হার্টের সমস্যা বর্তমান একটি অন্যতম আতঙ্কের নাম। হার্টের সমস্যা শুধু বড়দের নয়, শিশুদেরও হতে পারে। এই সমস্যা নানা ধরনের হয়। গর্ভাবস্থা থেকেই শিশুকে নিয়ে মা-বাবা বেশ চিন্তিত থাকেন। কিন্তু এই চিন্তা যখন বাস্তবে রূপ নেয় তখন মা-বাবার ঘুম হারাম হয়ে যায়। শিশুদের জন্মগত রোগের মধ্যে হৃদরোগ অন্যতম। যা শুরু মায়ের গর্ভ থেকেই। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি ১০০০ জন জীবিত শিশুর মধ্যে ৮ জন শিশু জন্মগত হৃদরোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। এই ১০০০ জনের ৮ জনের মধ্যে আবার ২-৩ জনের রোগের লক্ষণ জন্মের প্রথম ৬ মাসের মধ্যেই নানাবিধ উপসর্গ সহ প্রকাশ পায়। বাকিদের পরবর্তীতে জীবনের যেকোনো সময় তা প্রকাশ পেতে পারে। আর আমাদের দেশে গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর ২৫ থেকে ৩০ হাজার শিশু জন্মগত হৃদরোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। যাদের চিকিৎসা করতে হিমশিম খেতে হয়।
আবার অনেক গরিব রোগীর পিতা-মাতা চিন্তায় প্রায় পাগলের মতো হয়ে যান। শিশুদের ক্ষেত্রে হৃদপিণ্ডের সমস্যা দুই প্রকারের হয়ে থাকে। প্রথমটি হল জন্মগত। আর দ্বিতীয়তটি জন্মের পরে হওয়া সমস্যা।আর কিছু শিশু মায়ের গর্ভে থাকা কালীন অবস্থায় হৃৎপিন্ডের জন্মগত ত্রুটি (যেমন-ছিদ্র, ভাল্ব জটিলতা, সরু রক্তনালী ইত্যাদি) নিয়ে জন্মায়। আবার কিছু শিশু পরবর্তীতে হৃদরোগ আক্রান্ত (রিউমেটিক ফিভার, ভাসকুলাইটিস, মায়োপ্যাথি) হতে পারে।তাই সচেতন হয়ে, ঠিক সময়ে ঠিকমতো চিকিৎসা করালে শিশুরা সুস্থ জীবনযাপন করতে পারে।।
> শিশু হৃদরোগের কারণঃ
* অন্যান্য জন্মগত ত্রুটি বা সমস্যার মত শিশু হৃদরোগ ও বংশগত কারনে হয়ে থাকে।
*এছাড়া বাবা মায়ের মধ্যে ঘনিষ্ট রক্তের সম্পর্ক থাকলে বাচ্চার এই সমস্যা হতে পারে।
* মায়ের বয়স অধিক হলে (৩৫ বা অধিক) শিশু "Down Syndrome" জনিত জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মাতে পারে।
* তাছাড়া মা যদি গর্ভকালীন সময়ে ভায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপে ভোগেন তাহলেও শিশুর হৃদরোগ হতে পারে।
* গর্ভবস্থায় মায়ের ভাইরাল ডিজিস হলেও বাচ্চার জন্মগত হৃদরোগের সমূহ সম্ভাবনা থাকে।
* একই পরিবারের একজন ভাই বা বোনের জন্মগত হৃদরোগ থাকলে অন্য ভাই বোনদেরও এই ধরনের সমস্যা থাকার সম্ভাবনা থাকে।
* ঘনবসতি এলাকা জন্মেও পরবর্তী সময় শিশুর হার্টের ভাই ও মাংসপেশী জীবাণু সংক্রামন জনিত কারণে আক্রান্ত হতে পারে।
* কিছু কিছু রোগের জটিলতা স্বরূপ শিশু হৃদপিন্ডের রক্তনালী অথবা প্রান্তিক রক্তনালী রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
> শিশু হৃদরোগের উপসর্গঃ
* হৃদরোগ আক্রান্ত শিশুরা ঘনঘন শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়।
* শ্বাসকষ্ট হয়।
* কিছুদিন পর পর শ্বাসকষ্টে ভোগে ও বুকে ঘড়ঘড় শব্দ হয়।
* শিশুর পর্যাপ্ত ওজন হয় না।
* বুক ধড়ফড় করে।
* নীলাভ বর্ণ ধারণ করে ও অল্পতে ক্লান্ত হয়ে যায় (বিশেষত খাবারের সময় ও মল ত্যাগ এর সময়)
* হাত-পায়ের নখ ফুলে যায়।
> শিশুর অভিভাবকের করণীয়ঃ
* শিশুর জন্মের পর যত দ্রুত সম্ভব একজন ডাক্তারের মাধ্যমে শিশুকে। পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে- শিশুর বুকে কোন অস্বাভাবিক শব্দ (Murmur) আছে কি না।
* যদি এধরনের কোন সমস্যা বা ত্রুটি ধরা পড়ে তবে একজন শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে।
* শিশুর টনসিলাইটিস, নেফ্রাইটিস, ভাইরাল রোগ হলে, এই সব রোগকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে শিশু চিকিৎসকের তত্বাবধানে চিকিৎসা করানো উচিত।
> হৃদযন্ত্রের ছিদ্রের সমস্যার কারণ কী?
হৃদযন্ত্রের চারটি চেম্বার থাকে। দুটো এট্রিয়াম, দুটো ভিট্রিক্যাল। দুটো এট্রিয়ামের মাঝে একে বলা হয় ইন্টারেট্রিয়াল সেপট্রাম। দুটো ভেন্টিকুলারের মাঝে একে বলা হয় ইন্টারভেন্টিকুলার সেপট্রাম। সাধারণত ছিদ্র বলতে যাকে বোঝায় বা এই সেপট্রামের দুটো ছিদ্র হতে পারে। কেননা এরা সম্পূর্ণ পর্দা হিসেবে তৈরি হয় না। এটা বিভিন্ন জায়গা থেকে তৈরি হয়ে পর্দাকে সম্পূর্ণ করে। এটি একটি জন্মগত ত্রুটি। সুতরাং এই সম্পন্ন হওয়ার প্রক্রিয়া যদি বাধাগ্রস্ত হয়, কোনোটাতে ত্রুটি হয়—এই পর্দাটা ছিদ্র হিসেবে জন্মের পর আবির্ভূত হয়। জন্মের পরও হার্টের মধ্যে কিছু পরিবর্তন হয়। অনেক সময় পর্দা যদি ছোট থাকে, তাহলে জন্মের পরও এই ছিদ্র বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
> রোগ নির্ণয়ঃ
প্রাথমিক পরিক্ষার পর তিনটি সহজ পরিক্ষা দ্বারা এই রোগ গুলি নির্ণয় করা হয়।
• ECG
• Chest X-Ray
• Color Doppler Echo
> গর্ভবতী মায়ের করণীয়ঃ
*গর্ভধারণের তিন মাস পূর্বে Rubella Vaccine দিলে শিশুর Congenital Rubella Syndrome জনিত হার্টের রোগ হয় না।
* গর্ভকালীন সময়ে যতটা সম্ভব ওষুধ সেবন ও X-Ray করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
* গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত পরিশ্রম করা যাবে না। মাকে বিশ্রাম ও পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করতে হবে।
> শিশুর হৃদরোগের এলোপ্যাথি চিকিৎসাঃ
উন্নত বিশ্বের মত আজ বাংলাদেশেও শিশু হৃদরোগের অধিকাংশ চিকিৎসা করানো সম্ভব।
** ওষুধের মাধ্যমে কিছু হৃদরোগ ভাল হয়ে যায়। যেমন- ASD, VSD, PDA, AS, PS, CoA
** বুক কেটে অপারেশন ছাড়া কিছু রোগীর হৃদরোগ ভলো করা সম্ভব।
** কিছু ক্ষেত্রে রোগীর অপারেশন করানোর প্রয়োজন হয়।
> শিশুর হৃদরোগের হোমিওপ্যাথি
হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় হূদরোগ একেবারে তুচ্ছ, হোমিওপ্যাথি আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে, রোগ এবং রোগের কারণ থাকে মানুষের স্তরে যাকে জীবনীশক্তি বলা হয়, পক্ষান্তে শরীরে এবং মনে আমরা রোগ নামে যা দেখি, এগুলো আসলে রোগ নয় বরং রোগের ফলাফল মাত্র। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতে, যেহেতু রোগ নয় রোগীকে চিকিৎসা করা হয়, এই জন্য মানুষের শক্তি স্তরে কাজেই রোগ নিরাময়কারী ওষুধকেও হতে হবে শক্তি ওষুধ।অভিজ্ঞ চিকিৎসকরা প্রাথমিকভাবে যেসব ওষুধ নির্বাচন করে থাকে, ক্র্যাটিগাস, অরম মেটালিকাম, এডোনিস, ভান্যালিস, অর্জুনআর্নিকা, মন্টেনা, গ্লোনয়িন, ভ্যানাডিয়ম, ল্যাকেসিস, ডিজিটালিস, বেলাডোনা, স্পাইজেলিয়া, এনথেলমিয়া, ন্যাজাট্রাইপুডিয়ামস, নাক্স ভুমিকাসহ আরও অনেক ওষুধ লক্ষণের ওপর আসতে পারে। তাই ঔষধ নিজে নিজে ব্যবহার না করে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
পরিশেষে বলতে চাই, শিশুর হৃদরোগের হলে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এই রোগগুলির ক্ষেত্রে চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। ওষুধেই এই রোগ ভাল হয়। তবে, এই চিকিৎসা একটু ব্যয়বহুল। তবে সবার আগে যেটা দরকার, তা হল শিশুদের বাবা-মায়েদের আগে হৃদপিণ্ডের সমস্যা সম্পর্কে সতর্ক হতে হবে। লক্ষণগুলি নজরে পড়লে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে।আর শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষৎ। শিশুর সুন্দর, সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন আমাদের সকলের কাম্য। তাই জন্মের শুরু থেকেই শিশুদের দিকে পিতা-মাতার বিশেষ যত্ন নেয়া অপরিহার্য।তাই এই বিষয়ে সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে। অন্যান্য রোগ নিয়ে যেমন লাগাতার প্রচার হয়, এই রোগ নিয়েও ভীষণ ভাবে প্রচার প্রয়োজন।
একুশে সংবাদ/ম.প্র/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :