এক মাস রমজানের সিয়াম সাধনার পর আসছে ঈদ, যা বয়ে আনবে সবার জন্য অনাবিল আনন্দ। ঈদ মানেই খুশি, ঈদ মানেই আনন্দ, খাওয়াদাওয়া, নতুন জামাকাপড় আর ঘোরাঘুরি। ছোট বাচ্চা থেকে বয়স্করা সবাই ঈদের আনন্দকে বরণ করে নেওয়ার জন্য উদ্গ্রীব। রোজার এক মাসে মানুষের খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপনে যে পরিবর্তন আসে, সেটাতেই অনেকে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। মাসখানেক সিয়াম সাধনার পর ঈদের দিন সকালেই শুরু হয় ইচ্ছেমতো খাওয়াদাওয়া। আর ঈদের দিনে আনন্দের অন্যতম আয়োজনটাই হলো নানা রকমের খাবারদাবার। সকাল বেলা উত্সবের শুরুটাই হয় মিষ্টি, সেমাই, পোলাও, কোর্মাসহ আরো কত রকমের খাবার দিয়ে। অনেকে এই সুযোগে বেশ একটা ভূরিভোজ করে ফেলেন।
আসলে ঈদের দিন এভাবে লাগামছাড়া খাওয়াদাওয়া করাটা হতে পারে স্বাস্থ্যের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর। হঠাত্ ঈদের দিনে অতি ভোজনের ফলে পাকস্থলী তথা পেটের ওপর চাপটা পড়ে বেশি। নিজের ঘরে হরেক রকমের খাবারের সঙ্গে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের বাসায় বেড়াতে গেলেই ইচ্ছা-অনিচ্ছায় আরো বেশি খেতে হয়। ফলে অধিক চাপে অনেক সময় পাকস্থলির অ্যানজাইম ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। এ কারণে পেটে ব্যথা, গ্যাস্ট্রাইটিস, ডায়রিয়া, বমি, পেটফাঁপা ইত্যাদি হরহামেশাই দেখা যায়। সাধারণত ঈদের দিন প্রচুর তৈলাক্ত খাবার যেমন—পোলাও, বিরিয়ানি, মুরগি, খাসি বা গরুর গোশত, কাবাব, রেজালা আর এর সঙ্গে মিষ্টিজাতীয় খাবার আমরা সবাই খাই। একসঙ্গে বেশি খাওয়ার ফলে পেটে অস্বস্তিকর অনুভূতি, ভরা ভরা ভাব, বারবার ঢেকুর ওঠা, এমনকি বুকে ব্যথা পর্যন্ত হতে পারে। যাদের পেপটিক আলসার আছে, তাদের রোজা রাখার ফলে দীর্ঘক্ষণ পেট খালি থাকার জন্য নিঃসারিত হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড পাকস্থলী ও ডিওডেনামে ক্ষত করতে পারে। তৈলাক্ত ও ঝাল মসলাযুক্ত খাবার খাওয়ায় পাকস্থলী ও ডিওডেনামের ক্ষতে পুনরায় প্রদাহের সৃষ্টি হয়। ফলে বুক জ্বালা, পেট জ্বালা ইত্যাদি অনেক বেড়ে যায়। আইবিএস বা ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম রোগে যারা ভোগেন, তাদের সমস্যাটা আরো বেশি দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে দুধ ও দুগ্ধজাত খাবারগুলো যেমন পায়েস, সেমাই, হালুয়া ইত্যাদি খাবারে অস্বস্তি, ঘন ঘন মলত্যাগ ও অসম্পূর্ণ মলত্যাগের অনুভূতি হয়। আবার বিভিন্ন খাবার অন্ত্র থেকে অতিরিক্ত পানি শোষণ করে। ফলে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা বেড়ে যেতে পারে। যাদের অ্যানাল ফিশার ও পায়ুপথে জ্বালাপোড়া, ব্যথা ইত্যাদি আগে থেকেই আছে, তাদের এ সমস্যা আরো বেশি প্রকট হয়। যাদের হিমোরয়েড বা পাইলসের সমস্যা আছে, তাদের পায়ুপথে রক্তক্ষরণও হতে পারে।
আসলে ছোট বাচ্চাদের ঈদের আনন্দটা সবচেয়ে বেশি। তারা শখ করে দুই-একটা রোজা রাখে, রোজা শেষে ঈদের দিন মজার মজার খাবার খেতে বেশি পছন্দ। তবে অতিভোজনে যে কারো মতো ছোটদেরও সমস্যা হতে পারে।
খাওয়ার পরিমাণের দিকে নজর দিন :যে কোনো কিছু খেলেই সব সময় শরীরে সমস্যা হবে এমন কথা নেই। শুধু পরিমাণটা ঠিক রাখলেই হলো। অতিভোজন না করাই ভালো। ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়ার আগে অল্প করে সেমাই বা পায়েস খাওয়া ভালো। এগুলোর সঙ্গে কিশমিশ, বাদাম, ফলের জুস, যেমন পেঁপে, আম ইত্যাদি খেতে পারেন। খাওয়ার আধাঘণ্টা পর দেড় থেকে দুই গ্লাস পানি খেয়ে ঈদের নামাজ পড়তে যাবেন। দিনে বিভিন্ন ধরনের খাবার খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে প্রচুর পানি ও অন্যান্য তরল খাবার খাওয়া ভালো। একবারে বেশি করে না খেয়ে অল্প অল্প করে বারবার খাবেন। যারা ঈদের দিন চটপটিজাতীয় খাবার পছন্দ করেন, তারা তেঁতুলের টক মিশিয়ে খেতে পারেন। পোলাও বা বিরিয়ানির সঙ্গে অবশ্যই সালাদজাতীয় খাবার এবং দই খেতে পারেন।
যাদের বেশি সতর্কতা দরকার :যারা মাঝ বয়সি বা বয়োবৃদ্ধ বা যাদের অন্যান্য শারীরিক সমস্যা আছে, যেমন—ডায়াবেটিস, হাই ব্লাডপ্রেশার বা হূদেরাগ ইত্যাদি, তাদের খাবারের ব্যাপারে সতর্ক থাকা জরুরি। ডায়াবেটিস রোগীকে অবশ্যই মিষ্টিজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। সবজি বা টক ফল দিয়ে মজাদার খাবার আগেই বানিয়ে রাখুন। এগুলো আপনাকে অন্য খাবার থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করবে। নেহাত মিষ্টি খেতে চাইলে চিনির বিকল্প দিয়ে তৈরি করে নেবেন। পোলাও-বিরিয়ানি কম খাবেন, ভাত খাওয়াই ভালো। তাই বলে অতিরিক্ত খাবার অবশ্যই পরিহার করবেন। মুরগি বা গরুর মাংস খাওয়া যাবে, যদি অতিরিক্ত তেল বা চর্বি না থাকে। সঙ্গে কিডনির সমস্যা থাকলে মাংস পরিহার করতে হবে। খাসি, কলিজা, মগজ, চিংড়ি ইত্যাদি খাবেন না। সবচেয়ে বড় কথা, এসব খাবার এক বেলাই খাওয়া উচিত, অন্য বেলায় স্বাভাবিক খেতে হবে। রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য এদিন একটু বেশি হাঁটাহাঁটি করতে পারেন, প্রয়োজনে ডায়াবেটিসের ওষুধ বা ইনসুলিনের মাত্রা একটু বাড়াতে হতে পারে। এ ব্যাপারে ঈদের আগেই চিকিত্সকের পরামর্শ নিন। যাদের রক্তে কোলেস্টেরল বেশি বা উচ্চরক্তচাপ আছে অথবা হার্টের সমস্যা আছে অথবা যারা মুটিয়ে যাচ্ছেন, তাদের অবশ্যই তেল ও চর্বি এড়িয়ে যেতে হবে। তবে চর্বি ছাড়া গরুর মাংস খাওয়া যাবে পরিমাণমতো। ভাজাপোড়া খাবেন না, বিশেষ করে বাইরের। ফল বা ফলের রস, সালাদ ইত্যাদি বেশি করে খাবেন। বিশেষ করে খাবারের শুরুতে সালাদ খেলে অন্য খাবারের জন্য জায়গা কমে যাবে। এছাড়া টক দই খেলে উপকার পাবেন।
মনে রাখতে হবে :
(১) পেট পুরে খাওয়া মানসিক তৃপ্তি দিতে পারে বটে, কিন্তু শরীরের জন্য ভয়ানক ক্ষতিকর। একবারে বেশি না খেয়ে বারেবারে কম পরিমাণে খাওয়া ভালো। সকালের নাশতা একটু বেশি হলেও দুপুরের খাবার হবে হালকা। রাতের খাবার মসলাদার না হওয়াই উচিত।
(২) অতিরিক্ত পোলাও, বিরিয়ানি বা চর্বিজাতীয় খাবার পরিহার করবেন।
(৩) যারা গ্যাস্ট্রিক, আলসার বা আইবিএস বা অন্যান্য পেটের রোগে ভোগেন, তারা ডমপেরিডন, ওমিপ্রাজল বা প্যান্ট্রোপ্রাজল-জাতীয় ওষুধ খাবেন। অ্যান্টাসিড-জাতীয় ওষুধ এবং বিভিন্ন এনজাইম খেতে পারেন। যাদের আইবিএস আছে, তারা দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার পরিহার করবেন। যাদের কোষ্টকাঠিন্যের সমস্যা, অ্যানাল ফিশার ও পায়ুপথে জ্বালাপোড়া বা ব্যথা ইত্যাদি সমস্যা আছে, তারা ইসবগুলের ভুসি, বেল, পেঁপে ইত্যাদি খেতে পারেন।
(৪) রাতে কোনো দাওয়াতে গেলে অল্প পরিমাণে খাবেন। খাওয়ার অন্তত দুই ঘণ্টা পর বিছানায় যাবেন।
(৫) ঈদের সময় সাধারণত সবাই একত্রে বসে খান এবং অনেক গল্পগুজব করেন। এতে অতিরিক্ত বাতাস পাকস্থলীতে ঢোকে, ফলে বারবার ঢেকুর তোলার সমস্যা হয়। তাই খাবারের সময় যতটা সম্ভব কম গল্পগুজব করা উচিত এবং গোগ্রাসে না খেয়ে খাবার ভালো করে চিবিয়ে খেতে হবে।
(৬) খাবারের সময় একটু পরপর পানি না খাওয়া উচিত, এতে হজম রসগুলো পাতলা হয় এবং হজমে অসুবিধা হতে পারে। তাই খাওয়ার অন্তত আধা বা এক ঘণ্টা পর পানি পান করা উচিত।
(৭) কোমল পানীয়, চিনিযুক্ত পানীয় পরিহার করবেন। এসবের বদলে চিনি ছাড়া ফলের জুস, বোরহানি, টক দই, পুদিনা লাচ্ছি, ডাবের পানি ইত্যাদি খেতে পারেন।
(৮) কোনো সময় বেশি খেয়ে ফেললে বা দাওয়াত থাকলে অন্য সময় রুটি, সালাদ বা স্যুপ খেতে পারেন। ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য ভাত, চিনি, মিষ্টিজাতীয় খাবার কম খেতে হবে।
(৯) ব্যায়াম অব্যাহত রাখুন। পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন নিয়ে হাঁটাচলা করতে পারেন। এতে মন প্রফুল্ল থাকবে, শরীরও সুস্থ থাকবে।
(১০) এ কথাও মনে রাখতে হবে, খাওয়াদাওয়ার ফলে যদি কোনো শারীরিক সমস্যা হয়, তবে সঙ্গে সঙ্গে চিকিত্সকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
ঈদ অবশ্যই আনন্দের, আর এর সঙ্গে মনে হয় ভূরিভোজ না করলে আনন্দটা পূর্ণতা পায় না। খাওয়াদাওয়ার সঙ্গে মনে রাখতে হবে, খাওয়াটা যেন হয় ভেজালমুক্ত, টাটকা, স্বাস্থ্যসম্মত, সহজপাচ্য এবং উপাদেয়। তা অবশ্যই হতে হবে পরিমিত ও পরিকল্পিত। ঈদের সময় শারীরিকভাবে সুস্থ না থাকলে সব আনন্দই মাটি হয়ে যাবে। আমাদের প্রিয়নবি হজরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন, ‘পেটের এক-তৃতীয়াংশ ভাগ আহারের জন্য, এক-তৃতীয়াংশ ভাগ পানির জন্য আর এক-তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস :৩৩৪৯)। এ কথাও মনে রাখতে হবে, অতিভোজন এমনকি স্বাভাবিক খাওয়াদাওয়ার ফলেও যদি শারীরিক সমস্যা হয়, তবে সঙ্গে সঙ্গে চিকিত্সকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
একুশে সংবাদ/ই.ফ.প্র/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :