বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা শুরু করা হয়েছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে শুক্রবার এ তথ্য প্রকাশ করা হয়। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্প্রতি তাদের পার্লামেন্টে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশের পর জানিয়েছে, বাংলাদেশের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তারা বড় আকারের কোনো পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে না। স্বাভাবিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর এ সর্বশেষ বক্তব্য দেশের রাজনীতিতে এখন সবচেয়ে বড় আলোচনার বিষয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে ইমতিয়াজ আহমেদের বিশ্লেষণ নিচে ছাপানো হলো।
ভিসা নীতি প্রয়োগ করে বাংলাদেশের গণতন্ত্রে সমস্যার কোনো সমাধান হবে না। এর একটা প্রতীকী মূল্য থাকতে পারে। মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞার প্রভাব অন্য দেশেও তাই তেমন দেখা যায়নি। বাংলাদেশেও কিছু হবার কথা নয়। কারণ, বাংলাদেশের গণতন্ত্র দেশের মানুষকেই ঠিক করতে হবে।
কথা হলো, ক’জনই-বা বাইরের ভিসা নেয় বা ক’জনের ছেলেমেয়ে বিদেশে থাকে? তাছাড়া যারা ক্ষমতায় থাকতে বা ক্ষমতায় যেতে চায়, তাদের কাছে ভিসার চেয়ে ক্ষমতাই বড় কথা। বিরোধী দল ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য চেষ্টা করবে আর সরকারি দল তো ক্ষমতায় থাকতেই চেষ্টা করবে। সেজন্য ভিসা পেল কি না পেল, তাতে তাদের কী আসে যায়? ক্ষমতাই তো তাদের কাছে মুখ্য বিষয়।
আমি মনে করি না, ভিসার দিকে লক্ষ্য রেখে আমাদের সরকার বা বিরোধী দলের কর্মতৎপরতায় বড় ধরনের কোনো প্রভাব পড়বে। আমি ধরে নিলাম, কেউ ভিসা পেল অথচ ক্ষমতায় থাকতে পারল না। সেটা তার কাছে বেশি মূল্যবান হবে না। আমাদের দেশে ক্ষমতায় যে থাকে আর যে ক্ষমতায় থাকে না, এর মধ্যে অনেক পার্থক্য। কোনো কোনো সময় কোনো কোনো দলের জন্য তা জীবনমরণ সমস্যা তৈরি করে। দেশের গত ৫০ বছরের ইতিহাস দেখলে তা না বোঝার কিছু নেই। সেটা বিদেশিরা কতটা বোঝেন আমি জানি না; আমরা ভালোভাবেই তা বুঝি।
আমার মনে হয় এটা বিদেশিরা একেবারে বোঝেন না, তা নয়। তারা হয়তো এটাও বোঝেন যে, এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা তেমন কাজে দেবে না। কিন্তু তাদের পদক্ষেপ নিতে হবে বলে তারা কিছু একটা করছে। ভিসা নিষেধাজ্ঞায় গণতন্ত্র চর্চা ঠিক হবে, এমন ধারণা পোষণ করা ঠিক নয়। এটা আরও জটিল বিষয়। এর সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাস দেখতে হবে। বড় দলগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক ও আস্থার যে ইতিহাস, সেটা বিদেশিদের না জানার কথা নয়; কারণ তারাও দীর্ঘদিন ধরে এ দেশের রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করছেন। আমি মনে করি, তাদের সে ইতিহাস জানতে হবে। আমার কথা পরিষ্কার, বাংলাদেশের সংকট বাংলাদেশের মানুষকেই সমাধান করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট সব সময়ই ছিল। এবার প্রথমবারের মতো যেটা হয়েছে, একটা রেজিমের স্থায়িত্ব হয়েছে।
রাজনৈতিক স্থায়িত্ব আমাদের কখনও ছিল না। দশকের পর দশক এখানে আজকের বড় দুই দলের পাল্টাপাল্টি রাজনীতি আমরা দেখে আসছি। যার জন্য আজকে যে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে তা নতুন কিছু নয়। এই অস্থিরতাও কোনো না কোনোভাবে কাটবে।
ভিসা নিষেধাজ্ঞার প্রতীকী মূল্য এখানেই যে এর ফলে দেশের ওপর এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আন্তর্জাতিক পরিসরে দেশের ভাবমূর্তি কিছুটা প্রশ্নের মুখে পড়ে। বর্তমান বহুমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বে এর কার্যকরতা কতটুকু হবে তা অবশ্য দেখার বিষয়। একটা বিষয় হলো, সরকার কিছুটা সচেতন থাকবে। সরকার কিন্তু প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে যে, তারা একটা সুষ্ঠু নির্বাচন করবে। কিন্তু এতে কারা এলো কিংবা না এলো তাতে কিছু আসে যায় না। আমার মনে হয়, অন্য দলের আসা-না আসার বিষয়টি বিদেশিরাও এখন সেভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে না। সরকার তো বলেই দিয়েছে, সংবিধানের মাধ্যমেই নির্বাচন হবে।
এখন দেখতে হবে, বিরোধী দল নির্বাচনে যাবে কিনা। বিশেষ করে বিএনপি নির্বাচনে যাবে কিনা, সেটা আমার মনে হয় কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। তপশিল ঘোষণার আগে বা সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু স্পস্ট হবে। সে জায়গায়ই মনে হয় আমাদের মনোযোগী হতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র বা বিদেশিরা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে একটা দেশের গণতন্ত্র ঠিক করেছে– এ ধরনের চিন্তায় ভুল আছে। গণতন্ত্র একটা জটিল ব্যাপার।
কয়েক শতাব্দী চর্চা করেও মার্কিন নির্বাচন নিয়ে সে দেশের ভেতরেই প্রশ্ন উঠছে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র ঠিক করতে হলে বাংলাদেশের জনগণ কিংবা অংশীজনকেই এগিয়ে আসতে হবে। এর বিকল্প নেই।
যদি বিদেশিদের ভিসা নিষেধাজ্ঞা সেভাবে কাজে দিত তবে বিশ্বের অনেক দেশেরই গণতন্ত্র ঠিক হয়ে যেত। যারা রাজনীতি করেন, তাদের নিশ্চয়ই আরও বড় বড় অনেক চিন্তা আছে। ফলে তারা ভিসার দিকে লক্ষ্য রেখেই তাদের কর্মসূচি ঠিক করবে– এমনটা আমি বিশ্বাস করি না।
বিএনপি বড় দল হিসেবে নির্বাচনে আসা না আসা নিয়েই বড় প্রশ্ন। আমরা দেখেছি, গত নির্বাচনে দলটি জোটবদ্ধভাবে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে অংশগ্রহণ করেছে। সেদিক থেকে বলা যায়, তাদের নেতৃত্বের মধ্যে একটা দুর্বলতা আছে। কে নেতৃত্ব দেবে সেটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি বিএনপির এ জায়গাটায় অস্পষ্টতা আছে। সেজন্য বিএনপিকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা নির্বাচনে যাবে কিনা। তারা যদি যায়, তবে নির্বাচন একভাবে হবে। আর না গেলে আরেকভাবে হবে। সেটা হয়তো আমরা দেখব। কিন্তু বিদেশি ভিসা নিষেধাজ্ঞার প্রভাব আমাদের গণতন্ত্রে পড়বে বলে মনে হয় না। আমি আগেও বলেছি, বিদেশিরা এখানে আসছে, কারণ এখানে তাদের নানাবিধ স্বার্থ আছে। ব্যবসা, ভূরাজনীতি মিলে তাদের একটা বড় স্বার্থ রয়েছে। তাদের মতো কাঠামো তৈরি করতে পারলে তাদেরও সুবিধা। সেজন্য তারা এখন দৌড়ঝাঁপ করছে।
সমাধানের কথা আমি বারবারই বলছি, সেটা একমাত্র জনগণের হাতেই রয়েছে। যেমনটা আগেও আমরা দেখেছি। লাখ লাখ মানুষ যখন রাস্তায় নামবে তখন বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার নড়েচড়ে বসে তা ঠিক করতে চেষ্টা করে। জনগণ যদি ব্যাপকভাবে রাস্তায় না নামে, তার মানে বোঝাই যাচ্ছে জনগণ পুরো বিষয়টি অন্যভাবে দেখছে। এর পরও বিদেশি নয়, জনগণের দিকেই নজর রাখা দরকার।
একুশে সংবাদ/স.ল.প্র/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :