দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের মাধ্যম হিসেবে মার্কিন ডলারের পরিবর্তে রুপি ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারতের বাণিজ্য শুরু হয়েছে। ভারতের দিল্লিতে গত মাসের শেষ সপ্তাহে অনুষ্ঠিত দুই দেশের বাণিজ্যমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে ভারতের পক্ষ থেকে রুপি ব্যবহারের প্রস্তাব দেওয়া হলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তাদের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেওয়ার কথা বলা হয়।
দিল্লি থেকে বৈঠক করে এসে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত কিছু বলতে পারিনি। বলেছি, আলোচনা হতে পারে।’ কিন্তু শেষ পর্যায়ে এসে রুপিতে বাণিজ্য শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট ৮ হাজার ৯১৬ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৬৯ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করা হয় ভারত থেকে। সেই অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারতে রপ্তানি করে ১৯৯ কোটি ডলারের পণ্য। আমদানি-রপ্তানি মিলিয়ে উভয় দেশের মধ্যে ১ হাজার ৫৬৮ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়েছে।
ভারতের রিজার্ভের সমস্যা নেই। ১২ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর ক্ষমতা আছে দেশটির। বড় অর্থনীতির দেশের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্য করার ক্ষেত্রে ঝুঁকির বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে আমাদের। কোভিড-১৯-এর ধাক্কার পাশাপাশি প্রায় এক বছর ধরে চলছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যুদ্ধের কারণে দেশে ডলারের দাম অনেক বেড়ে গেছে। সংকটও তৈরি হয়েছে ডলারের। আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়ে গেছে জিনিসপত্রের দাম। তাতে আমদানি খরচ বেড়ে গেছে। ফলে ডলারের সংকট আরো প্রকট হয়। এমন পরিস্থিতিতে কারেন্সি সোয়াপ ব্যবস্থা বা নিজস্ব মুদ্রা বিনিময়ের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে ভারত। ডলার বা অন্য কোনো হার্ড কারেন্সিকে এড়িয়ে দুটি দেশ যখন নিজেদের মধ্যে নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্য চালায়, সেটিকে আর্থিক পরিভাষায় ‘কারেন্সি সোয়াপ ব্যবস্থা’ বলা হয়। রাশিয়া, মরিশাস, ইরান ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ভারত রুপিতে বাণিজ্যও শুরু করেছে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ভারতীয় মুদ্রায় আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য বাণিজ্য সংগঠন ও ব্যাংকগুলোকে পরামর্শ দিতে থাকে দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে বাণিজ্যের মাধ্যম হিসেবে ১৯৬০-এর দশকে কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান—এসব দেশ ভারতীয় রুপি গ্রহণ করত। পরে অবশ্য তা বন্ধ হয়ে যায়।
ইউক্রেন আক্রমণের পর পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ে রাশিয়া। তখন বিকল্প পথ বের করেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। পুতিন ঘোষণা করেন, ইউরোপের দেশগুলো যদি রাশিয়া থেকে গ্যাস নিতে চায়, তাহলে ইউরো বা ডলার দিলে হবে না, দিতে হবে রাশিয়ার মুদ্রা রুবল। পুতিনের কাছে হিসাব ছিল পরিষ্কার। সেটা হচ্ছে, ইউরোপের দেশগুলো ৪০ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করে রাশিয়া থেকে। এ দাওয়াই কাজে দেয় এবং রুবলের মান বাড়তে থাকে। ভারতীয় রুপির মান বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশের ডলার-সংকটের এই সময়ে ভারতও বাংলাদেশকে একই ধরনের প্রস্তাব দিয়েছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের মতে, ভারতীয় কিছু পণ্যের ওপর বাংলাদেশ যে অনেকটাই নির্ভরশীল, তা ভারত জানে। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ইতিমধ্যে ভারতীয় মুদ্রায় আন্তর্জাতিক লেনদেন করার আইনি বাধা দূর করেছে। ভারত সরকার চায় আন্তর্জাতিক বাজারে রুপির কদর বাড়াতে। ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্যের উদ্যোগ নিয়েছিল ভারত। ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রুপির মান তখন পড়ছিল। পরে অবশ্য উদ্যোগ সফল হয়নি।
২০০ কোটি ডলার রপ্তানির সমপরিমাণ ভারতীয় রুপিতে বাণিজ্য হতে পারে। তবে এর সঙ্গে বিনিময় হারসহ অনেক বিষয় জড়িত। বাংলাদেশি টাকা এখন না হয় একটু অবমূল্যায়িত, ভবিষ্যতে এই পরিস্থিতি না-ও থাকতে পারে। এই উদ্যোগ আমদানিকারকদের ডলারের চাপ থেকে কিছুটা হলেও রেহাই দেবে। তারা প্রতিবেশী দেশ থেকে পণ্যের একটি অংশ আমদানি করতে রুপিতে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারবেন। এভাবে শুরু হলে মার্কিন ডলারের ব্যবহার কিছুটা কমিয়ে দেওয়া যাবে। মার্কিন ডলার ঘাটতির কারণে সরকার আমদানিবিধি কঠোর করেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখতে আমদানি বিল পরিশোধ এক বছর আগের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ কমে গেছে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংক, বেসরকারি খাতের ইস্টার্ন ব্যাংক ও স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার (এসবিআই) বাংলাদেশ শাখাকে ভারতের আইসিআইসি ব্যাংক এবং স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার সঙ্গে নস্ট্রো অ্যাকাউন্ট খোলার অনুমতি দিয়েছে। বেসরকারি খাতের বাণিজ্যিক ব্যাংক ইস্টার্ন ব্যাংক এবং স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার কান্ট্রি অফিস ইতিমধ্যে ভারতীয় আইসিআইসিআই ব্যাংক এবং এসবিআইয়ের সঙ্গে নস্ট্রো অ্যাকাউন্ট খুলেছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংক দ্রুততম সময়ে অ্যাকাউন্ট খুলবে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ ভারতে যতটা পণ্য রপ্তানি করবে, ততটাই কেবল রুপিতে লেনদেন হবে। এর বাকিটা, মানে যা বাংলাদেশ আমদানি করে, তার অর্থ শোধ করা হবে ডলারে। এর মানে হচ্ছে, দুই বিলিয়ন ডলারের পণ্যের দাম রুপিতে দেবে ভারত, যা বাংলাদেশ ভারত থেকে পণ্য কিনতে ব্যবহার করবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ভারতে বছরে প্রায় ২ বিলিয়ন বা ২০০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ। এর বিপরীতে দেশটি থেকে আমদানি হয় প্রায় ১৪ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের পণ্য। অর্থাত্, বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় সাত গুণ। ফলে সাধারণভাবে ধারণা করা যায়, নতুন ব্যবস্থায় বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে কম মার্কিন ডলার সাশ্রয় করতে পারবে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ৬ শতাংশ খরচ সাশ্রয় হবে।
ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যের সময় একবার টাকা থেকে ডলারে, আবার ওদিকে রুপি থেকে ডলারে রূপান্তর করতে হয়। এই রূপান্তর করতে গিয়ে আমরা হিসাব করে দেখেছি, ৬ শতাংশের মতো গ্যাপ বা লস হয়। অর্থাত্, ১০০ ডলারে ৬ ডলারের মতো। দুই দেশ নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেন করলে ব্যাংক ও ব্যবসায়ীরা এই লস থেকে রেহাই পাবেন।
লেখক :বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড।
একুশে সংবাদ/ই/এসএপি
আপনার মতামত লিখুন :