনেকের ব্যক্তিগত জমির সাথে সরকারের খাস জ জমিও গিলে ফেলছে দখলদার চক্রটি । ভূমি দখলদারের লোভের বলি হয়ে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি বিল স ইতোমধ্যে ম্পূর্ণভাবে বিলীন হয়ে গেছে ।
হাইল হাওরের বিলে একসময় প্রায় শত প্রজাতির দেশীয় মাছ পাওয়া যেত। বর্তমানে প্রায় ৩০ প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এই হাওরে এসে মিশেছে অর্ধশত ছড়া, যা গোপলা নদীতে পড়েছে। অনেকে সেই ছড়াগুলোও দখল করে নিয়েছে এবং নিচ্ছে। এতে হাওরের জীববৈচিত্র্য জলজ উদ্ভিদ ধ্বংসের পাশাপাশি পানির গতি প্রবাহ পরিবর্তন হচ্ছে। ফলে ক্ষতির মুখে পড়ছে হাওরের বোরো চাষিরাও। দেশীয় মাছ রক্ষা করি, সমৃদ্ধ দেশ গড়ি এই স্লোগানকে বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদের হাওর ও উন্মুক্ত জলাশয়কে রক্ষা করতে হবে। জলাভূমি তৈরি করে ফিশারি তৈরি করা রাঘববোয়ালদের কঠোর হাতে দমন করতে হবে। একই সাথে হাইল হাওরে জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা শতভাগ বন্ধ করতে হবে। তা না হলে সামনে বড় রকমের বিপর্যয় আসবে।’হাইল হাওরের চারপাশে ১০ হাজারের বেশি মৎসজীবি পরিবারের বসবাস। যেখানে বসবাসরত জনসংখ্যা প্রায় ৪০ হাজারেরও বেশি। ইতিমধ্যে মৎসজীবীদের অর্ধেকেরও বেশি বাধ্য হয়ে জীবিকা পরিবর্তন করে অন্য পেশা বেছে নিতে বাধ্য হয়েচ্ছে । তাছাড়া এ পেশা ছাড়ার অপেক্ষায় আছেন হাইল -হাওর অঞ্চলে বসবাসকারী কয়েক হাজার মৎসজীবি পরিবার ।
অনুসন্ধানে জানা যায় , হাইল হাওরের ১৩১টি বিলের মধ্যে ১০১টি বিল ইজারার রেকর্ড পাওয়া গেছে। বাকি ৩০টি বিলের কোনো হদিস নেই। আর যেগুলোর অস্তিত্ব আছে সেগুলোরও অধিকাংশই দখলে।‘দখল আর দৌরাত্ম্যে হাওর এখন এমন এক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে যে এখন বিশাল হাওরে গবাদি পশুদের বিচরণের জন্য একটু টুকরো খালি জমি খোঁজে পাওয়া দুস্কর হয়ে পড়ছে। এক সময় সরকারি খাস জমিগুলোতে কৃষকরা দলবদ্ধভাবে ধান মাড়াই করতেন, এখন সে সুযোগটিও নেই। সবই এখন দখলের কবলে ।’হাইল হাওরের পুরনো ঐতিহ্য ধরে রাখতে সরকারি খাস জমি দখলমুক্ত এবং এর শ্রেণি পরিবর্তনকারীদের কঠোর আইনের আওতায় আনা অতীব জরুরি মনে করছেন শ্রীমঙ্গলের পরিবেশবাদী সংগঠন জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ফাউন্ডেশন । ‘হাইল হাওরের দালিলিক আয়তন হচ্ছে ১৪ হাজার হেক্টর। এর ২০টি বিলের আয়তন ২০ একরের ওপরে। আসলে হাইল হাওর ছোট হতে হতে ক্রমান্বয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে বর্তমানে এর পরিমাণ সাত হাজার হেক্টরেরও কম। হাওরের জায়গা কমে যাওয়ার অন্যতম আরেকটি কারণ হচ্ছে হাওররের জলাভূমি ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে অবধপন্থায় দখল করে ভরাট করে বাণিজ্যিক ফিশারির গড়ে তোলা ।’
একসময় ‘হাইল হাওর ছিল প্রচুর গভীর ফলে একসময় এই হাইল-হাওর অঞ্চল দিয়ে প্রচুর জাহাজের চলাচল ছিল। শ্রীমঙ্গল শহরতলির উত্তর ভাড়াউড়ায় এলাকার হাওর অভিমুখে জেটি ছিল। সখনো এই স্থানটি জেটি রোড নামে সুপরিচিত । বলা যায় দখলের কবলে পরে অস্তিত্ব হারিয়ে এখন বিলীন এই এই হাওর। পরিবেশবিদরা আশংকা প্রকাশ করে জানিয়েছেন অতি দ্রুত যদি ব্যবস্থা নেওয়া না হয় এবং যারা দখল করেছে তাদেরকে আইনের আওতায় না আনা না হয় তাহলে অচিরেই অবশিষ্ট হাওর বিলীন হয়ে যাবে, যা প্রকৃতি ও পরিবেশ এর জন্য মারাত্মক অশনি সংকেত বলে মনে করছেন পরিবেশবিদ সহ পরিবেশ সংরক্ষণে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন "জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ফাউন্ডেশন"সহ অন্যান্য পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো ।
ইতোপূর্বে সাবেক জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারগণ সরেজমিন পরিদর্শন করে হাইল-হাওর দখলের মহোৎসবের কথা সাংবাদিকদের নিশ্চিত করে বলেছিলেন ‘আমরা সরেজমিনে কয়েকবার হাওর পরিদর্শন করে দখলের ভয়াবহ চিত্র দেখে এসেছি। হাওর দখল কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার মতো না। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য হাওর-জলাশয় খুব গুরুতৃপূর্ণ জানিয়ে হাওর দখলমুক্ত করতে তারা খুব দ্রুত কার্যক্রম চালানোর কথা জানালেও আজ অবধি দৃশ্যমান কোনো ফলাফলই দেখা যায়নি
লেখক: হৃদয় দেবনাথ (সাংবাদিক ও পরিবেশবাদী)
পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক
একুশে সংবাদ/ এস কে
আপনার মতামত লিখুন :