নতুন কারিকুলামে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা গ্রহণ ও উত্তরপত্র মূল্যায়নের কাজ শুরু হয়েছে। ১ জুলাই ২০২৪ চূড়ান্ত করা হয়েছে নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতি এবং ৩ জুলাই পরীক্ষা নেওয়া শুরু হয়েছে। সারা দেশে ১ কোটি পরীক্ষার্থী মাধ্যমিক পর্যায়ের এই পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে।
কর্তৃপক্ষ বলেছে, এই পদ্ধতিতে ‘নৈপুণ্য’ নামক একটি অ্যাপসের মাধ্যমে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানের কাছে পরীক্ষার কয়েক দিন আগে অথবা আগামী বছর থেকে এক রাত আগে সন্ধ্যায় প্রশ্ন ও তৈরিকৃত উত্তর প্রদানের নিয়ম করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানপ্রধান সেগুলো ডাউনলোড করে নির্দিষ্ট সময়ে পরীক্ষার হলে শিক্ষার্থীদের প্রিন্ট করে সরবরাহ করবেন। আপাতদৃষ্টিতে এটা খুব সময়োপযোগী আধুনিক পদ্ধতি।
তবে এ বছর ৩ জুলাই ষাণ্মাসিক মূল্যায়ন বা অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্ন এবং উত্তর পরীক্ষার আগের রাতে ফাঁস হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এবার ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণির পরীক্ষা শুরুর আগের দিন দুপুরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধানের কাছে প্রশ্ন পাঠায় এনসিটিবি। নিয়ম অনুযায়ী সেই প্রশ্নের ফটোকপি করে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই প্রশ্নের সঙ্গে আগের রাতে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের হুবহু মিল থাকায় সবার মধ্যে, বিশেষ করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে বিভ্রান্তি শুরু হয়েছে। এমন বিভ্রান্তি এখনো চলছে।
কর্তৃপক্ষের এক জন বলেছেন, ‘আমি এটাকে প্রশ্ন ফাঁস বলব না। ...এটাই নতুন কারিকুলামের বিশেষত্ব।’ কোনো একজন প্রতিষ্ঠানপ্রধান এই প্রশ্ন ‘না জেনেবুঝেই’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করে ফেলছেন। ...‘সমস্যা আসলে তখনই হয়, যখন এগুলোর সমাধানসহ আমরা সোশ্যাল কিংবা অন্যান্য মাধ্যমে শেয়ার করি। ফলে শিক্ষার্থী, অভিভাবক সবাই বিভ্রান্ত হন, ভুল বোঝেন।’ ‘আমরা নতুন করে একটি নোটিশ জারি করেছি, পরবর্তীকালে যাতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। যদি ঘটে, তবে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া, সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, এখন থেকে পরীক্ষার আগের দিন সন্ধ্যায় প্রশ্নপত্র সরবরাহ করা হবে।’
আমাদের দেশে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে উন্নত দেশের ধারণা বাস্তবায়ন করার প্রচেষ্টা সব সময় করা হয়। কিন্তু উন্নত দেশের শিক্ষা, কৃষ্টি ও মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের কাছে আমাদের বিস্তর ফাঁরাক বিদ্যমান থাকায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সেটাকে পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারে না। ফলে শিক্ষার উন্নয়ন ও মূল্যায়নে সুদূর অতীতকাল থেকে দুর্বলতা লক্ষণীয়। তাই কিছুদিন পরপর নানা ধরনের কৌশল উদ্ভাবন করে এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু নতুন করে সৃষ্ট জটিলতা কোনোভাবে এড়ানো যাচ্ছে না। আমাদের মূল্যায়নপাত্র বা মূল্যায়নকারীদের দুর্বলতা থেকে প্রয়োগকৃত অত্যাধুনিক পদ্ধতি ও কৌশলগুলো বারবার মার খেয়ে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে।
কর্তৃপক্ষ যতই ব্যাখ্যা দিন না কেন, আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী প্রশ্ন ফাঁস বড় অপরাধ। সেটা এড়ানোর কোনো আলাদা উপায় নেই। সেজন্য দেশজ পেডাগোজিক্যাল জ্ঞান ও কৌশল ছাড়া হুটহাট করে বৈদেশিক কোনো ধারণাকে এখানে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যেসব চ্যালেঞ্জ ও আইনগত হুমকি তৈরি হয়ে যায়, সেসব চ্যালেঞ্জের সঙ্গে আমরা খাপ খাওয়াতে অপারগ। ফলে প্রকল্পগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে প্রায়শই ভেস্তে যায় এবং নানা অনৈতিকতা লালন করে জনভোগান্তি বাড়িয়ে তোলে।
নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষার সামষ্টিক মূল্যায়নের লিখিত অংশের ভার ৬৫ শতাংশ। আর কার্যক্রমভিত্তিক অংশের ভার ৩৫ শতাংশ। আর ব্যাবহারিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কার্যক্রম বলতে সহজে বললে হাতেকলমে কাজ। কার্যক্রমভিত্তিকের মধ্যে আছে অ্যাসাইনমেন্ট, উপস্থাপন, অনুসন্ধান, প্রদর্শন, সমস্যার সমাধান করা ইত্যাদি। ব্যাবহারিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে হাতেকলমে কাজ ও হোমওয়ার্ক করে আনা বোঝালে সেটা শিক্ষার্থীর আসল দক্ষতা বহন করে না। গৃহশিক্ষক, অভিভাবক দ্বারা তৈরি করা কাজ জমা দিয়ে বাহবা পেয়ে যায় অনেকে। ইতিপূর্বে অ্যাসাইনমেন্ট, দ্রব্য প্রদর্শন ইত্যাদিতে ব্যাপকভাবে তা লক্ষ করা গেছে। এটাকেও অসদুপায় বা নকল বলে গণ্য করতে হবে।
পাঁচ ঘণ্টার পরীক্ষা দিতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভীতি তৈরি হতে পারে। একজন শিক্ষার্থী স্কুলে যতক্ষণ থাকে, ঠিক ততটুকু সময়ের মধ্যেই পরীক্ষা শেষ করতে হবে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো—এই মূল্যায়নে শিক্ষার্থীরা আগেই জানে যে, তারা ফেল করবে না। ফলে তাদের মধ্যে কোনো প্রতিযোগিতা নেই, নেই পড়াশোনা ও জ্ঞান অন্বেষণের জন্য কোনো তাড়না। তাদের মধ্যে ভাবটা এমন, কোনো পড়াশোনা করলে করব, না করলে কোনো দোষ নেই। এই অবহেলা জাগ্রত হওয়ার ফলে গ্রুপ স্টাডি, টিমওয়ার্ক সেখানেও অনেকের মধ্যে অনীহা।
শিক্ষক ও মূল্যায়নকারীদের মধ্যে নতুন বিষয়গুলো একেবারেই অজানা। তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকায় এবং প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরও পর্যাপ্ত অনুশীলন না থাকায় নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে বারবার ভুল করে বসছেন। শিক্ষকদের মধ্যে অনেকের আইটি-ভীতি ও স্মার্ট ডিভাইস ব্যবহারের অভ্যাস না থাকায় হঠাত্ করে প্রশিক্ষণের জ্ঞান তারা কোনোভাবে কাজে লাগাতে পারছেন না। তারা অনেকে ডিভাইস ব্যবহারের অপারগতায় অন্যের সাহায্য নিতে বাধ্য হচ্ছেন। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানপ্রধান নিজের দুর্বলতা আড়াল করতে সরকারি অ্যাপসের মাধ্যমে পাঠানো তথ্য নিজে রিসিভ করতে না পারায় পরীক্ষার গোপনীয়তা ভঙ্গ করে প্রশ্ন ‘না জেনেবুঝেই’ নিজের সন্তান, কলিগ, এমনকি নিকটস্থ কম্পিউটার সার্ভিস সেন্টারের অপারেটরের সাহায্য নিতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের গোপনীয়তা বজায় রাখা অসম্ভব হয়ে উঠছে।
তাই তো প্রধান শিক্ষকের অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছেন এবং পরীক্ষার আগের রাতে পাঠানো গোপন প্রশ্নপত্র তার সহযোগীর মাধ্যমে অতি সহজেই ছড়িয়ে গিয়ে প্রশ্ন ফাঁসের মতো কেলেঙ্কারি সৃষ্টি করছে। এটাই আমাদের দেশের ডিজিটাল তথ্য ব্যবহারের অতি দুর্বল অবস্থা ও নিয়ন্ত্রণহীনতার ক্ষেত্রকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। শুধু শিক্ষাই নয়, আমাদের দেশে মাঠ পর্যায়ে স্মার্ট ডিভাইসের মাধ্যমে গোপনীয় তথ্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে এটাই এখন চরম বাস্তবতা। শিক্ষাব্যবস্থার অ্যাপস-ভিত্তিক আধুনিক ও স্মার্ট মূল্যায়নে শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি না থাকায় বিভ্রান্তির পুনরাবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন ব্যাপার। এ অবস্থায় গ্রাম ও শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানভেদে আরো বিভাজন তৈরি হচ্ছে। পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছাড়াই মাত্র এক দিন আগে নতুন মূল্যায়ননীতি চূড়ান্ত করে কীভাবে সেটাকে গোটা দেশের কোটি পরীক্ষার্থীর ওপর প্রয়োগ করা সম্ভব, সেটা কারো বোধগম্য হচ্ছে না। কামলমতি শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকগণ বারবার এসব এক্সপেরিমেন্টের জাঁতাকলে পড়ে হেনস্তা হচ্ছেন। সুতরাং এ ব্যাপারে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েই কাজ করতে হবে।
একুশে সংবাদ/স.ট.প্র/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :