একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সংবাদপত্র কীভাবে অবদান রাখতে পারে—এ প্রশ্ন উঠতেই পারে। এর উত্তরে আমি বলব, সংবাদপত্রে যারা কাজ করেন তারা এই সমাজেরই অংশ। সমাজের ভালোমন্দ অন্য নাগরিকদের মতো তাদেরও প্রভাবিত করে। আমি একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অর্থনীতি নিয়ে চর্চা করি। আমি প্রত্যাশা করব, পত্রিকায় দেশের অর্থনীতির অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে অনেক খাত
সাফল্য-ব্যর্থতার চিত্র নির্মোহভাবে তুলে ধরা হবে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, এটা কেউই অস্বীকার করতে পারবে না। বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে এবং দ্রুত উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে এগিয়ে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক নির্ধারিত আগামীর লক্ষ্যের মধ্যে রয়েছে—২০৩১ সাল নাগাদ উচ্চ-মধ্য আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত স্মার্ট কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে দেশকে গড়ে তোলা। এসব লক্ষ্য পূরণে সংবাদপত্র সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। বলা বাহুল্য, দেশের অর্থনীতিও নানা খাতে বিভক্ত। সব খাতের অবস্থা একই রকম নয়। কোনো কোনো খাতে অর্জন অসাধারণ। আবার কোনো কোনো খাতে অর্জন প্রত্যাশামতো হচ্ছে না। উন্নয়ন টেকসই হতে হলে সব খাতেই সমানতালে এগিয়ে যেতে হবে। সংবাদপত্র এসব বিষয়ে আলোকপাত করতে পারে। একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে সংবাদপত্রের কাছে আমার প্রত্যাশা থাকবে যেন অর্থনীতির সব খাতকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে—সাধারণ মানুষের উন্নয়ন কতটা হয়েছে সেটা নিরূপণ করা। এ ব্যাপারে সংবাদপত্র সঠিক তথ্য-উপাত্ত প্রদান করতে পারে, যাতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে লাগসই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সহজ হয়। কোনোভাবেই অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে ভুল তথ্য দেওয়া উচিত নয়। কারণ ভুল তথ্য প্রদান করলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণেও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে।
একসময় বাংলাদেশ ছিল সর্বতোভাবেই কৃষিপ্রধান এবং কৃষিনির্ভর একটি দেশ। বর্তমানে জাতীয় উত্পাদনে (জিডিপির) কৃষির অবদান অনেকটাই কমে গেছে। কিন্তু তার পরও কৃষি এখনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। দেশের শ্রমশক্তির ৪০ শতাংশের মতো এখনো সরাসরি কৃষি খাতে কর্মরত। আরো অনেক মানুষ কৃষিসংশ্লিষ্ট কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। বাংলাদেশের কৃষি খাতে যে উন্নতি হয়েছে তা রীতিমতো বিস্ময়কর। স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশ ছিল খাদ্যঘাটতির একটি দেশ। সেই সময় জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। এখন বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি। কিন্তু তার পরও বাংলাদেশ খাদ্য উত্পাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ যদিও মাঝেমধ্যে ঘাটতি সৃষ্টি করে। স্বাধীনতার পর দেশে চালের উত্পাদনের পরিমাণ ছিল ১ কোটি ১০ লাখ টন। এখন চালের উত্পাদন বৃদ্ধি পেয়ে ৩ কোটি ৫৭ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। যদিও বিগত ৫০ বছরের বেশি সময়ে দেশে কৃষিজমির পরিমাণ অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশ দ্রুত কৃষি যান্ত্রিকায়নের দিকে ধাবিত হচ্ছে। উন্নত বীজ, সার, কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে দেশের কৃষি উত্পাদনের ক্ষেত্রে একধরনের বিপ্লব সাধিত হয়েছে। ক্রপ জোনিংয়ের ওপর জোর দিতে হবে। কোন জমিতে কী ফসল ভালো হবে, সেটা জানা থাকলে উত্পাদন নিশ্চয়ই বাড়ে। কৃষি মন্ত্রণালয় ‘সমলয়’ পদ্ধতিতে কৃষি আবাদব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে। সমলয় পদ্ধতি হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে পরিচালিত সমবায় পদ্ধতির মতোই। এখানে সন্নিহিত এলাকায় অবস্থিত জমিগুলোকে সমবায় ভিত্তিতে চাষের আওতায় আনা হবে। জমির মালিকগণ তাদের জমির পরিমাণ অনুযায়ী উত্পাদিত ফসলের অংশ পাবেন। যারা চাষের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন তারাও ন্যায্যভাবে ফসলের অংশ পাবেন। সন্নিহিতভাবে অবস্থিত জমি একসঙ্গে চাষের আওতায় আনা হলে জমির খণ্ডবিখণ্ডতা যান্ত্রিক চাষাবাদের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না। এই পদ্ধতির কৃষিকাজে নিয়ন্ত্রণভার থাকবে অংশী কৃষকদের হাতে।
আমাদের অর্থনীতির মূল ভিত্তি এখনো গ্রামীণ অর্থনীতি। উল্লেখ্য, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি, সংস্থা (এফএও) দেওয়া তথ্যমতে, বাংলাদেশ এখন চাল উত্পাদনে বিশ্বে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। চাল উত্পাদনে চীন এবং ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। মাছ, সবজি, ফল ও ফুল উত্পাদনে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব উন্নতি করেছে। মিডিয়া এই বিষয়গুলো আরো ব্যাপকভাবে তুলে ধরতে পারে। বাংলাদেশের কৃষি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি খাত। এ দেশের কৃষকগণ সৃজনশীল ক্ষমতার অধিকারী। তারা যে কোনো কিছু চেষ্টা করলেই রপ্ত করতে পারেন। কৃষকদের যদি আধুনিক যান্ত্রিক ও বৈজ্ঞানিক চাষাবাদ সম্পর্কে আরো প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়, তাহলে তাদের উত্পাদনশীলতা আরো বৃদ্ধি পাবে। একই সঙ্গে কায়িক পরিশ্রম কমে যাবে। তবে যান্ত্রিকীকরণের ফলে কিছু বেকারত্ব সৃষ্টি হতে পারে এবং হবে। এদিকে আগেভাগে নজর রাখতে হবে এবং প্রয়োজনানুসারে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। বিভিন্ন অকৃষি খাতের সম্প্রসারণ এক্ষেত্রে উপকারে আসবে। বাংলাদেশে কৃষক পরিবারের সন্তানরা কিছু শিক্ষা লাভের পর অনেকে নিজেদের কৃষিতে নিয়োজিত করতে চান না। কারণ প্রচলিত সনাতন পদ্ধতির চাষাবাদ অত্যন্ত পরিশ্রমসাধ্য এবং সামাজিক সম্মানের অনুপস্থিতি। কৃষিতে যান্ত্রিক চাষাবাদ পদ্ধতি প্রয়োগ করা গেলে এবং সবার মানুষ হিসেবে প্রাপ্য মর্যাদা নিশ্চিত হলে—কৃষক পরিবারের শিক্ষিত সন্তানরাও কৃষিকাজে যুক্ত হওয়ার জন্য আগ্রহী হতে পারেন।
বর্তমানে দেশের অধিকাংশ গ্রামে বিদ্যুত্সহ যোগাযোগব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। এই অবস্থার সুযোগ কাজে লাগিয়ে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ করা সহজ হচ্ছে। এখানে আরো একটি বিষয় লক্ষণীয়, কোনো আন্তর্জাতিক সংকট দেখা দিলে কৃষিপণ্য আমদানিনির্ভর দেশগুলো সবচেয়ে বিপাকে পতিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশের মতো যেসব দেশ খাদ্য উত্পাদনে সমৃদ্ধ তাদের আন্তর্জাতিক খাদ্যসংকটকালেও তেমন অসুবিধা হয় না। গ্রামীণ অর্থনীতিতে কৃষির পাশাপাশি অকৃষি খাতও এখন সম্প্রসারিত হচ্ছে। আমাদের একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, শুধু কৃষিপণ্য বিপণন করে এই খাতের সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব হবে না। গ্রামীণ অর্থনীতিতে কৃষিভিত্তিক অতি ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র শিল্প ও ব্যবসায় বিকাশের উদ্যোগ আরো জোরালো করতে হবে। পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) গ্রামীণ অর্থনীতিতে কৃষিনির্ভর ক্ষুদ্র শিল্প ও ব্যবসায় বিকাশের লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে। অনেকেই পিকেএসএফের আর্থিক সহায়তায় গ্রামীণ এলাকায় ক্ষুদ্র শিল্প ও ব্যবসায় স্থাপন করে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা পরিবর্তন করেছে। এটা প্রমাণিত যে, প্রচলিত ক্ষুদ্রঋণ টেকসই দারিদ্র্যবিমোচনে সহায়ক নয়। গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং টেকসই দারিদ্র্য বিমোচনে ‘উপযুক্ত ঋণ’ই সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। উপযুক্ত ঋণের মূল কথাই হচ্ছে—যার যতটুকু অর্থের প্রয়োজন তাকে ততটুকু আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। এখন পর্যন্ত পিকেএসএফের আওতায় এক জনকে যথাযথ প্রকল্প থাকলে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে ঋণগ্রহীতা যাতে ঋণের অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহার করেন, সেদিকে কঠোর নজরদারি রাখা হয়। গ্রামীণ শিল্পে উত্পাদিত পণ্য যাতে উদ্যোক্তারা সঠিকভাবে বাজারজাত করতে পারেন, সে ব্যাপারে তাদেরকে প্রয়োজনানুসারে প্রশিক্ষণ এবং অন্যান্য সহায়তা দিতে হবে।
জলবায়ুভঙ্গুর এ দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব প্রকটভাবে প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে অনেকেই তাদের সহায়সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। এদের দুরবস্থার চিত্র পত্রিকার মাধ্যমে তুলে ধরা যেতে পারে। কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব মোকাবিলা করা যায়, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সহনীয় পর্যায়ে রাখা যায়—সে ব্যাপারে তথ্য দিয়ে এবং পরিত্রাণের উপায় জানিয়ে দিয়ে জনগণকে সহায়তা দেওয়া এবং উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত কোন কোন এলাকায় বেশি তা পত্রিকার মাধ্যমে প্রকাশ করা যেতে পারে। হাওর এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মারাত্মক আকার ধারণ করে থাকে। উপকূলীয় এলাকায় আবাদি জমিতে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে কৃষিজমিকে চাষের অনুপযোগী করে তুলছে। এ থেকে কীভাবে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব—এসব বিষয় পত্রিকার মাধ্যমে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করা যেতে পারে। অর্থাত্ আমি বলতে চাইছি, সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের গল্প এবং তাদের এগিয়ে চলার প্রকৃত ও সম্ভাব্য পথ পত্রিকার মাধ্যমে তুলে ধরা যেতে পারে। এ কাজ করার জন্য সংবাদপত্রে যারা কাজ করেন তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের মাধ্যমে এমন একটি সমাজ গড়ে তোলা, যেখানে সমাজের প্রতিটি মানুষ অর্জিত অর্থনৈতিক সুফল ন্যায্যতার ভিত্তিতে ভোগ করতে পারবে। কিছু মানুষ এগিয়ে গেল আর বিপুলসংখ্যক মানুষ পেছনে পড়ে রইল, এটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতমুখী ব্যবস্থা। বর্তমান সরকার নীতিগতভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে শোষণ ও অর্থনৈতিক বৈষম্যমুক্ত সমাজে গঠনে অঙ্গীকারবদ্ধ। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে মিডিয়া সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। অর্থনীতির সব খাতের কথাই বলতে হবে, তবে সেসব মানুষের কথা বেশি করে বলতে হবে, যাদের কথা বলা হয় না বা কম বলা হয়-তারাই পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী, যাদের মুখে বঙ্গবন্ধু হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন।
যারা মিডিয়ায় কাজ করেন তাদের সব সময়ই সচেতন থাকতে হবে, যাতে তাদের দ্বারা এমন কোনো বিভ্রান্তিকর কোনো সংবাদ পরিবেশিত না হয়, যা দ্বারা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে বা মানুষ আতঙ্কিত হতে পারে। ব্যাংকের মতো স্পর্শকাতর খাত নিয়ে বিভ্রান্তিকর সংবাদ প্রকাশ করা হলে তার মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে। পত্রিকায় পরিবেশিত প্রতিটি সংবাদই সঠিক তথ্যভিত্তিক এবং বস্তুনিষ্ঠ হতে হবে। সংবাদ এলেই তা ছাপিয়ে দিতে হবে—এমন মানসিকতা কোনোভাবে কাম্য নয়। কোনো সংবাদ এলে তা ভালোভাবে যাচাই-বাছাই না করে প্রকাশ করা ঠিক নয়।
একুশে সনবাদ/ই.ফ.প্র/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :