AB Bank
ঢাকা শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

Ekushey Sangbad
ekusheysangbad QR Code
BBS Cables
Janata Bank
  1. জাতীয়
  2. রাজনীতি
  3. সারাবাংলা
  4. আন্তর্জাতিক
  5. অর্থ-বাণিজ্য
  6. খেলাধুলা
  7. বিনোদন
  8. শিক্ষা
  9. তথ্য-প্রযুক্তি
  10. অপরাধ
  11. প্রবাস
  12. রাজধানী

ভাষা আন্দোলনের চেতনাস্নাত হতে হবে নতুন প্রজন্মকে


Ekushey Sangbad
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ
০৬:০০ পিএম, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪
ভাষা আন্দোলনের চেতনাস্নাত হতে হবে নতুন প্রজন্মকে

ভাষা আন্দোলন বাঙালির চেতনায় যে আগ্নেয়গিরির উত্তাপ সৃষ্টি করেছিল পরবর্তী সব গণআন্দোলনের পেছনে তা চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে। শুধু তাই নয়, ভাষা আন্দোলন শিখিয়েছে সত্যের জন্য লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে সব অন্যায়কে রুখে দেওয়া যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমরা ইতিহাস বিচ্ছিন্ন জাতিতে পরিণত হতে গিয়ে আজ ঐতিহ্যের প্রণোদনা খুঁজে পাচ্ছি না। বর্তমান প্রজন্মের কাছে আজ ভাষা আন্দোলনের গৌরব অনেকটাই অচেনা হয়ে যাচ্ছে। তাই যেখানে চীন, জাপান আর পশ্চিম ইউরোপের অধিকাংশ দেশ নিজ নিজ মাতৃভাষা ও সংস্কৃতিচর্চা করে দেশ ও জাতিকে অনেক উচ্চতায় এগিয়ে নিয়েছে সেখানে আমরা মাতৃভাষাকে অসম্মানিত করছি প্রতিদিন। যে দেশের ভাষা আন্দোলন তার গৌরবের ঝান্ডা নিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা দিতে পেরেছে সে দেশে নানামুখী শিক্ষায় বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্ম বাংলা ভাষা নিয়ে তেমন গর্ব করতে পারছে না। যেখানে স্পেন, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশে দোকানের সাইনবোর্ড বা খাবারের প্যাকেটেও নিজ ভাষা ছাড়া একটি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে না, সেখানে এ দেশে পারিবারিক বিয়ে বা অন্য অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণপত্র ইংরেজিতে লিখে আত্মপ্রসাদ লাভ করার মতো শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত মানুষের অভাব নেই।

একটি বিশেষ উদযাপন ছিল শুধু ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। এটি ভাষা আন্দোলনের একমাত্র প্রতীক। তা হচ্ছে প্রভাতফেরি। প্রত্যুষে নগ্নপায়ে ভাষার গান গেয়ে মিছিল করে শহীদ মিনারে যাওয়া। অথচ এখন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় ‘প্রভাতফেরি’ উদযাপন করা হচ্ছে পাশ্চাত্যের হিসেবে প্রথম প্রহর বা মধ্যরাতে। ভাষার গানের বদলে জায়গা করে নিচ্ছে দলীয় স্লোগান। এখন আর কে নতুন প্রজন্মকে শেখাবে বাংলার দিনের হিসাব প্রত্যুষ থেকে সন্ধ্যা। গত ডিসেম্বরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার একটি বক্তৃতা ছিল। আমরা জানি ১৯৫২-এর পর থেকে পশ্চিমবঙ্গেও ২১ ফেব্রুয়ারির প্রত্যুষে অনেক সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রভাতফেরি করে থাকে। বক্তৃতা শেষে এক অধ্যাপক প্রশ্ন করেন আপনাদের দেশ ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার। আপনাদের ভাষা আন্দোলনের অনুপ্রেরণা আমাদের প্রাণিত করে। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের শক্তিশালী প্রতীক প্রভাতফেরি আপনারা রাষ্ট্রীয়ভাবে মধ্যরাতে নিয়ে গেছেন কেন- আমি ভালো জবাব দিতে পারিনি। এসব বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে এখন বর্তমান প্রজন্মের সামনে ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট উন্মোচন করা প্রয়োজন।

মনে রাখা প্রয়োজন, পাাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই বাঙালির ভাষা সচেতনতা স্পষ্ট হয়ে পড়েছিল। কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে তা আমরা তুলে ধরতে পারি। যেমন, ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় ‘পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এখানে বগুড়ার শাহ আবদুল বারী পঁচিশটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এর ২২নং প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘মাতৃভাষা হইবে আমাদের রাষ্ট্রীয় ভাষা, তবে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের যোগাযোগের ভাষা উর্দু হওয়াই বাঞ্ছনীয়’ (বদরুদ্দীন উমর, ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ-কতিপয় দলিল-১, ঢাকা, সুবর্ণ, ২০১৩, পর্ব-২৭)। একই সম্মেলন থেকে বাংলা ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালু করার দাবি জানানো হয়েছিল।

১৯৪৭ সালের শেষদিকে বাঙালি সচেতন বিবেক পাকিস্তানি শাসকচক্রের আচরণে সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে। তারা হতাশার সঙ্গে লক্ষ্য করে পাকিস্তান নামের নতুন দেশে মুদ্রিত এনভেলপ, পোস্টকার্ড, ডাকটিকিট, মনি অর্ডার ফরম প্রভৃতিতে উর্দুর পাশাপাশি ইংরেজি থাকলেও বাংলার কোনো জায়গা ছিল না। ফলে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ছাত্র ও সরকারি কর্মচারীরা প্রতিবাদী মিছিল বের করে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে তখন থেকেই স্লোগান উচ্চারিত হতে থাকে। সে বছর ২৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলন উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। এই সম্মেলন থেকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। ঢাকায় তাৎক্ষণিকভাবে ছাত্র সমাজ ও শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের একটি বড় অংশ বিক্ষোভ প্রকাশ করেন। শুরু হয়ে যায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল। পাকিস্তান আন্দোলনে বাঙালিরা যখন সক্রিয় ভূমিকা রেখে মাঠে নেমেছিল তখন হিন্দু পত্রিকাগুলো মোহগ্রস্ত বাঙালির উদ্দেশে ব্যঙ্গ করে লিখেছিল ‘কান মে বিড়ি মু মে পান/লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান।’ অবশ্য অল্পদিনের মধ্যেই বাঙালির মোহমুক্তি ঘটেছিল।

উত্তেজনার আগুনে বারুদ ঢালা হয় একই বছর নভেম্বর মাসে। এ সময় করাচিতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যে কথা ওপরে বলা হয়েছে। এ খবর প্রচারিত হলে ঢাকার ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী সমাজ প্রচ- বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ধীরে ধীরে ঢাকায় জাতীয়তাবাদী চেতনার শিক্ষক, সাংবাদিক, লেখক আইনজীবী, সংস্কৃতিকর্মী বাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে এক প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াতে থাকেন।

১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকায় তমদ্দুন মজলিস নামের সংঠনটির জন্ম হয়। এটি ছিল প্রধানত ইসলামি আদর্শ অনুসারী একটি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। ইসলামি আদর্শ ও ভাবধারা সমুন্নত রাখার স্লোগান ছিল এই সংগঠনটির। এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেম। সংগঠন গড়ে তোলায় তার সঙ্গে যারা যুক্ত হয়েছিলেন তারা হচ্ছেন অধ্যাপক এ. এস. এম. নূরুল হক ভূঁইয়া, শাহেদ আলী, আবদুল গফুর, বদরউদ্দীন উমর, হাসান ইকবাল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন সিনিয়র ছাত্র। তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন অধ্যাপক আবুল কাশেম। ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিস একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। এর শিরোনাম ছিল, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু।’ এই পুস্তিকার লেখক কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমদ ও অধ্যাপক আবুল কাশেম। তমদ্দুন মজলিসের বিশেষ তৎপরতায় সব দল-মতের মানুষের সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ।’

এই শক্তি থেকেই সংঘটিত হয়েছিল ১৯৪৮-এর ভাষা আন্দোলন। খুব কাছাকাছি এসেও সেবার লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। তাই আবার সংগঠিত আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাঙালি তরুণ। এই আন্দোলন টেনে নেওয়া হয় ১৯৫২ পর্যন্ত। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য ঘাতকের বুলেটের সামনে দাঁড়াতে দ্বিধা করেনি তারা। এই আত্মত্যাগ পরাভূত করেছিল উর্দুভাষী পাকিস্তানি নীতিনির্ধারকদের। পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলা।

পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়া পর্যন্ত এ দেশের দীর্ঘ রাজনৈতিক ধারাবাহিকতায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের যে চর্চা হয়েছে, বাংলা ভাষার মূল যেভাবে প্রথিত হয়েছে চেতনার গভীরে তাতে এর যে কোনো লাঞ্ছনা যে বাঙালি গ্রহণ করবে না তা সচেতন সতর্ক মানুষ মাত্রেরই অনুভব করার কথা। কিন্তু নবসৃষ্ট পাকিস্তান নামের দেশটির অবাঙালি শাসকরা তা অনুভব করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তারা দেশটির জন্মলগ্নেই ভাষা প্রশ্নে সৃষ্টি করলেন সংকট। এক সময় তারাই বাঙালির ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলেন ভাষা আন্দোলন। আর সে আন্দোলনে সক্রিয় হওয়া বাঙালির জন্য ছিল অবধারিত।

ভাষা আন্দোলন-উত্তর পূর্ববাংলা অতঃপর পূর্ব পাকিস্তানে যেসব গণআন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল তার ভেতর ভাষা আন্দোলনের প্রভাব ছিল প্রত্যক্ষ। এই প্রভাব থেকে আজকের কোনো গণআন্দোলন বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না।

শুধু আন্দোলন কেন, সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতেও ভাষা আন্দোলনের গভীর প্রভাব রয়েছে। একটি প্রতিবাদী ধারা সাহিত্যকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। সাহিত্য ছাড়াও শিল্পের নানা ক্ষেত্রে ভাষা আন্দোলনের প্রভাব অনেক স্পষ্ট। ভাষা আন্দোলনের অমন শক্তিই ভূমিকা রেখেছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দেওয়ার ক্ষেত্রে।

ভাষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ তাৎপর্য হচ্ছে, পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে সরকারিভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করা। গভীরভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে এ আন্দোলনের পরোক্ষ তাৎপর্য ছিল অত্যন্ত গভীর। কারণ এ আন্দোলনের মধ্য দিয়েই নিজেদের অধিকারের প্রশ্নে সচেতন হয়ে পড়েছিল বাঙালি। এই চেতনার কারণেই পাকিস্তানি শাসকদের অন্যায় শাসনের প্রশ্নে সতর্ক হয়ে পড়ে তারা। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শোষণ প্রশ্নটি তাদের কাছে স্পষ্ট হয়। বাঙালির মুক্তির দীর্ঘ লড়াই ও সবশেষে মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়া এসব তৎপরতায় চালিকাশক্তি ছিল ভাষা আন্দোলনের চেতনা।

এ কারণেই আজ যখন ভাষা আন্দোলনের চেতনা বর্তমান প্রজন্মের কাছে অধরা হয়ে যাচ্ছে তখন সচেতন মানুষ শঙ্কিত হবেন এটিই স্বাভাবিক। এমন বাস্তবতায় আজ রাজনীতির বিধায়ক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের পরিচালক, শিক্ষাবিদ সবাইকেই সতর্ক হতে হবে এবং ভূমিকা রাখতে হবে যাতে নতুন প্রজন্ম একুশের চেতনা বিচ্ছিন্ন না হয়ে পড়ে।


একুশে সংবাদ/আ.স.প্র/জাহা
 

Link copied!