AB Bank
ঢাকা শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

Ekushey Sangbad
ekusheysangbad QR Code
BBS Cables
Janata Bank
  1. জাতীয়
  2. রাজনীতি
  3. সারাবাংলা
  4. আন্তর্জাতিক
  5. অর্থ-বাণিজ্য
  6. খেলাধুলা
  7. বিনোদন
  8. শিক্ষা
  9. তথ্য-প্রযুক্তি
  10. অপরাধ
  11. প্রবাস
  12. রাজধানী
ভোক্তা অধিকার

শুধু কোকের বোতল সরালে গণহত্যা থামবে না


Ekushey Sangbad
পাভেল পার্থ
০৬:৪৪ পিএম, ২৫ জুন, ২০২৪
শুধু কোকের বোতল সরালে গণহত্যা থামবে না

ফিলিস্তিনে সাম্প্রতিক গণহত্যা শুরুর পর ‘ইসরায়েলি পণ্য’ বর্জনের নামে ‘কোক বয়কট’ প্রচারণা শুরু হয়েছে; মূলত সামাজিক মাধ্যমে। পণ্য বয়কটের মাধ্যমে অন্যায্যতার প্রতিবাদ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। প্রশ্ন হচ্ছে, বয়কটকারীরা দোকান থেকে কোকের বোতল সরাতে পারলেও, কোক-উপনিবেশর অবসান ঘটাতে পারবে? এই প্রবণতা কি দুনিয়াজুড়ে কোকা-কোলায়ন বাহাদুরিকে প্রশ্ন করছে? গ্রামীণ উৎপাদন, পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য, বহুজাতিক কর্তৃত্ব কিংবা পণ্যমানসিকতার তর্ক সামনে আনছে?

ভারতজুড়ে ২০০৬ সালে যখন কোক-পেপসি নিয়ে তুমুল তর্ক, সেই সময়ে আমি কেরালা ও কলকাতায় ছিলাম। নয়াদিল্লির বেসরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট (সিইসি) নানা এলাকায় কোক-পেপসির ওপর সমীক্ষা চালিয়ে ক্ষতিকর কীটনাশকের উপস্থিতি প্রমাণ করে। ৪ আগস্ট ২০০৬ সংবাদমাধ্যমে এ খবর প্রকাশের পর ভারতজুড়ে তুমুল তর্ক ওঠে। কেরালা, কর্ণাটক, পাঞ্জাব, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশের স্কুল-কলেজে কোক-পেপসি বিক্রি নিষিদ্ধ করে সরকার। ছত্তিশগড়ে সরকারি অনুষ্ঠানে নিষিদ্ধ হয় কোক-পেপসি। অন্ধ্রপ্রদেশের তৎকালীন রাজ্য সম্পাদক খেলোয়াড় ও অভিনয়শিল্পীদের এসব পানীয়ের বিজ্ঞাপনে অংশ না নেওয়ার অনুরোধ জানান।

ওই সময় কেরালার প্লাচ্চিমাঢ়ার ক্ষতিগ্রস্ত আদিবাসী কৃষকদের কোকবিরোধী আন্দোলন বোঝার বিরল সুযোগ হয়েছিল। ২০০২ সালে প্লাচ্চিমাঢ়ার আদিবাসী বসত ও কৃষিজমি দখল করে প্রায় ৪০ একরজুড়ে কোকো-কোলা কোম্পানি বসে। প্রতিদিন প্রায় ৬ লাখ লিটার পানি মাটির তলা থেকে তোলা হয়। ফলে মুষড়ে পড়ে কৃষি উৎপাদন। এমনকি কারখানার বর্জ্য থেকে তীব্র রাসায়নিক দূষণও ঘটে। মাটি, পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য, গ্রামীণ উৎপাদন ব্যবস্থা নিদারুণ সংকটে পড়ে। কৃষি ও জীবন বাঁচাতেই সেখানকার কৃষকরা কোকবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। ২০০৬ সালে নতুন করে শুরু হওয়া কোক-পেপসিবিরোধী আন্দোলনকালে প্লাচ্চিমাঢ়ার সাহসী নারীদের কথাও জানা হয়।

সেসময় পত্র-পত্রিকার নিবন্ধে প্রশ্ন তুলেছিলাম, বাংলাদেশে কোক-পেপসি কতটুকু নিরাপদ এবং তারা কীভাবে আমাদের মাটির তলার পানি বিক্রি করছে? কিন্তু নিদারুণভাবে কেউ প্রশ্নটি নিয়ে পাশে দাঁড়ায়নি। কৃষি, খাদ্য-সংস্কৃতি, গ্রামীণ অর্থনীতি, জনস্বাস্থ্য, বাস্তুতন্ত্র, পরিবেশ ব্যবস্থাকে নানাভাবে দখল-দূষণের বিরুদ্ধে কোনো স্পষ্ট রাজনৈতিক জিজ্ঞাসা তৈরি হয়নি।

দেখছি, সাম্প্রতিক বয়কট আন্দোলনও ‘নৈতিক ভোগবাদিতা’ অনুশীলনকে উৎসাহিত করছে না। পানীয় কিংবা আহার যখন বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে বন্দি, এর বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক আন্দোলনের কোনো জিজ্ঞাসা নেই। ফিলিস্তিনে আবার গণহত্যা শুরু হলে ম্যাকডোনাল্ড ইসরায়েলি সেনাদের জন্য খাবারের দোকান খোলে। বহুজাতিক কোম্পানির সব অন্যায় ও কর্তৃত্ব আড়াল করে কেবল ‘ইসরায়েলি পণ্য’ বয়কটে কি কোনোভাবে নয়া উদারতাবাদী ব্যবস্থার বদল সম্ভব? মাটির তলার পানি তুলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে কি আন্দোলন হবে না? প্লাস্টিকদূষণের জন্য শীর্ষ সারির কোম্পানিগুলোর পণ্য বয়কটের দাবিতে কেউ কি রাস্তায় নামবে না? বৈচিত্র্যময় খাদ্যজনরুচির বিপরীতে ভোগবাদী ভুয়া ‘খাদ্য-স্ট্যাটাস’ জারি রাখার বিরুদ্ধে কোনো জনজিজ্ঞাসা কি তৈরি হবে না? তাহলে কেবল ‘ইসরায়েলি পণ্য’ হিসেবেই কি আমরা কোক বয়কট করব?

বাজার থেকে কোক চলে যেতে পারে, কিন্তু কোকা-কোলায়ন কি বদলাবে? পুরোনো বোতল বদলে নতুন বোতল আসবে। নতুন বোতলে অমীমাংসিত কর্তৃত্ব, বাহাদুরি, উপনিবেশ, দূষণ ও দখল প্রবলভাবেই বহাল থাকবে। একই সঙ্গে স্মরণ রাখা জরুরি, কোক যদিও বাজার থেকে চলে যায়, নতুন বোতলে আসা পুরোনো কর্তৃত্ব অন্য কোনো ভূমি দখল, গণহত্যা, দূষণ বা নিপীড়ন জারি রাখবে। কারণ সাম্প্রতিক বয়কট আন্দোলনের ভেতর দিয়ে আমরা বিদ্যমান নয়া উদারতাবাদী খাদ্যব্যবস্থাকে প্রশ্ন করছি না। নিপীড়িত জনগণ ও প্রকৃতির যন্ত্রণা এবং আহাজারি থেকে বহুজাতিক কর্তৃত্বকে বয়কটের কোনো প্রবণতা তৈরি হচ্ছে না। তাহলে সাধারণভাবেই প্রশ্ন জাগে এই বয়কট আন্দোলন কার জন্য?

দোকান থেকে কোকের বোতল সরালেই কি যুদ্ধ ও গণহত্যা থেমে যাবে? গণহত্যা, দখল, দূষণ, যুদ্ধ বন্ধ করতে হলে কোক-উপনিবেশের বিরুদ্ধে নানাভাবে গড়ে ওঠা জন-তৎপরতা ও বয়কটপ্রবণতাকে রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ দিতে হবে। তা না হলে এক বোতল গিয়ে হয়তো আরেক বোতল আসবে। বহুজাতিক বোতল-বাহাদুরি টিকেই থাকবে। দুনিয়ার গরিষ্ঠভাগ ক্ষমতাহীন নিম্নবর্গের জীবনে বঞ্চনা, রক্তপাত, দখল প্রশ্নহীনভাবে দুঃসহ ও প্রবল থেকে প্রবলতর হতেই থাকবে।

একটা কোক না খেয়ে হয়তো অনেকে ফিলিস্তিনে মানুষসহ প্রাণ-প্রকৃতি গণহত্যার বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছেন। এই সংহতি ও তৎপরতা খুব জরুরি। অবশ্যই গণহত্যার সঙ্গে জড়িত যে কোনো বাণিজ্য ও বাহাদুরির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো জরুরি। কিন্তু আমাদের কি ২০২০ সালের ডিসেম্বরে রাজশাহীর তানোরের ক্ষতিগ্রস্ত আলুচাষিদের কথা মনে আছে? জার্মান বায়ার কোম্পানির এন্ট্রাকল নামের এক ছত্রাকনাশক জমিতে ব্যবহার করার পর বিঘার পর বিঘা জমি ঝলসে গিয়েছিল। কেউ ক্ষতিগ্রস্ত আলুচাষিদের পাশে দাঁড়ায়নি।

মনে আছে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) এবং খাদ্যবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরীক্ষাগারে একটি নুডলসে সিসা পাওয়া গিয়েছিল। এ নিয়ে তর্ক ওঠায় কিছুদিন বাজারে নুডলসটি বন্ধ ছিল। এর পর সেটা বাজারে বিক্রি হয়েছে ‘ধর্মীয় অনুভূতি’ কাজে লাগিয়ে; ইসলামিক ফাউন্ডেশন পরীক্ষিত ‘হালাল নুডলস’ মোড়কে আবার নুডলসটি বিক্রি শুরু হয়। এ নিয়ে আমরা কোনো পাবলিক জিজ্ঞাসা বা তৎপরতা দেখিনি।

কোক, পেপসির প্রমাণিত পরিবেশদূষণ, স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে খুব বেশি আওয়াজ আমরা দেখি না। কিন্তু ‘পে এভরি পেনি টু সেভ ইসরায়েল’– পেপসির এমনতর ব্যাখ্যা আবার খুব প্রচারিত। বহু পোস্টার ও পোস্টে দেখা যায়, বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর পরিচয়কে ‘ধর্মীয়’ হিসেবে বিবেচনা করে সেসব কোম্পানির পণ্য বাতিল ও বর্জনের ডাক দেওয়া হয়। জনপরিসরে আড়াল করে ফেলা হয় বহুজাতিক কোম্পানির জারি রাখা অন্যায়-অবিচারকে। কিন্তু কোনো খাদ্য বা পানীয় কি কোনো বিশেষ কোম্পানি বা ব্যক্তির ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে খারিজ হতে পারে? কিংবা একজন কৃষকের উৎপাদিত ধান কিংবা জেলের ধরা মাছ কি তার ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে নিষিদ্ধ হতে পারে?

 

একুশে সংবাদ/স.ল.প্র/জাহা

Link copied!