১৯৭১-এর ২৫ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও বিরোধীদলীয় নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর যোগসাজশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পরিকল্পিতভাবে বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে সার্চলাইট অপারেশনের নামে এদেশে গণহত্যা শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে বাঙালি দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর ৯৩ হাজার সৈন্যের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত এই দীর্ঘ নয় মাসে ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা ও ৪ লাখের অধিক মা-বোন ধর্ষণের শিকার হয়।
বঙ্গবন্ধু কারাগার থেকে ফিরে আসার পর যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট গণহত্যা-ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের অভিযোগ আছে এমন প্রায় ৩৬ হাজার রাজাকার-আলবদর, আলশামসের বিচারের পাশাপাশি পরিকল্পনাকারী, নির্দেশদাতা ও সরাসরি হত্যা-ধর্ষণ, লুটপাটে যুক্ত চূড়ান্তভাবে ১৯৫ জন সেনা কর্মকর্তাকে বিচারের জন্য মনোনীত করেন।
সর্বশেষ ত্রিপক্ষীয় সিমলাচুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তান তাদের অপরাধের জন্য দুঃখপ্রকাশ করে ১৯৫ জন সেনাকর্মকর্তাকে নিজ দেশে নিয়ে বিচার করবে এই মুচলেকা দিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু তারা আর বিচার করেনি। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতায় আসা সরকারগুলোর বেশিরভাগই গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধের বিষয়টি নিষ্পত্তি না করেই পাকিস্তানের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ার চেষ্টা চালায়।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর গণহত্যার জন্য বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা, যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ, সম্পদের হিস্যাসহ বিভিন্ন দাবি তোলে। সেই সঙ্গে ১৯৭১ সালের গণহত্যা, যুব্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের উদ্যোগে শুরু থেকেই বিচলিত ছিল পাকিস্তান।
এর পাশাপাশি ২০১৩ সালের ১ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত গ্যারি জে ব্র্যাসের লেখা গ্রন্থ ‘দ্য ব্ল্যাড টেলিগ্রাম–নিক্সন, কিসিঞ্জার অ্যান্ড এ ফরগটেন জেনোসাইড’ পাকিস্তানি গণহত্যার তথ্য বিশ্বের সামনে নতুন করে তুলে আনে। আর এতেই পাকিস্তানের গাত্রদাহ শুরু হয়। অথচ মুক্তিযুদ্ধে এই পরাজিত শক্তি ও তাদের এদেশীয় দোসররা মুক্তিযুদ্ধকে মেনে নিতে পারেনি। পাকিস্তানি শাসক, সেনা ও রাজনৈতিক দলগুলোর একটি বড় অংশ এবং এদেশীয় জামায়াত-শিবির এখনও মনে করে বাংলাদেশ সৃষ্টি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের ফসল বা জামায়াতের ভাষায় গণ্ডগোলের ফল।
চলতি বছর ২৫ জানুয়ারি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এক উন্মুক্ত আলোচনায় ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি টিএস ত্রিমূর্তি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা ও ২০০৮ সালে মুম্বাই গণহত্যার আন্তর্জাতিক বিচার দাবি করেন । ভারতীয় প্রতিনিধি দুনিয়াব্যপী রাষ্ট্রীয়ভাবে সন্ত্রাস বেড়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে বলেন- আঞ্চলিক, বিশ্ব শান্তি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে সন্ত্রাস প্রতিরোধে বিশ্ব সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহবান জানান । তবে উক্ত আলোচনায় বাংলাদেশ প্রতিনিধির বক্তব্য পাওয়া যায়নি । দেখতে দেখতে স্বাধীনতা অর্জনের সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হলো । এসব অনুষ্ঠানে সব মহলের পক্ষ থেকে ২৫ মার্চ গণহত্যার বিচারের দাবি উচ্চারিত হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস পালন করা হলেও আন্তর্জাতিক পরিসরে এই দিবসটি এখনও উপেক্ষিত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দক্ষিণ এশিয়ায় ১৯৭১-এ সারা পৃথিবী কাঁপিয়ে যে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়েছিল, এর দ্বিতীয় নজির নেই। বাঙালি জাতির গর্ব করা ইতিহাসের মীমাংসিত বিষয় নিয়ে এখনও কেউ কেউ যখন শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তখন দুঃখ হয়।
পরাজিত শক্তি ও স্বাধীনতাবিরোধীরা তা লুফে নিয়ে মাঠে নামবে এটাই স্বাভাবিক। আর এরই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের তত্ত্বাবধানে সাম্প্রতিককালে সুলতান আলী নামে সাবেক এক সেনা কর্মকর্তাকে দিয়ে ‘টরম্যানট ট্রুথ ইন ১৯৭১’ নামে একটি বই প্রকাশ করা হয়। যে বইতে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে চরমভাবে হেয় করা হয়েছে। বইটিতে পাকিস্তানের নতুন প্রজন্মকে বোঝানো হচ্ছে যে, বাংলাদেশের সৃষ্টি ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের ফসল ।
পাকিস্তানের দুই অংশের নেতৃবৃন্দের মধ্যে আলোচনার ঘাটতি বা সমঝোতার অভাবে প্রতিবেশী ভারত সেই সুযোগ নিয়ে এবং উসকানি দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে অশান্তি বা গণ্ডগোলের সৃষ্টি করায়। বইটিতে পাকিস্তান বা ইসলাম রক্ষার নামে পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালি মুসলিম হত্যা নয় বরং অমুসলিমদের হত্যার টার্গেট করেই এগিয়েছে। বইটির পাতায় পাতায় এমনই মিথ্যাচার করা হয়েছে। একইভাবে ২০১৯ সালে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ওই দেশটির লেখক জুনায়েদ আহমেদ নামে এক ব্যক্তিকে দিয়ে ‘ক্রিয়েশন অফ বাংলাদেশ মিথস এক্সপ্লডেড’ শিরোনামে একটি বই লিখিয়েছে।
এই বইটিতেও মুক্তিযোদ্ধাদের দোষারোপ করা হয়েছে এই বলে- পঁচিশে মার্চের গণহত্যার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা দায়ী। তারাই নিরীহ নিরাপরাধ মানুষদের হত্যা করেছে। বইটির নিচে ওই সময়ের বিশ্বখ্যাত বিভিন্ন পত্রিকায় ৭১-এর গণহত্যার যেসব ছবি মুদ্রিত হয়, সেসব ছবি বইটিতে সংকলিত হয়েছে এবং প্রতিটি ছবির নিচে লেখা হয়েছে এসব হত্যাকাণ্ড মুক্তিযোদ্ধাদের সৃষ্টি।
মহান মুক্তিযুদ্ধর ইতিহাস নিয়ে পাকিস্তানসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর অপপ্রচার যতই করুক না কেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ১৯৭১ সালের গণহত্যার তথ্যপ্রমাণের অভাব নেই। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ মানুষ যে শহীদ হয়েছে তার অকাট্য প্রমাণ বহন করছে সে সময়ে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক পত্রপত্রিকা এবং রেডিও টেলিভিশনের খবরগুলোর আর্কাইভ । অস্ট্রেলিয়ার ওই সময়ের পত্রিকা হেরালড ট্রিবিউনের রিপোর্ট অনুসারে ২৫ মার্চ রাতে শুধু ঢাকা শহরেই ১ লাখ মানুষকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী। ভারতের ইন্ডিয়ান টাইমসের রিপোর্টে আছে ৬০ থেকে ৭০ হাজার মানুষ শহীদ হয়েছে।
মার্কিন সিনেটর অ্যাডওয়ার্ড কেনেডি ভারতে শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করেন ’৭১ সালে। তিনি পাকিস্তানি সৈনিকদের বিরুদ্ধে সরাসরি গণহত্যা চালানোর অভিযোগ করেন। গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞকে বিশ শতকের পাঁচটি নৃশংস গণহত্যার চেয়েও ভয়ংকর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। টাইমস ম্যাগাজিনের ডেন কগিন, যিনি মুক্তিযুদ্ধর প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক, একজন পাকিস্তানি ক্যাপটেনের বরাত দিয়ে লিখেছেন- ২৫ মার্চে ঢাকা শহরেই লক্ষাধিক লোককে হত্যা করা হয়। এছাড়া দীর্ঘ ৯ মাসের প্রতিদিনই জেলা শহর ও মফস্বল অঞ্চলে শত শত বাঙালিকে হত্যা করে বধ্যভূমিতে ফেলে রাখা হয়। সেই সঙ্গে বিশ্বখ্যাত এই পত্রিকাটির একটি সম্পাদকীয় মন্তব্য ছিল- ‘It is the most incredible calculated thing since the clays of the Nayis in Poland.’
আন্তর্জাতিক মহলের মতে, ৭১-এ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তিন মিলিয়ন বা ত্রিশ লাখ বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে । এই সংখ্যার সমর্থন রয়েছে Encyciopedia Americana and National Geographic Megagine–এ। এসব রিপোর্টে লেখা আছে, বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তান বাহিনীর নিষ্ঠুরতা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পোল্যান্ডে নাজি বাহিনীর বর্বরতার চেয়েও ভয়াবহ। এই গণহত্যা সম্পর্কে পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলী তার ডায়েরিতে লিখেছেন– “Paint the green of East Pakistan red.” অর্থাৎ বাংলার সবুজ মাঠকে লাল করে দাও। একজন মার্কিন গবেষক Rudolph Joseph Rummel তার রচিত Statistics of Democide (১৯৮৮) গ্রন্থের অষ্টম অধ্যায়ে তিনি অন্তর্ভুক্ত করেছেন “Statistics of Pakistan Democide –Estimates Caculation and sources” শীর্ষক নিবন্ধটি। এই নিবন্ধে Rummel তার আবিষ্কৃত গণহত্যার পরিসংখ্যান পদ্ধতি অনুসারে দেখিয়েছেন যে, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধর সময় বাংলাদেশে ত্রিশ লাখ ৩ হাজার লোক প্রাণ হারিয়েছেন। ১৯৭১ সালের ইউনাইটেড নেশনস হিউম্যান রাইটস কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী মানবসভ্যতার ইতিহাসে যতগুলো গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে তাতে অল্প সময়ের মধ্যে সব থেকে বেশি সংখ্যক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে। প্রতিদিন গড়ে ৬ থেকে ১২ হাজার মানুষ তখন খুন হয়। গণহত্যার ইতিহাসে এটাই সর্বোচ্চ গড় ।
১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘বেঙ্গলিজ ল্যান্ড অ্যা ভাসটি সিমেট্রি’ (বাঙালির ভূখণ্ড এক বিশাল সমাধিক্ষেত্র) মার্কিন সংবাদিক সিডনি এইড শানবার্গ যুদ্ধের পরপর বাংলাদেশে এসে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ওই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছিলেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, শানবার্গ দেখতে পান, বাংলাদেশের প্রতিটি শহর, প্রতিটি থানায় রয়েছে বধ্যভূমি, যেখানে পাকিস্তানি সেনারা যুদ্ধের ৯ মাসের প্রতিদিন বাঙালিদের হত্যা করেছে। পাকিস্তানি সেনারা এভাবেই লাখ লাখ বাঙালি হত্যা করেছে।
বাঙালি গণহত্যার দলিল ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের ১০ দিন পর ২৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সরকারের নির্দেশে প্রধান বিচারপতি হামুদুর রহমানকে প্রধান ও অন্য দুই বিচারপতিকে নিয়ে উচ্চ ক্ষমতার একটি কমিশন গঠিত হয়েছিল। কমিশন যুদ্ধর সঙ্গে যুক্ত সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তি মিলিয়ে ২ শ’ ৮৫ জনের সাক্ষ্য এবং তথ্য প্রমাণ নির্দেশিকা যাচাই বাছাই শেষে ১৯৭৪ সালে চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করে ।
যদিও কমিশন ভিকটিম বা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কাউকে সাক্ষ্য গ্রহণ না করলেও ৬০টি অধ্যায় ও ৩ লাখ শব্দে এই কমিশনের রিপোর্টে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের বিষয়টি অগ্রাহ্য করেছে। এসব অপূর্ণতা সত্ত্বেও ওই রিপোর্টে এমন কিছু তথ্য পাওয়া গেছে, যাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের নৃশংসতা ও নিষ্ঠুরতার পাশাপাশি চারিত্রিক দুর্বলতাগুলো তথ্য প্রমাণসহ উপস্থাপিত হয়েছে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী অভিযানের শুরু থেকেই বাংলাদেশে ‘পোড়ামাটি নীতি’ গ্রহণ করে, যেখানে তারা মানুষ চায়নি, মাটি চেয়েছে। এই কথাটি শুধু রাও ফরমান আলীর ডায়েরিতে লেখা ছিল না, ছিল পাকিস্তানের অধিকাংশ সেনা কর্মকর্তার অন্তরে।
জেনারেল নিয়াজির আগে খাদিম হুসেন ছিলেন ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডিং অফিসার। তিনি স্ট্রেনজার ইন মাই ওন কান্ট্রি , পাকিস্তান(১৯৬৯-১৯৭১) বইয়ে উওরসূরির বক্তব্য উল্লেখ করেছেন, যাতে নিয়াজি বলেছেন, এই হারামজাদা জাতি জানে না আমি কে? আমি তাদের জাত বদলে দিব। তিনি বাঙালিকে বোঝাতে পারেননি, বাঙালিই প্রকাশ্যে আত্মসমর্পণ করিয়ে তাকে ঠিকই বুঝিয়ে দিয়েছে। কমিশনের রিপোর্টে রাও ফরমান আলী, জেনারেল টিক্কা খানকে দায় মুক্তি দিয়ে শুধু অন্য সিনিয়র অফিসারদের বিরুদ্ধে সামরিক আইনে বিচার এবং বাকিদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করে।
এবার দেখা যাক জাতিসংঘ সনদ কী বলে? জাতিসংঘ গণহত্যা-বিষয়ক সনদে অপরাধের যে বিবরণ রয়েছে, তার সঙ্গে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে দখলদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ ও নৃশংসতার পুরোপুরি মিল রয়েছে। গণহত্যা প্রতিরোধ ও শান্তিবিষয়ক ১৯৪৮ সালের জাতিসংঘ সনদের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জেনোসাইড বলতে বোঝাবে কোনো জাতি বা জাতিসত্তা, বর্ণ বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর সদস্যদের অংশবিশেষকে বা পুরোপুরি ধ্বংস করার লক্ষ্যে পরিচালিত নিম্নবর্ণিত কাজের যেকোনো একটি-
ক. জাতি বা গোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা করা
খ. জাতি বা গোষ্ঠীর সদস্যদের গুরুতর মানসিক বা শারীরিক ক্ষতিসাধন
গ. উদ্দশ্যমূলকভাবে জাতি বা গোষ্ঠীর ওপর এমন এক জীবনযাত্রা আরোপ করা যা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে গোষ্ঠীর ধ্বংস ডেকে আনে
ঘ. জাতি বা গোষ্ঠীকে জোর করে অন্য জাতি বা গোষ্ঠীতে রূপান্তর। জাতিসংঘ প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর গণহত্যা প্রতিরোধ ও গণহত্যার শিকার হওয়া ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
বাংলাদেশ মনে করে এ দেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধগুলোর আনুষ্ঠানিক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও বিচার প্রয়োজন। পাকিস্তান সরকার ও তাদের এদেশীয় ধ্বজাধারীদের অনেকে সাম্প্রতিক ১৯৭১ সালের সংঘটিত গণহত্যার কথা ধারাবাহিকভাবে অস্বীকার করার চেষ্টায় এই স্বীকৃতি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পাকিস্তানি শাসক ও কিছু রাজনৈতিক দল, তাদের এদেশীয় দোসরদের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী বিচারের বিরোধিতা করে বিবৃতি দেয় এবং পার্লামেন্টে প্রস্তাব গ্রহণ করে। পাকিস্তান এখানেই থেমে থাকেনি, তারা বই লিখে মিথ্যাচারের পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অপ্রয়োজনীয় ও অযৌক্তিক হস্তক্ষেপ, জঙ্গি সৃষ্টি ও এদের কাজে মদদ দিয়ে যাচ্ছে। ভবিষৎ প্রজন্মের শান্তি, নিরাপত্তার স্বার্থে পাকিস্তানের এই ষড়যন্ত্র ও মিথ্যাচার রুখে দিয়ে ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টার পাশাপাশি পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার বিচারের দাবিটিও জোরদার করতে হবে।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের কাজটি বাংলাদেশের জন্য একটু কঠিন কাজ হতে পারে। কেননা ১৯৭১ সালে সব রাষ্ট্রের অবস্থান বর্তমানের মতো ছিল না । ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বন্ধুরাষ্ট্র ছিল। আজ মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনে জাতিসংঘ, আমেরিকাসহ পশ্চিমা ও মুসলিম বিশ্ব তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে তারা আমাদের পাশে ছিল না।
স্বভূমি থেকে ১০ লাখ রোহিঙ্গা বিতাড়ন ও হাজারের অধিক রোহিঙ্গা নিধনে জাতিসংঘসহ সব রাষ্ট্র গণহত্যার স্বীকৃতি দিচ্ছে। অথচ ১৯৭১ সালে রোহিঙ্গাদের চেয়ে ১০ গুণ বাঙালি বিতাড়ন ও ৩ হাজার গুণ নিধনে তারা ছিল নীরব। কাজেই তাদের স্বীকৃতি আদায়ে বিদেশে আমাদের মিশনগুলোও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে গণহত্যাবিষয়ক তথ্য উপাত্ত তুলে ধরার পাশাপাশি জোরদার কূটনীতিক তৎপরতা চালাতে তারপর অন্য সব দেশের স্বীকৃতি আদায়ের পাশাপাশি গণহত্যার বিচারের বিষয়টিও আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করাও জরুরি।
লেখক: শিক্ষক-গবেষক, কলাম লেখক
একুশে সংবাদ/এসএপি
আপনার মতামত লিখুন :