২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলাকে বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অধিকারী, বৈজ্ঞানিক রাজনৈতিক চিন্তা, প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানবিক নেতৃত্বশূন্য করার উদ্দেশ্যে সংঘটিত হয়েছিল। এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিবিবর্জিত, যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে হত্যা করা এবং স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করা। এই হামলা থেকে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা বেঁচে গেলেও ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত হন। আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বহু নেতাকর্মী গ্রেনেডের আঘাতে পঙ্গু জীবন যাপন করছে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ এক অপূরণীয় ক্ষতি।
রাজনৈতিক সংস্কৃতিবিবর্জিত ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে ধ্বংসাত্মক বিভাজিত রাজনীতির সূত্রপাত ঘটায়। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবারকে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ। বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে বিনষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন প্রতিরোধের চেষ্টা করে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি করে, ১৯৭০-এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভের পরেও ক্ষমতা হস্তান্তর না করে, সর্বোপরি ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি করে। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তি সফল হতে পারেনি, বঙ্গবন্ধু কারাগার থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন। সসম্মানে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে ১০ জানুয়ারি ফিরে এসেছেন, সরকার গঠন করেছেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্র পুনর্গঠন এবং যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণকে পুনর্বাসন করেছেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরে বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়ায় ৮ শতাংশ, বাংলাদেশ উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের কাতারে পৌঁছে যায়। বাংলাদেশকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করে স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন, আর ঠিক তখনই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি অপপ্রচারে লিপ্ত হয়। ইতিহাসবিকৃতি না হলেও তথ্যবিভ্রাট তখন থেকেই শুরু হয়, সাধারণ জনগণের মনে বঙ্গবন্ধুর পরিবার সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয়, অপপ্রচার চলতে থাকে, স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা একত্রিত হয়ে জাতির পিতাকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতারক্ষার সংগ্রামে জাতির পিতা সপরিবারে শহিদ হন, সপরিবারে হত্যা করা হয়, কারণ স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি বুঝতে পেরেছিল বঙ্গবন্ধু পরিবারের শেষ রক্তবিন্দু যদি পৃথিবীতে জীবিত থাকে, পুনরায় গণতন্ত্র, শোষণহীন সমাজ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটবে।
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা শুধু মানবতাবিরোধী হত্যাযজ্ঞ ছিল না বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিশ্বাসকে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছিল। বাংলাদেশকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিভক্ত করে ফেলা হয়েছিল। সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তন করা হয়েছিল, একটা অসাম্প্রদায়িক জাতিকে সাম্প্রদায়িকতার বেড়াজালে আবদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছিল। গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছিল, হ্যাঁ এবং না ভোটের প্রচলনের মাধ্যমে, পুনরায় সমাজে শ্রেণিভেদ তৈরি করা হয়, দেশে ধনী ও দরিদ্র শ্রেণির মধ্যে বৈষম্য বাড়তে থাকে। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি এটা বুঝতে পারেনি দীর্ঘ প্রায় ছয় বছর পরে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন, বাংলাদেশে পুনরায় গণতন্ত্র, শোষণহীন সমাজ, অসাম্প্রাদায়িক চেতনা এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের পুনর্জাগরণ ঘটাবে। ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করে ওনার বৈজ্ঞানিক রাজনৈতিক চিন্তা দিয়ে গণতন্ত্র পুনরায় উদ্ধার করেন এবং বাংলাদেশে সুশাসন নিশ্চিত হয়। বাংলাদেশের জনগণ দ্বিতীয় বার স্বাধীনতার স্বাদ উপলব্ধি করতে পারে। বর্তমান এবং ভবিষ্যত্ প্রজন্মের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরেন তিনি। দীর্ঘ ২১ বছর ধরে সৃষ্ট ইতিহাস বিকৃতির শক্ত দেওয়াল ভেঙে ফেলেন, বাংলাদেশের বর্তমান এবং ভবিষ্যত্ প্রজন্ম নতুনভাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানকে অনুভব করতে শেখে, জানতে পারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি।
২০০১ সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পরিবর্তন হলে, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে হত্যার এবং আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার পরিকল্পনা করে, কারণ তা না হলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার বিচার করা হবে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা তো দূরের কথা, তারা বিচারের আওতায় আসবে। নিজেদের ভবিষ্যতের বাস্তবতা এবং বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া প্রতিরোধ করার জন্য বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। কিন্তু এবার বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী বাঙালিরা সচেতন ছিল, তারা মানববর্ম তৈরি করে আওয়ামী লীগের সভাপতির জীবন রক্ষা করে। ২০০৯ সালে পুনরায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে স্বাধীনতার সফলতার যাত্রা শুরু হয়। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর দূরদৃষ্টিতা পরিমাপ করতে পারেনি, কারণ সাম্প্রদায়িকতার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে কখনোই উদার রাজনৈতিক চিন্তা করা যায় না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজের সুরক্ষা-বলয় তৈরির চিন্তা না করে দেশ এবং জাতিকে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির হাত থেকে রক্ষা করে চলেছেন, ধারাবাহিকভাবে তিন মেয়াদে সরকার পরিচালনা করে বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত করেছেন। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের সব শর্ত পূরণ করেছে, বাংলাদেশ এখন উন্নত রাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০ জন রাষ্ট্রনায়কের মধ্যে একজন। বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন একজন নির্ভীক নেত্রী, বঙ্গবন্ধুকন্যা ক্ষমতায় থাকার জন্য রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন না, জনগণের কল্যাণের জন্য রাষ্ট্র পরিচালনা করে চলেছেন। বাংলাদেশকে কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে উন্নয়নের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে, বাংলাদেশের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো বিশ্লেষণ করলে এটা স্পষ্ট বোঝা যায়। একজন স্বপ্নদ্রষ্টা রাষ্ট্রনায়ক বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার স্বপ্ন দেখছেন, ইতিমধ্যে ক্ষুধা এবং দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়েছেন, মঙ্গা দূর করেছেন। করোনাকালীন দেশের জনগণের জীবনের নিরাপত্তা বিধান করেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা ধরে রাখেন, শিক্ষাব্যবস্থা চলমান রেখে বিশ্বে এক বিরল উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন, যা বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন। বাস্তবায়ন করেছেন বহুমুখী জনবান্ধব উন্নয়ন প্রকল্প। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য—বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, ৫৬০ মডেল মসজিদ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র। উদ্বোধন হতে যাচ্ছে বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল এবং বঙ্গবন্ধু ট্যানেল, এগিয়ে চলছে আশ্রয়ণ প্রকল্পের কাজ, বাংলাদেশের এক জন মানুষও গৃহহীন থাকবে না, বাংলাদেশের সব গ্রামে সব নাগরিক-সুবিধা পৌঁছে যাচ্ছে, বাংলাদেশ এখন উদ্যোক্তা সৃষ্টি করছে।
বাংলাদেশে এখন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন প্রস্তুতি নিচ্ছে। শাসনতান্ত্রিক ধারার পরিবর্তন না করে সাংবিধানিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে, এই মুহূর্তে এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গোষ্ঠীবিশেষের সৃষ্ট প্রতিকূলতা নিরসনের মাধ্যমে পরবর্তী সরকার গঠনে শাসনতান্ত্রিক উত্তরণে কাজ করে যাচ্ছেন। মানবাধিকার বিষয়ে আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ জাতীয় প্রত্যাশা পূরণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনৈতিক প্রচেষ্টা ও প্রজ্ঞায় জাতির আস্থা রয়েছে। তবে বাংলাদেশের জনগণ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এবং ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হালমলার উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য ভুলে গেলে চলবে না। জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে হবে, যাতে কাঙ্ক্ষিত স্মার্ট বাংলাদেশ সফলভাবে রূপান্তর সহজ হয়। মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি পুনরায় ক্ষমতায় এলে ভবিষ্যত্ প্রজন্মের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। অন্যদিকে বর্তমান এবং ভবিষ্যত্ প্রজন্ম স্মার্ট বাংলাদেশ থেকে বঞ্চিত হবে। বিশ্ব মানচিত্রে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান ধরে রাখতে হলে ১৫ আগস্টের শোককে শক্তিতে পরিণত করতে হবে এবং ২১ আগস্টের ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ধ্বংস ও বিভাজনের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
একুশে সংবাদ/ই.ফ.প্র/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :