বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম শুনলেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে জ্ঞান ও মুক্তবুদ্ধিচর্চার স্থান। সব শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের স্বপ্ন থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞান আহরণের। কথায় আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দা দিয়ে হেঁটে গেলেও জ্ঞান অর্জন হয়। অর্থাত্ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় প্রতিটা জায়গায় জ্ঞানচর্চার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু আজকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা শুনলেই অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের চোখে ভেসে ওঠে শ্লীলতাহানি, মানসিক টর্চার, র্যাগ, যৌন হয়রানির মতো ঘটনা। বাংলাদেশে নারীদের জন্য উচ্চশিক্ষা এমনিতেই নানান কারণে বাধাগ্রস্ত, তার ওপর এমন গর্হিত কাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় হলে তা নারীদের জন্য অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। অভিভাবকরাও তাদের মেয়েদের দূরে পাঠানোর জন্য অনিচ্ছুক হয়ে যাবে। আর তা হবে বাংলাদেশের নারীদের এগিয়ে যাওয়ার বিরাট এক বাধা।
বাংলাদেশে একাডেমিক শিক্ষার সর্বোচ্চ পর্যায় হলো বিশ্ববিদ্যালয়। যেখান থেকে একজন শিক্ষার্থী তার নিজের, পরিবারের, সমাজের ও রাষ্ট্রের সেবার জন্য তৈরি হয়ে ওঠে। সুনাগরিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলে। আর এর পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ। আর শিক্ষকের সম্মান একজন শিক্ষার্থীর কাছে তার মা-বাবার পরেই। একজন আদর্শবান শিক্ষক তার আদর্শ দিয়ে সমাজ ও দেশ পরিবর্তন করতে পারেন। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, ‘দেশ ভালো হবে, যদি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভালো হয়।’
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দিনদিন যৌন নিপীড়নের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৫৫টি আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ১১৪টি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৫টির মধ্যে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছে ৪৫টি থেকে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১১৪টির মধ্যে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছে ৯৭টি থেকে। মোট ১৬৯টি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অধিকাংশে যৌন হয়রানি হয়ে থাকে। প্রতিদিন খবরের কাগজ খুললেই দেখা যায় কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী তার সহপাঠী কিংবা শিক্ষক কর্তৃক যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমন যৌন হয়রানি হয়, তার একটা জরিপ করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল আলীম স্যার। তিনি বলেন, প্রায় ৯০ শতাংশ ছাত্রী যৌন নিপীড়নের অভিযোগ করেন না। তার কারণ হলো যাদের দ্বারা এমন কাজ হয় তারা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকে। তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনও নীরব ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও অভিযোগ না করার বড় কারণ নিরাপত্তা এবং চরিত্র হননের হুমকি। এই নিরাপত্তা ও চরিত্র হননের ভয়ে ৯০ শতাংশ ছাত্রী তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া যৌন হয়রানির কোনো পদক্ষেপ নেন না। ঐ শিক্ষকের কোর্সে ফেইলের আশঙ্কাও কাজ করে। স্যারের গবেষণায় আরো উঠে আসে, বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ছাত্রী তার সহপাঠী কর্তৃক যৌন হয়রানির শিকার হন, যার পরিমাণ প্রায় ৫৬ শতাংশ।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যৌন নিপীড়নের তেমন শাস্তিযোগ্য আইন নেই বললেই চলে। কিন্তু এমন সহপাঠী, শিক্ষক ও বহিরাগতদের দ্বারা নির্যাতিত হলে কঠোর আইনের প্রয়োজন আছে। ২০০৮ সালের এক রিটের আবেদনের পরে ২০০৯ সালের ১৪ মে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে দেয়। কিন্তু তারও বাস্তব রূপ নেই। এমন ঘটনার জন্য ১২০ দিনের মধ্যে সমাধান করার কথা, অথচ মাসের পর মাস যায়, বছর পার হয়ে যায়, ঘটনার কোনো সুরাহা হয় না।
যাদের দ্বারা এমন কাজ ঘটছে তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ও অপমানজনক শাস্তি দিতে হবে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় যারা এমন কাজ করে তারা রাজনীতিকেও কলুষিত করে। রাজনৈতিকভাবেও তাদেরকে পাকড়াও করতে হবে। তাহলেই বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নের মতো নোংরা কাজ ও আচরণ কমে যাবে। মূলত দৃশ্যমান ও অপমানজনক শাস্তিই কমাতে পারে যৌন নিপীড়নের মতো গর্হিত কাজকে।
একুশে সংবাদ.ন.প্র/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :