বাংলা, বাঙালি, বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ এক ও অবিচ্ছেদ্য। শেখ মুজিব মানেই বাংলাদেশ। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিব। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের মহান স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ তদানীন্তন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়ায় শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা খাতুনের ঘর আলো করে জন্ম হয় এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের। চার বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তৃতীয়। ঐতিহ্যবাহী শেখ পরিবারে জন্ম নেওয়া ‘খোকা’ ছোটবেলায় ছিলেন দুরন্ত বালক।
গ্রামের কাদা-জল, মেঠোপথ, আর প্রকৃতির খোলামেলা পরিবেশে বেড়ে ওঠা বঙ্গবন্ধু শৈশব থেকেই ছিলেন অধিকার আদায়ে আপসহীন ডানপিটে এক বালক। সম্মিলিত সম্প্রীতির সামাজিক আবহে তিনি দীক্ষা পান অসাম্প্রদায়িক চেতনার।
বিভিন্ন জাতির শ্রেষ্ঠ পুরুষ থাকে। তেমনই বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ পুরুষ হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালির শ্রেষ্ঠতম অর্জন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। আর এই স্বাধিনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে যার নাম চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাকে আমরা জাতির পিতা নামে আখ্যায়িত করি। তিনি আমাদের বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। কারণ বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছি তার জন্য। এখন আমরা পৃথীবির বুকে গর্ব করে বলতে পারি আমরা একটি স্বাধীন জাতি। আমরা আজও বিশ্বাস করি শেখ মুজিবের জন্ম না হলে আমরা এখনো পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ থাকতাম।
নিপীড়িত জাতির ভাগ্যকালে যখন দূর্যোগের কালো মেঘ তখনই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গৌরবময় আবির্ভাব। অসাধারণ দেশ প্রেম ও দূরদর্শী নেতৃত্ব দিয়ে তিনি সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। তাই বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এক এবং অভিন্ন নাম। বঙ্গবন্ধুর জন্ম হয়েছিলো গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গীপাড়া গ্রামে। অতীতে সেটা ছিলো গোপালগঞ্জ মহকুমা। সূদুর অতীতকাল থেকেই গোপালগঞ্জ জেলা মাছের জন্য বিখ্যাত ছিলো।
বঙ্গবন্ধুর যখন বয়স ৩০ বা ৩৫ বছর তখন তাঁর চোখে গ্লুকোমা ধরা পড়ে। গ্লুকোমা হলে চোখের প্রেশার বেড়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর গ্লুকোমা প্রাথমিকভাবেই ধরা পড়ে। বঙ্গবন্ধু কালো মোটা চশমা পরতেন। বঙ্গবন্ধুর গ্লুকোমা চিকিৎসার জন্য প্রথমে কোলকাতা যান, পরে দেশে ফিরে চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. টি আহমেদের কাছে চিকিৎসা নেন।
স্কুলজীবনেই বঙ্গবন্ধু রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন, ছোটবেলা থেকেই তার রাজনৈতিক প্রতিভার প্রকাশ ঘটতে থাকে। তিনি যখন মিশনারি স্কুলে পড়তেন তখনই স্কুল ছাত্রদের পক্ষ থেকে ছাত্রাবাসের দাবি তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরেছিলেন, যা সত্যিই বিরল ও তার রাজনৈতিক চেতনা বিকাশের একটি শুভ লক্ষণ। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তির বছরই বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন। মাত্র ২৩ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধু সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং ১৯৪৩ সালে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন, তার প্রতিষ্ঠিত ছাত্রলীগ পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ভাষা আন্দোলন শুরু করেছিলেন। ১৯৪৮ সালে রাজপথে আন্দোলন ও কারাবরণ, পরে আইনসভার সদস্য হিসেবে রাষ্ট্রভাষার সংগ্রাম ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অতুলনীয় ভূমিকা রাখেন। এক কথায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর সক্রিয় অংশগ্রহণ ইতিহাসের অনন্য দৃষ্টান্ত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাভাষা, মায়ের ভাষা, সেই মাতৃভাষায় কথা বলার সুযোগ পেয়েছি। মাতৃভাষা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই ভাষা আন্দোলন ও সংগ্রামের পথ দিয়েই আমরা বাঙালি, আমাদের আলাদা জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠা এবং সেই সঙ্গে একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন।
রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও জনমুখী তৎপরতার কারণে ১৯৫৩ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং পরবর্তীতে ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের (পরিবর্তিত নাম) সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু লাহোরে তার ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি পেশ করেন যাতে পূর্ব পাকিস্তানের পরিপূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের রূপরেখা বর্ণিত ছিল। এর মাধ্যমেই মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে।
১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার আন্তর্জাতিক চাপে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিলে ১০ জানুয়ারি তিনি নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং পূর্ণোদ্যমে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেন। বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে কিন্তু খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি হয়ে ওঠেন কোটি কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা। একদিকে তার ছিল অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতা, অন্যদিকে অতুলনীয় বাগ্মীতা। সাধারণত একই ব্যক্তির মধ্যে এই দুইগুণের সমাহার দেখা যায় না।
স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের উন্নয়নে যে ভূমিকা রেখেছিলেন, এরই ধারাবাহিকতায় আজও দেশের প্রায় সকল কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু জীবনব্যাপী একটিই সাধনা করেছেন, বাঙালির মুক্তির জন্য নিজকে উৎসর্গ করা। ধাপে ধাপে প্রতিটি সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৪৮ থেকে ’৫২ অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য আন্দোলন, ’৫০ থেকে ’৫৪ জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ, ’৫৪ থেকে ’৫৬ সাংবিধানিক স্বায়ত্তশাসন, ’৬৪তে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িকতা, ’৬৬তে জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্থাৎ স্বাধিকার তথা ৬ দফা, ’৬৯-এর গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে মৃত্যুকূপ থেকে মুক্তমানব হয়ে বেরিয়ে এসে সর্বজনীন ভোটাধিকারের দাবি এবং সংখ্যাগুরুর অধিকার আদায়, ’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ভূমিধ্বস বিজয় অর্জন ও পরিশেষে ’৭১-এ স্বাধীনতার ডাক দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ঐতিহাসিক এই পর্বগুলো সংঘটনে তাকে জীবনের ১৩টি বছর কারান্তরালে কাটাতে হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার মুক্তিকামী মানুষের নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার একটি উক্তি এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, It is said that no one truly knows a nation until one has been inside its jails. অর্থাৎ ‘বলা হয়ে থাকে যে, সত্যিকার অর্থে কেউ একটি জাতিকে জানতে পারে না যতক্ষণ না কেউ একজন এর কারাগারে বন্দী থাকে।’ এই বন্দিশালাতেই নেলসন ম্যান্ডেলা তার দীর্ঘ ২৭ বছর কারাজীবনের ১৮ বছর বন্দী ছিলেন। যেখানে সংরক্ষিত রয়েছে কারাবন্দী ম্যান্ডেলার বিছানার জন্য একটি ও গায়ে দেওয়ার জন্য আরেকটি কম্বল, একটি থালা, গ্লাস ও জগ। ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইটি পড়ে জেনেছি কারারুদ্ধ অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর সম্বল ছিল একটি থালা, বাটি, গ্লাস আর কম্বল। প্রকৃতপক্ষে ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইটির শিরোনাম তিনি দিয়েছিলেন ‘জেলখানার সম্বল থালা বাটি কম্বল।’ আমাদের কেন্দ্রীয় কারাগার এবং পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি কারাগারের কথা ভেবেছি, যে কারাগারে বঙ্গবন্ধু দীর্ঘকাল বন্দিজীবন অতিবাহিত করেছেন।
একুশে সংবাদ/ন.প্র/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :