দুর্নীতি প্রতিটি সমাজ ও দেশের জন্য একটি গুরুতর সমস্যা। বিভিন্ন সমাজ দেশে দুর্নীতির কারণ, ধরন, ও প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন। দুর্নীতি অনেক রূপে ঘটতে পারে। অনেকেই দুর্নীতি বলতে শুধু অবৈধ বা অনৈতিক আর্থিক লেনদেনকে বোঝে কিন্তু যা কিছু নীতির পরিপন্থী বা নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক, তা-ই দুর্নীতি।
নিজে সুবিধা না নিয়েও নিকটজনকে অপ্রাপ্য বা অনৈতিক সুবিধা পাইয়ে দেওয়া, যোগ্যজনকে তার ন্যায্য সুবিধা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করাও গুরুতর দুর্নীতি। নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করাও বড় ধরনের দুর্নীতি। কারো ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা একটি দীর্ঘমেয়াদি দুর্নীতি। দুর্নীতির এই রূপটি দুর্নীতির সংস্কৃতি লালন এবং সমাজকে ভেতর থেকে ক্ষয় করার জন্য দায়ী।আর দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও প্রশাসন প্রতিটি ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত সাফল্য অর্জনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় দুর্নীতি।
দুর্নীতি দমনে সরকারের দায়বদ্ধতার পাশাপাশি জনগণেরও দায় রয়েছে। এটি একটি সমন্বিত প্রক্রিয়া। প্রয়োজন সরকার ও জনগণের কার্যকর ও সমন্বিত পদক্ষেপ। বাংলাদেশ দুর্নীতি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে বৈশ্বিক ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনের ভূমিকাকে সমর্থন করছে এবং জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী সনদের নির্দেশনা অনুসারে অন্যান্য দেশের সঙ্গে পারস্পারিক সহযোগিতার মাধ্যমে সম্পদ পুনরুদ্ধারে অনেকটাই অগ্রগতি সাধন করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন, তার সুফল এরই মধ্যে ভোগ করছে জনগণ।
বর্তমান সরকার স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে দুর্নীতি কমিশনকে কার্যপরিচালনার জন্য সার্বিক সহায়তা প্রদান করছে। জনগণ যাতে দুর্নীতি-সংক্রান্ত অভিযোগ সহজে প্রদান করতে পারে, সেজন্য প্রতিটি জেলার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ‘অভিযোগ গ্রহণ বাক্স’ স্থাপন করা হয়েছে। তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে সুফলও জনগণ পাচ্ছে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে কর্মপরিবেশ ও দক্ষতার দিক থেকে যুগোপযোগী ও আধুনিকায়ন করা এবং আধুনিক তথ্য ও প্রযুক্তির সহজলভ্যতায় এবং প্রায়োগিক ব্যবহারে সহযোগিতা অব্যাহত রাখার ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে বর্তমান সরকারের নির্বাচনি ইশতেহারে।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পর্যালোচনা, পর্যবেক্ষণ ও তদারকি কার্যক্রমকে জোরদার করছে। ঘুষ, অনোপার্জিত আয়, কালোটাকা, চাঁদাবাজি, ঋণখেলাপি, টেন্ডারবাজি ও পেশিশক্তি প্রতিরোধ এবং দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার মোতাবেক বেশ কিছু সফল উদাহরণ এরই মধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে অনেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ধরা পড়েছেন এবং অনেকেই গা ঢাকা দিয়েছেন। দুর্নীতির ব্যাপারে কোনো ধরনের শৈথিল্য নয়, বরং সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি যথেষ্ট কার্যকর ভূমিকা রাখছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন সমাজের সৎ, মর্যাদাবান ও চারত্রিক দৃঢ়তাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে দেশব্যাপী ৫৪১টি দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি গঠন করেছে, যারা নিজেদের এলাকায় দুর্নীতি প্রতিরোধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের সবচেয়ে যুগান্তকারী পদক্ষেপ হলো টোল ফ্রি হটলাইন নম্বর চালু। যে কেউ এই নম্বরে ফোন দিয়ে দুর্নীতির তথ্য জানাতে পারেন। কমিশনে দুর্নীতি-সংক্রান্ত অভিযোগ জানানোর জন্য হটলাইন ১০৬ চালু হওয়ার পর থেকে সাধারণ জনগণ সুফল ভোগ করছে। তৎক্ষণাৎ দুর্নীতির তথ্য কমিশনকে জানানোর এ উদ্যোগটি ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ছিল একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা। কিন্তু জাতির জনকের শাহাদাত বরণের পর সেই স্বপ্ন বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে, পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং মুখ থুবড়ে পড়েছে। জাতির জনকের সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্য হাল ধরেছেন তাঁরই সুযোগ্য কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
দুর্নীতি প্রতিরোধে বর্তমান সরকার কর্তৃক বেশকিছু আইন কার্যকর ভূমিকা রাখছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯; তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯; ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯; সরকারি অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনা আইন, ২০০৯; জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন, ২০০৯; জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন, ২০১১; মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২; মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ প্রভৃতি। একথা ঠিক যে, দুর্নীতিকে কেবল আইনি কাঠামোর মধ্যে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়, প্রয়োজন অধিকতর সামাজিক আন্দোলন। এই আইনগুলো সামাজিক আন্দোলনের পথকে আরও সুগম করেছে।
দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশের জন্য আরও বেশি বাস্তবধর্মী তথ্যচিত্র নির্মাণ ও প্রচারের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। পাশাপাশি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সহায়তায় মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের দুর্নীতিবিরোধী ক্ষুদে বার্তা পাঠানোর কার্যক্রম কমিশন চালু করেছে। মনে রাখতে হবে, বারবার যদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সচেতনতামূলক বিভিন্ন বার্তা পাঠানো যায়, তা সুফল বয়ে আনবে।
দুনীতি দমন কমিশনের যে প্রচারাভিযান রয়েছে, খারাপ কাজ করব না, খারাপ কাজ সইব না’, ‘ভালো কাজ করব, দেশকে সবাই গড়ব’, ‘দেশকে নিয়ে ভাবব, নীতির পথে চলব’, ‘সত্য কথা বলব, অন্যায়-অবিচার রুখব’, ‘আইন মেনে চলব, নিরাপদে থাকব,’ ‘দেশপ্রেমের শপথ নিন, দুর্নীতিকে বিদায় দিন’, ‘মিথ্যাবাদীকে কেউ বিশ্বাস করে না’, ‘গুরুজনকে উপহাস করিও না’ প্রভৃতি সুবচন-সংবলিত খাতা, স্কেল, জ্যামিতি বক্স দেশব্যাপী ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীর মাঝে বিতরণ করার যে কার্যক্রম রয়েছে, সেটি প্রয়োজনের তুলনায় বেশ নগণ্যই বলা চলে। এটিকে আরও ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে দিতে হবে। দুনীতি প্রতিরোধে বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, যেমন ফেসবুক, টুইটার ও ইউটিউব বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের বিরুদ্ধেও অভিযোগের অন্ত নেই। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, প্রভাবশালীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়, কিংবা প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে দুদক আশাতীত সফলতা দেখাতে ব্যর্থ হয়। কমিশনে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নৈতিক অবস্থানকে আরও দৃঢ় করতে হবে। সাধারণ জনগণের কাছাকাছি আসতে হলে দৃশ্যমান আরও কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে।
নৈতিক অবস্থান পোক্ত করার জন্য বেশি বেশি নৈতিকতা-বিষয়ক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দুর্নীতিমুক্ত করে গড়ে তোলার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে শিক্ষার সব স্তরে নৈতিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রশাসনের সঙ্গে জড়িতদের দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল বাস্তবায়নের লক্ষ্যে যে কার্যক্রম চালু আছে, এটিকে আরও সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন। সরকারি, বেসরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকেই এই শুদ্ধাচার কৌশলের আওতায় নিয়ে আসার পদক্ষেপ গ্রহণ করা সময়ের দাবি।
দুর্নীতি সার্বিক অগ্রগতি এবং উন্নয়ন ব্যাহত করছে। এটা প্রতিরোধ করা শুধু সরকার বা দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষে সম্ভব নয়। সর্বস্তরে মূল্যবোধ সৃষ্টি, সচেতনতা বাড়ানো, সামাজিক অবক্ষয় রোধ ও নৈতিকতা শিক্ষার মাধ্যমে দুর্নীতি কিছুটা রোধ করা সম্ভব হলেও প্রয়োজন ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। প্রত্যেকের নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। প্রথমে নিজেকে দুর্নীতিমুক্ত ঘোষণা এবং তার পরই এই সামাজিক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার মধ্য দিয়েই বৃহৎ পরিসরে সুফল পাওয়া যেতে পারে।
পরিশেষে বলতে চাই, দুর্নীতি প্রতিরোধে মানুষকে নৈতিক জীবন-যাপনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সততা দ্বারা প্রভাবিত আচরণগত উত্কর্ষ যেন সে অনুসরণ করে চলে। তার যেন সমাজের কালোত্তীর্ণ মানদণ্ড, নীতি ও প্রথার প্রতি আনুগত্য থাকে। দুর্নীতি প্রতিরোধে ব্যক্তি-পর্যায়ে কর্তব্যনিষ্ঠা ও সততা, তথা চরিত্রনিষ্ঠা খুব দরকার। এজন্য বিদ্যমান আইনকানুন, নিয়মনীতির সঙ্গে দুর্নীতি দমনকে একটি আন্দোলন হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করতে হবে। সেই অঙ্গীকারকে কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকারের সদিচ্ছার সঙ্গে সঙ্গে জনগণের প্রচেষ্টা গুরুত্ববহ।তাই আমরা মনে করি, দুর্নীতি দমনে দুদকের স্বাধীনতা রয়েছে।
বর্তমান সরকার মন্ত্রী বা প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা দুদকের ওপর কোনো প্রভাব বিস্তার করছে বলে মনে হয় না। পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্র শতভাগ দুর্নীতিমুক্ত নয় একথা সত্য। কিন্তু আমাদের দেশে এর ব্যাপকতা বেশি। ক্রমবর্ধমান দুর্নীতির কারণে দেশে আইনের শাসন সুশাসন প্রতিষ্ঠা যেমন সম্ভব হচ্ছে না তেমনি জনগণ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী আইনের শাসন ন্যায়বিচার, সুশাসন প্রতিষ্ঠা সর্বোপরি দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু করেছেন- যা দেশবাসী স্বাগত জানায়।আর দুর্নীতি শুধু রাষ্ট্রের উন্নয়নের ব্যাঘাত ঘটায় না ন্যায়বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার বড় অন্তরায়। এ বৃত্ত থেকে আমাদের অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে। নইলে দেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব নয়।
লেখক, সংগঠক,কলাম লেখক ও গবেষক
প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
একুশে সংবাদ/ এসএডি
আপনার মতামত লিখুন :