হাল বিহীন জাহাজকে একজন নাবিক যেমন গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না তেমনি কারিকুলাম ছাড়া শিক্ষা কাঙ্ক্ষিত নাগরিক গড়ে উঠতে পারে না। পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা, সহবস্থান নিশ্চিত এবং সব ধরনের বৈষম্য দূর করে সুখী, সমৃদ্ধশালী ও উন্নত বাংলাদেশ গড়াই নতুন কারিলামের মূল লক্ষ্য।
শিক্ষার সঙ্গে কারিকুলাম শব্দটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কারিকুলাম শব্দটি ল্যাটিন শব্দ Currere থেকে এসেছে যার অর্থ দৌড়ানো বা ঘোড়দৌড়ের নির্দিষ্ট পথ। আভিধানিক অর্থে কারিকুলাম বলতে শিক্ষাক্রমকে বোঝায় যা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর একটি সুনির্দিষ্ট রূপরেখা। শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক সবারই কারিকুলাম বা শিক্ষাক্রম সম্পর্কে জানা আবশ্যক। কেননা শিখন শেখানোর প্রধান হাতিয়ার হলো এই কারিকুলাম। একটি নির্দিষ্ট বয়স ও শ্রেণির শিক্ষার্থীরা কী জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ অর্জন করবে তার সামগ্রিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করা হয় শিক্ষাক্রম বা কারিকুলামের মাধ্যমে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম এমন একটি পাঠ্যক্রম যা বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার বিষয়বস্তু এবং মান নিশ্চিত করার জন্য প্রণয়ন করা হয়। বর্তমানে আমাদের দেশে জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১-এর আলোকে জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২২ প্রণয়ন করা হয়েছে যেখানে শিক্ষার প্রতিটি স্তরে পরিকল্পনা বিন্যস্ত। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২২ সালে ৬২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (মাদ্রাসা, কারিগরি ও জেনারেল) এই কারিকুলামের পাইলটিং শুরু হয়। ২০২৩ সালে নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক বিন্যস্ত করে শ্রেণি পাঠদান শুরু হয় এবং ২০২৪ সাল থেকে অষ্টম ও নবম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করে পাঠদান কর্মসূচি পরিচালিত হবে। নতুন কারিকুলামের বিশেষত্ব হলো, প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতি বাতিল করে শিখনকালীন মূল্যায়ন, ষাণ্মাষিক ও বাত্সরিক সামষ্টিক মূল্যায়ন ব্যবস্থার প্রবর্তন। এতে শিক্ষার্থীদের ওপর থেকে জিপিএ-৫ পাওয়ার ইঁদুর-দৌড়ের প্রতিযোগিতা বন্ধ করে তাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, পরমত সহিষ্ণুতা, আত্মনির্ভরতা বাড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি অন্যান্য সস্তা শিক্ষা উপকরণ (পরিত্যক্ত জিনিস) ব্যবহার করে শ্রেণিকার্যকে কীভাবে আরো বেশি আনন্দদায়ক ও শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক করা যায়, জোর দেওয়া হয়েছে তার ওপর। মুখস্থনির্ভর লেখাপড়া থেকে বের করে আনার পাশাপাশি মানবিক, ব্যবসায় শিক্ষা ও বিজ্ঞান বিভাগ বিলুপ্ত করে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলন হয়েছে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এ যুগে জীবন ও জীবিকার আমূল পরিবর্তন ঘটছে। পেশা বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে কর্মসংস্থান। কর্মক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এ আই) ব্যবহূত হচ্ছে। প্রযুক্তির উত্কর্ষের ফলে কর্মক্ষেত্রে তৈরি হচ্ছে নতুন সম্ভাবনা। এছাড়া কোভিড ১৯-এর পর মানুষ প্রতিনিয়ত বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন, অভিবাসন সংকট, জাতিগত সহিংসতা, দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ, ভূ-রাজনীতির মেরুকরণ প্রকট আকার ধারণ করেছে। এছাড়া রয়েছে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও অশিক্ষার মতো বিষয়গুলো। এসব চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার টেকসই ও কার্যকর সমাধান করা এখন সময়ের দাবি। যার জন্য প্রয়োজন জ্ঞান, দক্ষতা ও প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা।
নতুন কারিকুলাম বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতাভিত্তিক সক্রিয় শিখনের আলোকেই প্রণীত হয়েছে। যেখানে শিক্ষার্থীরা প্রেক্ষাপটনির্ভর অভিজ্ঞতা থেকে প্রতিফলনমূলক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বিমূর্ত ধারণা করে সক্রিয় পরীক্ষণে পৌঁছাতে পারবে। প্রকল্পভিত্তিক, সমস্যা ও চ্যালেঞ্জভিত্তিক, অনুসন্ধানমূলক, সহযোগিতামূলক, সংযোগমূলক ও প্রেক্ষাপটনির্ভর শিখন কৌশলের মাধ্যমে অভিজ্ঞতা, পরিবেশের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া, পর্যবেক্ষণ, হাতে-কলমে কাজ, দলীয় কাজ, পঠন ও স্মৃতিতে ধারণ করে জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ অর্জনের মাধ্যমে সুনাগরিক গড়ে তোলাই বর্তমান কারিকুলামের লক্ষ্য। নতুন কারিকুলামে শিক্ষার্থীদের যেসব দক্ষতা অর্জনের ওপর সবিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তা হলো সূক্ষ্ম চিন্তন দক্ষতা, সৃজনশীল চিন্তন দক্ষতা, সমস্যা সমাধান দক্ষতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ দক্ষতা, যোগাযোগ দক্ষতা, স্ব-ব্যবস্থাপনা দক্ষতা, সহযোগিতামূলক দক্ষতা, বিশ্বনাগরিকত্ব দক্ষতা, জীবিকায়ন দক্ষতা, মৌলিক দক্ষতা, ডিজিটাল দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে।
একুশে সংবাদ/ই.ফ.প্র/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :